চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Friday, May 7, 2021

      নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ
অথবা, নৈতিক শিক্ষা
অথবা, মূল্যবোধ

রচনা সংকেত

v     ভূমিকা;
 
নৈতিক শিক্ষা কী;
মূল্যবোধ কী;
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের স্বরূপ;
নৈতিক মূল্যবোধের চর্চার গুরুত্ব;
নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা; 
সমাজে নৈতিক মূল্যবোধহীনতার প্রভাব;
নৈতিক অধঃপতনের কারণ;
নৈতিক অধঃপতন থেকে উত্তরণের উপায়;
উপসংহার।

ভূমিকা: নৈতিক মূল্যবোধ মানবচরিত্রকে করে তোলে সুষমামণ্ডিত। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ তৈরি। এরিস্টটল বলেছেন: Education is the creation of sound mind in a sound body. অর্থাৎ, সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করার নামী শিক্ষা। এই সুস্থ মন এর সঙ্গে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বৃক্ষলতা সহজেই বৃক্ষলতা কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের প্রাণপণ চেষ্টারই ফলশ্রুতি। মানব জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। 

নৈতিক শিক্ষা কী: অনেক শিক্ষাবিদই মনে করেন শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠনই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাধারণভাবে মানব আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলো দিককে নৈতিক চরিত্রের অন্তর্গত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে

১। জীবনে উচ্চ মূল্যবোধের উপলব্ধি ও চর্চা (realization and practice of higher values in life)

২। মনের প্রশিক্ষণ বা ইচ্ছাশক্তি (training of mind or will-power)

৩। সুশৃঙ্খল সহজাত প্রবৃত্তি (discipline of instincts) এবং

৪। সহজাত প্রবৃত্তিমূলক আচরণকে নৈতিক আচরণে রূপান্তর করা (changing instinctive behavior into moral behavior)

সর্বোপরি, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ এর মাধ্যমে ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি বিকাশের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন-

১. মানবিক গুণাবলির সমাহার হিসেবে ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, নির্ভরযোগ্যতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, সহজ অমায়িকতা, পরহিতব্রত ইত্যাদি।

২. শৃঙ্খলাসময়ানুবর্তিতা, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি সামগ্রিক আচার-আচরণ-অভ্যাস।

৩. দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেগ

৪. হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি মানসিকতা পরিহার এবং বদ অভ্যাস বা প্রবৃত্তি দমন.

৫. ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ, পরহিতব্রত ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ।

মূল্যবোধ কী: সাধারণ অর্থে নৈতিকতা সম্বন্ধে সচেতনতা জাগানোর শিক্ষাকে মূল্যবোধ শিক্ষা বলা হয়। দীর্ঘ অনুশীলনের পর গ্রহণ বর্জন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সকল বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে গ্রহণ ও লালন করা হয় যেগুলো ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর, সঠিক ও কাঙ্ক্ষিত।

সামাজিক ন্যায়নীতি, বিশ্বাস, আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে যে ধ্যান ধারণা তাই মূল্যবোধ। মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে পড়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ, প্রীতি, সহমর্মিতা, সহনশীলতা ইত্যাদি। মানবিক মূল্যবোধের সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক জড়িত। মানবিক মূল্যবোধ যার নেই তার নৈতিকতাবোধও নেই বলা চলে। শিশুরা মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে জন্মায় এটি তাদের অর্জিত গুণ। শিশুরা পরিবার, সমাজ থেকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা পায়। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয়ও মমূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষা লাভের উৎকৃষ্ট স্থান।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধের স্বরূপ: নৈতিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ একই সূত্রে গাঁথা। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের মাধ্যমেই কেবল একজন মানুষ সাম্যভাব, শান্তস্বভাব, মার্জিত আচরণ এবং প্রজ্ঞার অধিকারী হতে পারে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষকে সুখী হতে এবং তার মানবতাবোধ জাগ্রত করতে সহায়তা করে। এজন্যে সুখী, সমৃদ্ধ ও সর্বাঙ্গীনভাবে সুস্থ জীবনধারার মধ্যেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ-এর স্বরূপ নিহিত।

নৈতিক মূল্যবোধের চর্চার গুরুত্ব: মানুষের জীবন ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা সংকীর্ণতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না এবং মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ বিচার করবে এবং মানবতার পরিচয় দিবে এটাই নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার মূল কথা। নৈতিক আদর্শ সম্বলিত সমাজে কোনো অনাচার থাকবে না, ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা এসব থেকে সমাজ মুক্ত থাকলে তাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সকল প্রকার দুর্নীতি থেকে মুক্ত জীবনই আদর্শ-জীবন। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলা, সত্য ও ন্যায় পথের অনুসারী হওয়া, অপরের ক্ষতি থেকে বিরত থাকা, পরোপকারের মহান ব্রতে নিজেকে নিবেদিত করা এসব গুণ নিয়েই নৈতিকতার বিকাশ। মানবিকগুণে সমৃদ্ধ চরিত্রই নৈতিক মূল্যবোধের ফল।

নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তিজীবনকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে, তার আদর্শ সবার কাছে অনুসরণীয় হয়। সত্যকে সত্য বলে চিনতে পারা, মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া নৈতিক মূল্যবোধের ফল। মূল্যবোধের চেতনা দিয়ে ন্যায়ের আদর্শকে সমুন্নত রাখা সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ এই নৈতিক মূল্যবোধ সংবলিত মানুষ ও নাগরিক সৃষ্টি করা।

নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা: নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা সমাজকে সুন্দর করে তোলা যায়। সত্যকে সত্য বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা এবং ন্যায় অন্যায় ও সত্য মিথ্যার পার্থক্য জেনে ও বুঝে চলা নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের দ্বারাই সম্ভব। নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ দেশ ও জাতির গর্ব। সমাজের এই ধরণের মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে সেই সমাজ ও জাতির গৌরব ততই বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকেরই নৈতিকতার চর্চা করা উচিত।

নৈতিক মূল্যবোধের অভাব হলে সমাজে অশান্তি দেখা দেয়। সামাজিক অসাম্য, অবিচার, সীমাহীন দুর্নীতি ইত্যাদি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সমাজজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে, মানবকল্যাণ ব্যাহত হয়।যুদ্ধগ্রহ, হত্যা, লুন্ঠন ও সন্ত্রাস বেড়ে যায়। নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব আছে বলেই বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অশান্তি ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় প্রত্যেকের উচিত নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা করা। 

সমাজে নৈতিক মূল্যবোধহীনতার প্রভাব: আমাদের দেশে লক্ষ করলে দেখা যায় সর্বত্রই একটা অস্থিরতা। সকলেই যেন কোন না কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, ন্যায়ের প্রতি কারও আগ্রহ নেই। বেড়েছে ভোগবাদী প্রবণতা, কর্তব্যের প্রতি অবহেলা, সহানুভূতির পরিবর্তে মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা, স্বার্থ সাধনের জন্যে ব্যাপক তৎপরতা, জনকল্যাণের প্রতি অনীহা। এসব মূল্যবোধহীনতা মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে। অথচ দেশে শিক্ষার বা স্বাক্ষরতার হার (৬৪%) বেড়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয় (৩৬৯ মার্কিন ডলার) সঞ্চয়ও কিছুটা বেড়েছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তা বাড়ার কথা ছিল সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ার কথা ছিল। সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এসব না হয়ে হয়েছে উল্টোটাই।

পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বের অসুস্থতা আর মানবিক হাহাকারের খবর। এই অবস্থার নিরসন না হলে মানবসভ্যতা একদিন সত্যি সত্যি ধ্বংস হয়ে যাবে। সারা পৃথিবী পরিণত হবে ভয়ানক এক স্থানে। তাই পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির স্বার্থে নৈতিক মূল্যবােধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তােলা একান্ত প্রয়ােজন।

নৈতিক অধঃপতনের কারণ: নৈতিক অধঃপতনের নানা কারণ বিদ্যমান। অবশ্য নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবই এর প্রধান ও একমাত্র কারণ। তদুপরি বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করতে গেলে যেসব কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে তা নিম্নরূপ:

১। ব্যক্তির সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য দৈহিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধনে পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা।
২। মানুষের মধ্যে ভোগবাদী প্রবণতা বেড়েছে।
৩। অর্থনৈতিক বিপর্যয় নৈতিক অধঃপতনের আরেকটি কারণ। দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে অর্থনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে শ্রেণিবৈষম্য দেখা দেয়।
৪। রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলেও কোন জাতির নৈতিক অবক্ষয় নেমে আসতে পারে।
৫। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও স্বেচ্ছাচারিতা নৈতিক অধঃপতনের অপর একটি কারণ।
৬। সর্বোপরি নৈতিক শিক্ষার জন্য সমাজে যে আদর্শ থাকার কথা তা ক্রমেই নানাকারণে হ্রাস পেয়েছে, ফলে নৈতিক মূল্যবোধের শূন্যতা দেখা দিয়েছে।
৭। গ্রামজীবনের যুথবদ্ধতা ভেঙে নগরজীবনে প্রবেশ।
৮। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া।
৯। মহাপুরুষদের আৰ্দশ অনুসরণ না করা। 

নৈতিক অধঃপতন থেকে উত্তরণের উপায়: দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য আমাদেরকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে হবে। এজন্য সমাজের সকল স্তরে ন্যায়নীতি ও সততা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

১। সুষ্ঠু সমাজ গঠনের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব বাবা-মা বা অভিভাবকের।
২। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যাতে শিশুরা উৎকৃষ্ট ও কল্যাণকর মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় বলীয়ান হয়।
৩। আর্নল্ড টয়েনবি (
Arnold J. Toynbee) এবং দাইসাকু ইকেদা তাদের লেখা সৃজনমূলক জীবনের দিকে বইতে বলেছেন, সুস্থ সমাজ গঠনে, পরিশীলিত ও রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে সৃজনশীল পাঠ একান্ত জরুরি।
৪। দূর অতীত হতে সুসভ্য ও সুষম সমাজ গঠনের জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে আদর্শবাদী মানুষের জন্ম হয়েছে। তাদের সে সকল আদর্শের বাণী, যা সমাজকে স্থিতিশীল, সুসংগঠিত, ধৈর্যশীল, প্রকৃতিপ্রেমিক, পরিবেশ-বান্ধব ইত্যাদি করতে পারে। তাই মনীষীদের জীবনী পাঠ করা একান্ত কর্তব্য।
৬। ধর্মীয় শিক্ষাও নৈতিক চরত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭। শৈশব থেকেই বাবা-মা বা অভিভাবক তাদের সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সকল পর্যায়ে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি যাতে মমত্ববোধ জন্মায় তার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে মটিভেশনাল শিক্ষা দিতে হবে।

উপসংহার: পরিশেষে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়:

মানুষের সভ্যতা যতদূর উন্নত হয়েছে, ততদূর সফল হয়েছে মানুষের বিবেক

মানুষের আত্মিক ও সামাজিক উৎকর্ষের জন্যে এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। সমগ্র দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগের ফলেই এই স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হয়েছিল। তাই আমাদের প্রয়োজন ও কর্তব্য নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে একটি সুখী-সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলা।

 

স্বাধীনতা তুমি
শামসুর রাহমান
 
স্বাধীনতা তুমি 
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। 
স্বাধীনতা তুমি 
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো 
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- 
স্বাধীনতা তুমি 
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা 
স্বাধীনতা তুমি 
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। 
স্বাধীনতা তুমি 
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। 
স্বাধীনতা তুমি 
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। 
স্বাধীনতা তুমি 
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী। 
স্বাধীনতা তুমি 
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক। 
 
স্বাধীনতা তুমি 
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর 
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ। 
স্বাধীনতা তুমি 
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ। 
স্বাধীনতা তুমি 
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা। 
স্বাধীনতা তুমি 
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক 
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। 
স্বাধীনতা তুমি 
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন। 
স্বাধীনতা তুমি 
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ। 
স্বাধীনতা তুমি
বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার। 
 
স্বাধীনতা তুমি 
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল, 
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম। 
স্বাধীনতা তুমি 
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা, 
খুকীর অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা। 
স্বাধীনতা তুমি 
বাগানের ঘর, কোকিলের গান, 
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা, 
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।



মোহম্মদ মনিরুজ্জামান
শহীদ স্মরণে
 

কবিতায় আর কি লিখব?
যখন বুকের রক্তে লিখেছি
একটি নাম বাংলাদেশ।
গানে আর ভিন্ন কি সুরের ব্যঞ্জনা?
যখন হানাদারবধ সংগীতে
ঘৃণার প্রবল মন্ত্রে জাগ্রত
স্বদেশের তরুণ হাতে
নিত্য বেজেছে অবিরাম
মেশিনগান,মর্টার,গ্রেনেড।

কবিতায় কি লিখব?
যখন আসাদ
মনিরামপুরেরর প্রবল শ্যামল
হৃদয়ের তপ্ত রুধিরে করেছে রঞ্জিত
সারা বাংলায় আজ উড্ডীন
সেই রক্তাক্ত পতাকা।
আসাদের মৃত্যুতে আমি
অশ্রুহীন; অশোক; কেননা
নয়ন কেবল বজ্রবর্ষী; কেননা
আমার বৃদ্ধ পিতার শরীরে
এখন পশুদের প্রহারের
চিহ্ণ; কেননা আমার বৃদ্ধা মাতার
কণ্ঠে নেই আর্ত হাহাকার, নেই
অভিসম্পাত- কেবল
দুর্মর ঘৃণার আগুন; কোন
সান্ত্বনা বাক্য নয়, নয় কোন
বিমর্ষ বিলাপ; তাঁকে বলি নি'

তোমার ছেলে আসল ফিরে
হাজার ছেলে হয়ে
আর কেঁদো না মা; কেননা
মা তো কাঁদে না;
মার চোখে নেই অশ্রু, কেবল
অনলজ্বালা,দু চোখে তাঁর
শত্রুহননের আহ্বান।

আসদের রক্তধারায় মহৎ
কবিতার, সব মহাকাব্যের,
আদি অনাদি আবেগ- বাংলাদেশ-জাগ্রত।
আমি কবিতায় নতুন আর কি বলব? 

যখন মতিউর করাচীর খাঁচা ছিঁড়ে ছুটে গেল
মহাশূন্যে টি-৩৩ বিমানের দুর্দম পাখায়

তার স্বপ্নের স্বধীন স্বদেশ মনে করে-
ফেলে তার মাহিন তুহিন মিলি
সর্বস্ব সম্পদ; পরম আশ্চর্য এক
কবিতার ইন্দ্রজাল স্রষ্টা হল-
তার অধিক কবিতা আর
কোন বঙ্গভাষী কবে লিখেছে কোথায়?

আমি কোন শহীদের স্মরণে লিখব?
বয়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তর;
বাংলার লক্ষ লক্ষ আসাদ মতিউর আজ
বুকের শোণিতে উর্বর করেছে এই প্রগাঢ় শ্যামল।
শহীদের পূণ্য রক্তে সাত কোটি
বাঙালির প্রাণের আবেগ আজ
পুষ্পিত সৌরভ। বাংলার নগর, বন্দর
গঞ্জ, বাষট্টি হাজার গ্রাম
ধ্বংস্তুপের থেকে সাত কোটি ফুল
হয়ে ফোটে। প্রাণময় মহৎ কবিতা
আর কোথাও দেখি না এর চেয়ে।
শব্দভূক পদ্যব্যবসায়ী ভীরু বঙ্গজ পুঙ্গব সব
এই মহাকাব্যের কাননে খোঁজে নতুন বিস্ময়।

কলমের সাথে আজ
কবির দুর্জয় হাতে নির্ভুল স্টেনগান কথা বলে।
কবিতায় আর নতুন কি লিখব।
যখন বুকের রক্তে লিখেছি একটি নাম বাংলাদেশ।


 

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো
--নির্মলেন্দু গুণ 
 
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে- 'কখন আসবে কবি?'
 
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে- ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তাহলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,
ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...।
 
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে,- আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর;
না পার্ক না ফুলের বাগান,- এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশে ছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।
 
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল
কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে
এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে
এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে
এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: 'কখন আসবে কবি?' 'কখন আসবে কবি?'
 
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনলেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
 
সেই থেকে 'স্বাধীনতা' শব্দটি আমাদের।

আমার পরিচয়

 

আমার পরিচয়
সৈয়দ শামসুল হক
 
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
 
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
 
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
 
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি কমলার দীঘি মহুয়ার পালা থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
 
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
 
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
 
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
 
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস।
 
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

মাগো, ওরা বলে

 

মাগো, ওরা বলে

--আবু জাফর ওবাইদুল্লাহ

 

কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজেন ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা, তুই কবে আসবি? কবে ছুটি?

চিঠিটা তার পকেটে ছিল
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

মাগো ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে

গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ী ফিরবো।
লক্ষ্মী মা, রাগ করো না,
মাত্রতো আর কটা দিন।


পাগল ছেলে, মা পড়ে আর হাসে,
তোর ওপরে রাগ করতে পারি!
নারকেলের চিড়ে কোটে,
উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,
এটা-সেটা আরো কতো কি!
তার খোকা যে বাড়ি ফিরবে ক্লান্ত খোকা।

কুমড়ো ফুল শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পড়েছে ডাঁটা,
পুঁই লতাটা নেতানো
খোকা এলি?
ঝাপ্সা চোখে মা তাকায় উঠানে উঠানে
যেখানে খোকার শব শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে।

এখন মার চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের।
তারপর দাওয়ায় বসে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার কখন আসে কখন আসে!

এখন মার চোখে শিশির-ভোর
স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।

শোন একটি মুজিবরের থেকে

 

শোন একটি মুজিবরের থেকে

--গৌরী প্রসন্ন মজুমদার

শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণী
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।

এই সবুজের বুকে চেরা মেঠো পথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছে
হায়রে এমন সোনার খনি।।

বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’,
নজরুলের ‘বাংলাদেশ’,
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।

জয় বাংলা বলতে মন রে আমার
এখনও কেন ভাবো আবার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
অন্ধকারে পূর্বাকাশে-, উঠবে আবার দিনমণি।।

রৌদ্র লেখে জয়

 

রৌদ্র লেখে জয় – শামসুর রাহমান


বর্গি এলো খাজনা নিতে,
        মারল মানুষ কত।
পুড়ল শহর, পুড়ল শ্যামল
        গ্রাম যে শত শত।

হানাদারের সঙ্গে জোরে
        লড়ে মুক্তিসেনা,
তাদের কথা দেশের মানুষ
        কখনো ভুলবে না।

আবার দেখি নীল আকাশে
        পায়রা মেলে পাখা,
মা হয়ে যায় দেশের মাটি,
        তার বুকেতেই থাকা।

কাল যেখানে আঁধার ছিল
        আজ সেখানে আলো।
কাল যেখানে মন্দ ছিল,
        আজ সেখানে ভালো।

কাল যেখানে পরাজয়ের
        কালো সন্ধ্যা হয়,
আজ সেখানে নতুন করে
        রৌদ্র লেখে জয়।

মুক্তির ছড়া

 

মুক্তির ছড়া
--সানাউল হক


তোমার বাংলা আমার বাংলা
সোনার বাংলাদেশ-
সবুজ সোনালি ফিরোজা রুপালি
রূপের নেই তে শেষ।


আমি তো মরেছি যতবার যায় মরা,
নবীন যাত্রী তোমাকে শোনাই ছড়া।
এদেশ আমার এদেশ তোমার
সবিশষ মুজিবের,
হয়তো অধিক মুক্তিপাগল
সহস্র শহীদের।

আমি হব

 

আমি হব
--কাজী নজরুল ইসলাম

আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠব আমি ডাকি।


সুয্যি মামা জাগার আগে
উঠব আমি জেগে,
হয় নি সকাল, ঘুমো এখন,
মা বলবেন রেগে!


বলব আমি- আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল, তাই বলে কি
সকাল হবে না ক!


আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা
রাত পোহাবে তবে।

Thursday, May 6, 2021

রচনা

 অপসংস্কৃতি ও বর্তমান যুবসমাজ

     সংকেত: 
💜 ভূমিকা; 
💜 জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক; 
💜 অপসংস্কৃতির উৎস; 
💜 জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অশনি সংকেত; 
💜 অপসংস্কৃতি ও আমাদের যুবসমাজ; 
💜 পোশাক-পরিচ্ছদের উপর প্রভাব; 
💜 খাদ্যাভাসের উপর প্রভাব; 
💜 ভাষা ও সংলাপের উপর প্রভাব; 
💜 ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর প্রভাব; 
💜 অপসংস্কৃতি রোধের উপায়; 
💜 উপসংহার।

ভূমিকা: সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন- সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য মানুষের নৈমিত্তিক প্রচেষ্টাই সংস্কৃতি, আর অপসংস্কৃতি হলো এর বিপরীত। আত্মার মৃত্যু ঘটিয়ে অসুন্দরের উপাসনা করে, অকল্যাণের হাত ধরে বেঁচে থাকাই অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি মানুষকে কলুষিত করে এবং জীবনের সৌন্দর্যের বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়ে শ্রীহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।

জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক: জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সমাজে বসবাসরত মানুষের প্রত্যেকটি কার্যকলাপই তাদের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। কোনো সমাজই তাদের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না। মূলত সংস্কৃতি এবং জীবন একে অপরের পরিপূরক।

অপসংস্কৃতির উৎস: উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উদ্দাম ভোগ-বিলাসিতা ও উচ্ছ্বংখলতার জন্ম দেয়। নতুন সংস্কৃতির উন্মত্ততায় সে সময়ে যে অনাচার ও উচ্ছৃংখলতা দেখা দিয়েছিল সেগুলোকে বর্জন করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সদর্থক ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিল সমাজ-সংস্কারক বাঙালি মনীষীরা। বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অবাধ সুযোগে আমাদের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পাশ্চাত্য যুবসমাজ যে মাদক নেশা ও অবক্ষয়ে আক্রান্ত, আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমে তা ক্রমবিস্তার লাভ করছে আমাদের তরুণ সমাজে। অসংযত পাশ্চাত্য মানসিকতা, উগ্র বিদেশিয়ানা ও ভোগপ্রবণ স্থূলতা আজ আমাদের সংস্কৃতির মূলধারাকে গ্রাস করতে বসেছে। বৈদেশিক সংস্কৃতির নির্বিকার গ্রহণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য এখন হুমকিস্বরূপ।

জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অশনি সংকেত: বাংলাদেশে জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির প্রবল প্রতাপ লক্ষনীয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ করার এক উদ্ভট জোয়ার চলছে এ দেশে। বিশেষত এ দেশের তরুণ সমাজ আজ দিকভ্রান্ত, দিশেহারা। তাদের বেঁচে থাকার সাথে নীতির সম্পর্ক নেই। এই বোধ থেকেই অপসংস্কৃতির জন্ম হয়। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা এখন হাস্যকর দুর্নীতি এখন সামাজিকভাবে স্বীকৃত। আর এখন অনৈতিকতার সূত্রপাত হচ্ছে মানুষের অসৎ জীবিকার্জনের হাত ধরে। সৎভাবে যে জীবিকার্জন না করে তার পক্ষে অপসংস্কৃতির দাসত্ব ছাড়া উপায় নেই। প্রতিদিনের সংবাদপত্র আমাদের সামনে যে চালচিত্র তুলে ধরে, তাতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন অতি স্পষ্ট। অশ্লীলতা, নোংরামি, খুন, ছিনতাই, প্রতারণা- সবই অপসংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমাদের সমাজ আজ এসবেরই দাসত্ব করে চলেছে।

অপসংস্কৃতি ও আমাদের যুবসমাজ: সমাজবিজ্ঞানী E.B Taylor বলেন- “Calture perrersion might lead the youth gearation.” আজকের তরুণেরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অপসংস্কৃতি তাদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যুবসমাজ শুদ্ধ সংস্কৃতি সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত। তারা অসুন্দর ও কলুষিত সংস্কৃতি তথা অপসংস্কৃতির শিকার। যুবসমাজের একটা বড় অংশকে সুকৌশলে করা হয়েছে আদর্শভ্রষ্ট। সুন্দর জীবনের পথ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্ধকার জীবনের পথে। তারা তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে, অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। বিপুল সংখ্যক তরুণের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে অস্ত্র, জড়িয়ে ফেলা হয়েছে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ডে। তারা লিপ্ত হচ্ছে অসামাজিক কাজে। হিংসাশ্রয়ী-অশ্লীল চলচ্চিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী বিকৃত রুচির নাচ-গান, রুচিগর্হিত পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি তাদেরকে আকৃষ্ট ও অনুরক্ত করার গভীর নীলনকশা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে।

পোশাক-পরিচ্ছদের উপর প্রভাব: পোশাক-পরিচ্ছদে আমাদের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য ছিল। বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। জিন্স, টি-শার্ট, স্কার্ট এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা পাজমা-পাঞ্জাবি এখন আর তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। আমাদের মেয়েদের অনেকেই স্বল্পবসনকে আধুনিক জীবনের নমুনা বলে ভুল করে। পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের ধারাকে ধরতে পারে না তেমনি দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা একটি দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয় অবশেষে জীবন হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ।

খাদ্যাভ্যাসের উপর প্রভাব: বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে যুবসমাজে খাদ্যাভ্যাসে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। কোনো খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনা না করে টেলিভিশন চ্যানেলে খাবারের বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম তাতে আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতির নতুন সংযোজন হচ্ছে ফাস্টফুড সংস্কৃতি। বর্তমানে তরুণ-তরুণীসহ শিশু-কিশোর এমনকি বয়স্কদের মাঝেও এ সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। যা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব খাবারগুলোকে ক্রমান্বয়ে অস্বীকার করার প্রবণতা তৈরি করছে।

ভাষা ও সংলাপের উপর প্রভাব: বিশ্বায়নের আর একটি প্রত্যক্ষ ও বাহ্যিক প্রভাব আমাদের তরুণ প্রজন্মের কথাবার্তার পরিবর্তন। বর্তমান শিশুরা বাবা-মাকে বাংলা ভাষায় সম্বোধন না করে বিদেশি ভাষা বিশেষত ইংরেজিতে পাপা, মাম্মি বা মম ডাকতে আগ্রহী। কথায় কথায় তারা অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করে। বাংলা ইংরেজি, হিন্দি একসাথে মিলিয়ে পরস্পরের সাথে কথা বলে, একে তারা আধুনিকতা মনে করে। তাছাড়া বাংলা শব্দের বিকৃতি এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর প্রভাব: বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চরমভাবে আঘাত করছে, সেটি হলো আমাদের ধর্মীয় জীবনবোধ ও নৈতিক শিক্ষা। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের যুবসমাজে ধর্মনিষ্ঠা এবং নৈতিকতা বোধ ক্রমহ্রাসমান। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আর অ্যালকোহলিক সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী। সুখী সুন্দর ও শান্তিময় জীবনের জন্য এসব কিছুর চেয়ে ধর্মীয় জীবনের নীতি অনুসরণ খুবই জরুরি। বিদেশি সংস্কৃতির আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

অপসংস্কৃতি রোধের উপায়: পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বিশ্ব সম্রাজ্যের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আমাদের নেই। তাই এর মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর স্বার্থকে বাঁচিয়ে রেখে চলতে হবে। যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের এই বিপথগামিতা, সেই পরিবেশের আমূল সংস্কার অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সকল শ্রেণির মানুষকে সচেতন হতে হবে। নিষিদ্ধ করতে হবে অপসংস্কৃতির বেসাতি। তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে নতুন মূল্যবোধে। সুযোগ দিতে হবে আত্মবিকাশের। মনে রাখতে হবে, আদর্শভ্রষ্টতাই এ কালের যুব সমাজের একমাত্র চিত্র নয়। এক শ্রেণির যুবসমাজ বেশ সক্রিয়, সজাগ ও আদর্শবাদী। সামাজিক অবিচার, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক শঠতা সবকিছুর বিরুদ্ধেই এরা সোচ্চার। তাই আজ যারা অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আটকে গিয়ে অলস তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, সঠিক পথনির্দেশনা পেলে এই যুবসমাজই আবার উজ্জীবিত হবে দুর্বার প্রাণশক্তিতে। ফিরে পাবে তাদের হারানো শুভবুদ্ধি। যুবসমাজকে অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে হলে বিদেশি সংস্কৃতির দরজা বন্ধ করে নিজেদেরকে আরও বেশি প্রতিযোগিতার উপযোগী করে তুলতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতির লালন করতে হবে। আর বিদেশি সংস্কৃতির মোকাবেলায় টিকে থাকার জন্য দেশীয় সংস্কৃতিকে করে তুলতে হবে যুগোপযোগী। বিদেশি সংস্কৃতি অনুসরণ ও অনুকরণের ক্ষেত্রে আরও বেশি সজাগ হতে হবে। বিজাতীয় করুচিপূর্ণ সংস্কৃতি বন্ধের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশই আভিজাত্যের পরিচায়ক তরুণদের এ ধারণা ঘোচাতে হবে।

উপসংহার: সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে যুবসমাজকে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যুবশক্তির পুনরুজ্জীবনে চাই শুভ সুন্দর জীবনের নবতর দীক্ষা। মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মানবপ্রেমে ব্রতী করে যুবসমাজকে পরিচালিত করতে হবে সামাজিক অন্যায়-অবিচার, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক শঠতার বিরুদ্ধে।

--- সমাপ্ত ---