আকাশলীনা |
অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী পরীক্ষা, রচনামূলক অংশের সকল বিষয়, সৃজনশীল প্রশ্ন, শিক্ষা, সাহিত্য, কবিতা ও স্বাস্থ্যবিধি
চলমান কথা
Wednesday, September 23, 2020
সপ্তক - জীবনানন্দ দাশ---সাতটি তারার তিমির এইখানে সরোজিনী শুয়ে
আছে; – জানি না সে এইখানে |
আট
বছর আগে একদিন শোনা
গেল লাশকাটা ঘরে বধু
শুয়ে ছিল পাশে-শিশুটিও ছিল; এই
ঘুম চেয়েছিল বুঝি! ‘কোনদিন
জাগিবে না আর টের
পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে রক্ত
ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি; অশ্বত্থের
শাখা জীবনের
এই স্বাদ- সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের- শোনো জানি-তবু
জানি তবু
রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা, |
মুহূর্ত - জীবনানন্দ দাশ---মহাপৃথিবী আকাশে
জোছনা-বনের পথে চিতাবাঘের গায়ের ঘ্রাণ; |
Monday, September 21, 2020
তোমায়
আমি - জীবনানন্দ দাশ---সংকলিত তোমায়
আমি দেখেছিলাম ব’লে তুমি
আমার পদ্মপাতা হলে; শিশির
কণার মতন শূন্যে ঘুরে শুনেছিলাম
পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে খুঁজে
খুঁজে পেলাম তাকে শেষে। নদী
সাগর কোথায় চলে ব’য়ে পদ্মপাতায়
জলের বিন্দু হ’য়ে জানি
না কিছু-দেখি না কিছু আর এতদিনে
মিল হয়েছে তোমার আমার পদ্মপাতার
বুকের ভিতর এসে। তোমায়
ভালোবেসেছি আমি, তাই শিশির
হয়ে থাকতে যে ভয় পাই, তোমার
কোলে জলের বিন্দু পেতে চাই
যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে শরীর
যেমন মনের সঙ্গে মেশে। জানি
আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয় পদ্মপাতা
একটি শুধু জলের বিন্দু নয়। এই
আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল; তা
তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল বুঝেছি
আমি তোমায় ভালোবেসে। |
আমাকে
একটি কথা দাও - জীবনানন্দ দাশ---বেলা অবেলা কালবেলা আমাকে
একটি কথা দাও যা আকাশের মতো সহজ
মহৎ বিশাল, গভীর
- সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে মলিন
ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন: আমি
যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর। সেই
রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো; সেই
দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন-চঞ্চল ডানার মতন সেই
উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে অগ্নির
মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন। |
Sunday, September 20, 2020
সময়-সেতু-পথে - জীবনানন্দ দাশ---বেলা অবেলা কালবেলা ভোরের
বেলার মাঠ প্রান্তর নীলকন্ঠ পাখি দুপুরবেলার
আকাশে নীল পাহাড় নীলিমা, সারাটি
দিন মীনরৌদ্রমুখর জলের স্বর,- অনবসিত
বাহির-ঘরের ঘরণীর এই সীমা। তবুও
রৌদ্র সাগরে নিভে গেল; ব’লে গেলঃ ‘অনেক মানুষ ম’রে গেছে’; ‘অনেক নারীরা কি তাদের
সাথে হারিয়ে গেছে?’-বলতে
গেলাম আমি; উঁচু
গাছের ধূসর হাড়ে চাঁদ না কি সে পাখি বাতাস
আকাশ নক্ষত্র নীড় খুঁজে ব’সে আছে এই প্রকৃতির পলকে নিবিড়
হ’য়ে; পুরুষনারী
হারিয়ে গেছে শস্প নদীর অমনোনিবেশে, অমেয়
সুসময়ের মতো রয়েছে হৃদয়ে।
|
নির্জন
স্বাক্ষর - জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি তুমি
তো জান না কিছু, না জানিলে, - আমার
সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে! যখন
ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে, পথের
পাতার মতো তুমিও তখন আমার
বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক
ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন
তোমার! তোমার
এ জীবনের ধার ক্ষয়ে
যাবে সেদিন সকল? আমার
বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের
জল, তুমিও
কি চেয়েছিলে শুধু তাই!- শুধু
তার স্বাদ তোমারে
কি শান্তি দেবে!- আমি
ঝ’রে যাব , তবু জীবন অগাধ তোমারে
রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর’পরে,- আমার
সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে! রয়েছি
সবুজ মাঠে- ঘাসে- আকাশ
ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে ; জীবনের
রং তবু ফলানো কি হয় এই
সব ছুঁয়ে ছেনে!– সে এক বিস্ময় পৃথিবীতে
নাই তাহা- আকাশেও নাই তার স্থল- চেনে
নাই তারে ওই সমুদ্রের জল ! রাতে-
রাতে হেঁটে – হেঁটে নক্ষত্রের সনে তারে
আমি পাই নাই;- কোন এক মানুষীর মনে কোন
এক মানুষের তরে যে-
জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে!- নক্ষত্রের
চেয়ে আরও নিঃশব্দ আসনে কোন
এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে! একবার
কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা বোবা
হ’য়ে প’ড়ে থাকে- ভুলে যায় কথা! যে
– আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে
জ্ব’লে নিভে
যায় – ডুবে যায়- তারা যায় স্থ’লে– নতুন
আকাঙ্ক্ষা আসে – চ’লে আসে নতুন সময়,- পুরানো
সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়, নতুনেরা
আসিতেছে ব’লে!- আমার
বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্থ’লে কোন
এক মানুষীর তরে যেই
প্রেম জ্বালিয়েছে পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে! আমি
সেই পুরোহিত –সেই পুরোহিত!- যে-
নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে
আমার শরীরে,- যেই
তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে তুমি
আছো জেগে – যে-আকাশ
জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে জেগে
আছো ;- জানিয়াছ
তুমি এক নিশ্চয়তা – হয়েছ নিশ্চয়! হয়ে
যায় আকাশের তলে কত আলো- কত আগুনের ক্ষয়;- কতবার
বর্তমান হয়ে গেছে ব্যথিত অতীত- তবুও
তোমার বুকে লাগে নাই শীত যে-নক্ষত্র
ঝ’রে যায় তার! যে-
পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার ! জীবনের
স্বাদ লয়ে জেগে আছো – তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পার
তুমি; তোমার
আকাশে তুমি উষ্ণ হয়ে আছো, তবু- বাহিরের
আকাশের শীতে নক্ষত্রের
হইতেছে ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে
ঝ’রে- ক্লান্ত
হয়ে- শিশিরের মতো শব্দ ক’রে! জানো
নাকো তুমি তার স্বাদ , তোমারে
নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ, জীবন
অগাধ! হেমন্তের
ঝ’রে আমি ঝরিব যখন – পথের
পাতার মতো তুমিও তখন আমার
বুকের’ পরে শুয়ে রবে ?- অনেক ঘুমের
ঘোরে ভরিবে কি মন সেদিন
তোমার! তোমার
আকাশ- আলো – জীবনের ধার ক্ষয়ে
যাবে সেদিন সকল? আমার
বুকের’ পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও
কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ তোমারে
কি শান্তি দেবে! আমি
চ’লে যাব,- তবু জীবন অগাধ তোমারে
রাখিবে ধ’রে সেই দিন পৃথিবীর’পরে ;- আমার
সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে! |
স্বপ্নের
হাত -জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
পৃথিবীর
বাধা-এই দেহের ব্যাঘাতে হৃদয়ে
বেদনা জমে;-স্বপনের হাতে আমি
তাই আমারে
তুলিয়া দিতে চাই! যেইসব
ছায়া এসে পড়ে দিনের
– রাতের ঢেউয়ে,-তাহাদের তরে জেগে
আছে আমার জীবন; সব
ছেড়ে আমাদের মন ধরা
দিত যদি এই স্বপনের হাতে! পৃথিবীর
রাত আর দিনের আঘাতে বেদনা
পেত না তবে কেউ আর,- থাকিত
না হৃদয়ের জরা,- সবাই
স্বপ্নের হাতে দিত যদি ধরা!... আকাশ
ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে সারা
দিন- সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে, পৃথিবীর
যত ব্যথা,- বিরোধ,- বাস্তব হৃদয়
ভুলিয়া যায় সব! চাহিয়াছে
অন্তর যে- ভাষা, যেই
ইচ্ছা,-যেই ভালোবাসা খুঁজিয়াছে
পৃথিবীর পারে পারে গিয়া,- স্বপ্নে
তাহা সত্য হয়ে উঠেছে ফলিয়া!
মরমের
যত তৃষ্ণা আছে,- তারি
খোঁজে ছায়া আর স্বপ্নের কাছে তোমরা
চলিয়া আস ,- তোমরা
চলিয়া আস সব! – ভুলে
যাও পৃথিবীর ঐ ব্যথা –
ব্যাঘাত – বাস্তব!... সকল
সময় স্বপ্ন
– শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় যাদের
অন্তরে,- পরস্পরে
যারা হাত ধরে নিরালা
ঢেউয়ের পাশে পাশে,- গোধূলির
অস্পষ্ট আকাশে যাহাদের
আকাঙ্ক্ষার জন্ম- মৃত্যু,-l.;;সব,- পৃথিবীর
দিন আর রাত্রির রব শোনে
না তাহারা! সন্ধ্যার
নদীর জল,-পাথরে জলের ধারা আয়নার
মতো জাগিয়া
উঠিছে ইতস্তত তাহাদের
তরে । তাদের
অন্তরে স্বপ্ন,-
শুধু স্বপ্ন জন্ম লয় সকল
সময়!... পৃথিবীর
দেয়ালের’পরে আঁকাবাঁকা
অসংখ্য অক্ষরে একবার
লিখিয়াছি অন্তরের কথা,- সে
সব ব্যর্থতা আলো
আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া! দিনের
উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে ধূসর
স্বপ্নের দেশে গিয়া হৃদয়ের
আকাঙ্ক্ষার নদী ঢেউ
তুলে তৃপ্তি পায়- ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি,- তবে
ওই পৃথিবীর দেয়ালের’পরে লিখিতে
যেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে অন্তরের
কথা! আলো
আর অন্ধকারে মুছে যায় সে সব ব্যর্থতা! ... পৃথিবীর
ওই অধীরতা থেমে
যায়,- আমাদের হৃদয়ের ব্যথা দূরের
ধুলোর পথ ছেড়ে স্বপ্নেরে
– ধ্যানেরে কাছে
ডেকে লয়!- উজ্জ্বল
আলোর দিন নিভে যায়, মানুষেরো
আয়ু শেষ হয়! পৃথিবীর
পুরানো সে- পথ মুছে
ফেলে রেখা তার,- কিন্তু
এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন
রয়! সময়ের
হাত এসে মুছে ফেলে আর সব,- নক্ষত্রেরো
আয়ু শেষ হয়! |
কার্তিক
মাঠের চাঁদ (মাঠের গল্প) - জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
জেগে
ওঠে হৃদয়ে আবেগ,- পাহাড়ের
মতো ওই মেঘ সঙ্গে
লয়ে আসে মাঝরাতে
কিংবা শেষরাতের আকাশে যখন
তোমারে!- মৃত
সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে! ছেঁড়া-
ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে তরাসে
ছেলের মতো,- আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে অনেক
সময়,- তারপর
তুমি এলে, মাঠের শিয়রে,-চাঁদ;- পৃথিবীতে
আজ আর যা হবার নয়, একদিন
হয়েছে যা,- তারপর হাতছাড়া হয়ে হারায়ে
ফুরায়ে গেছে,- আজো তুমি তার স্বাদ লয়ে আর
একবার তবু দাঁড়ায়েছে এসে! নিড়নো
হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে, শস্যের
ক্ষেত চষে- চষে গেছে
চাষা চ’লে; তাদের
মাটির গল্প- তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে অনেক
তবুও থাকে বাকি,- তুমি
জান – এ- পৃথিবী আজ জানে তা কি! |
কার্তিক
মাঠের চাঁদ (মাঠের গল্প) - জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি জেগে
ওঠে হৃদয়ে আবেগ,- পাহাড়ের
মতো ওই মেঘ সঙ্গে
লয়ে আসে মাঝরাতে
কিংবা শেষরাতের আকাশে যখন
তোমারে!- মৃত
সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে! ছেঁড়া-
ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে তরাসে
ছেলের মতো,- আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে অনেক
সময়,- তারপর
তুমি এলে, মাঠের শিয়রে,-চাঁদ;- পৃথিবীতে
আজ আর যা হবার নয়, একদিন
হয়েছে যা,- তারপর হাতছাড়া হয়ে হারায়ে
ফুরায়ে গেছে,- আজো তুমি তার স্বাদ লয়ে আর
একবার তবু দাঁড়ায়েছে এসে! নিড়নো
হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে, শস্যের
ক্ষেত চষে- চষে গেছে
চাষা চ’লে; তাদের
মাটির গল্প- তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে অনেক
তবুও থাকে বাকি,- তুমি
জান – এ- পৃথিবী আজ জানে তা কি! |
একদিন খুঁজেছিনু যারে-
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের
পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,-
শেফালীর দলে!
-যাহারে
খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের
হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরোঝরো
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার
লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি
দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়,-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর
সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা!
-শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা,
তারা
দিয়ে
যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে
ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ,
গাগরীর
কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে
নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকাপথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি,- আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির
নির্জনযাত্রী তারকার কানে- কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো- আধো কথা!
-আজ
বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা
আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন
ছিল তব গোধূলির সহচর,- ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ
মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,- শুধু অবসাদ!
মহুয়ার,- ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত
শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায়
না তৃষা মোর,- জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে
দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ,-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,-
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের
অভিযান,-অঙ্গার- সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে
কাঁদি!
মর্মর্
কেঁদে ওঠে ঝরাপাতা-ভরা ভোররাতের পবন,-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্
সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর
কেঁদে মরে মন!
নীলিমা
রৌদ্র ঝিল্মিল,
উষার
আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,
অপার
ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে
নিঃসহায়
নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
-উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের
কুণ্ডলী,
উগ্র
চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত
কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
-মরীচিকা-ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে
মরে অনিবার,- পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে
জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল-
হে
নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার
ও- মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী।
জনতার
কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্
দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে
একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া
নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে
মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে
ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত
সৈকত,
ছিন্নবাস,
নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত
আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত
মুগ্ধ আঁখিপাতে,
-শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে,
নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে
যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার
চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
বনের
চাতক–মনের চাতক
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
বনের
চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়,-
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়!
ফুঁপিয়ে
ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে,-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের
লোভে
বনের
চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!
পুবের
হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের
চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের
ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!
ওরে
চাতক,-বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায়
দীঘি ঘিরে,
‘দে জল!’ ব’লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে
ছল্ছল্ !
মজিস
নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
বনের
চাতক,- হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি
ছাড়ি?
ননীর
কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায়
ঘিরে আছে!
আয়
রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।
বনের
চাতক,,-মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা
ঘিরে!
সে-কোন্
ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর
ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!
পতিতা
-জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
আগার
তাহার বিভীষিকাভরা,- জীবন মরণময়!
সমাজের
বুকে অভিশাপ সে যে, – সে
যে ব্যাধি,- সে যে ক্ষয়;
প্রেমের
পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগার
রচিয়াছে
সে যে,-দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে
দ্বার!
সূর্যকিরণ
চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর
ফনার মতন নাচে সে বুকের’ পর!
চক্ষে
তাহার কালকুট ঝরে,- বিষপঙ্কিল শ্বাস,
সারাটি
জীবন মরীচিকা তার,- প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে
তাহার ম্লান হ’য়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের
পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!
সে
যে মন্বন্তর,- মৃত্যুর দূত,- অপঘাত,- মহামারী,-
মানুষ
তবু সে,- তার চেয়ে বড়, – সে
যে নারী, সে যে নারী!
চাঁদিনীতে
-জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে,-মিশর-‘অসুর’ কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক,- মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা,- কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি!
হয়তো সেদিনো আমাদেরি মতো পিলুবারোয়াঁর বাঁশিটি নিয়া
ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!
হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে,- সবুজ চরায়,- সবজি ক্ষেতে!
হয়তো তাহার দুপুর- যামিনী বালুর জাজিমে সাগরতীরে
চাঁদের আলোয় দিগদিগন্তে চকোরের মতো চরিত ফিরে!
হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে
এম্নি কোন এক চাঁদের আলোয়,-মরু- ‘ওয়েসিসে’ তরুর মূলে!
বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে
এম্নি কোন এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!
কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া
হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!
তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড় পাতা উঠিত বাজি,
তাদের শিয়রে দুলিত জ্যোৎস্না- চাঁচর চিকন পত্ররাজি!
দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনানীর লতা-পল্লব ঘিরে,
চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া,-‘এল বল্লভ,-এল রে ফিরে!’
-তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি,
নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি,-চাঁদিনী-শরাব,-সুরার শিশি!
সেদিনো এম্নি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি,
হয়তো সেদিনো ফুটেছে মোতিয়া,-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাঁতি!
হয়তো সেদিনো নেশাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে,
হয়তো সেদিনো আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে!
হয়তো সেদিনো এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে,
হয়তো আলেয়া গেছে ভিজা মাঠে এমনি ভূতুরে প্রদীপ জ্বেলে!
হয়তো সেদিনো ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া ‘সরো’র শাখে,
হয়তো সেদিনো পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে!
হয়তো সেদিনো পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে,
হয়তো সেদিনো মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে!
হয়তো সেদিনো মানিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে
অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্ফট্ দুটি পাখার বেগে!
হয়তো সেদিনো খুর খুর ক’রে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে
ঘন-মেহগিনি- টার্পিন- তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁড়ে!
হয়তো সেদিনো জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি
মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী!
শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহরমের তোরণে গিয়া
পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো!
অলিভকুঞ্জে হা হা ক’রে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিল’ পাতা প’ড়েছে ঝরি!
‘উইলো’র বন উঠেছে ফুঁপায়ে,-‘ইউ’ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
কোন্ গ্রীস,- কোন্ কার্থেজ, রোম, ‘ত্রুবেদু’র- যুগ কোন,-
চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর- সফরে বেড়ায় মন!
জানি না তো কিছু,-মনে হয় শুধু এম্নি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হ’য়ে গেছে কত কী যে!
কত যে শ্মশান,-মশান কত যে,-কত যে কামনা- পিপাস-আশা
অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!