চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Showing posts with label সাহিত্যে অলঙ্কার. Show all posts
Showing posts with label সাহিত্যে অলঙ্কার. Show all posts

Friday, July 10, 2020

অর্থালঙ্কার প্রকরণ

# অর্থালঙ্কার কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? আলোচনা কর।

অর্থালঙ্কার শব্দের অর্থরূপের সাহায্যে যে-সকল অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলে অর্থালঙ্কার। অর্থালঙ্কারে শব্দধ্বনি গৌণ, তার অর্থই প্রধান। এজন্য অর্থ ঠিক রেখে শব্দ বদলে দিলেও অর্থালঙ্কারের কোনো পরিবর্তন হয় না।

অর্থালঙ্কার পাঁচ প্রকার।যথা:
০১. সাদৃশ্যমূলক
০২. বিরোধমূলক
০৩. শৃঙ্খলামূলক
০৪. ন্যায়মূলক
০৫. গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক।
   
০১. সাদৃশ্যমূলক: দুটো বিসদৃশ বিজাতীয় বস্তুর সাহায্যে যে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার নিমার্ণ করা হয়, তাকে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার বলে। যেমন:
বিচক-কুসুম-সম ফুল্লমুখখানি।–রবীন্দ্রনাথ।
জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়।–কাজী নজরুল ইসলাম।

সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের চারটি বিষয় মনে রাখতে হয়।

ক. যাকে তুলনা করা হয় অর্থাৎ বর্ণনীয় বস্তু-উপমেয়।
খ. যার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে-উপমান।
গ. যে সাধারণ ধর্মের জন্যে তুলনা করা হয়, তাকে বলা হয়-সাধারণ ধর্ম
ঘ. যে শব্দের দ্বারা বা ভঙ্গিতে তুলনাটি বোধগম্য হয়ে ওঠে-সাদৃশ্যবাচক শব্দ কিংবা তুলনা বাচক শব্দ।

সাদৃশ্যমূলক শব্দ:
ন্যায়, মতো, যথা, যেন, প্রায়, তুল্য, সম, সদৃশ, বৎ, যেমন, নিভ, তুলনা, উপমা, হেন, কল্প, জাতীয় ইত্যাদি সাদৃশ্যমূলক শব্দ।

সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার: উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নূতি, প্রতিবস্তুপমা, ব্যতিরেক, নিদর্শনা, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ, সন্দেহ, দৃষ্টান্ত, নিশ্চয়, তুল্যযোগিতা, দীপক, উল্লেখ, সহোক্তি, সূক্ষ্ম অলঙ্কার, অর্থ-শ্লেষ, অর্থাপক্তি, অনন্বয়, সামান্য ইত্যাদি।

02. বিরোধমূলক/বিরোধাভাস অলঙ্কার: যেখানে দুইটি বস্তুকে আপাত দৃষ্টিতে বিরোধী মনে হলেও তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেখা যায় এদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই, তাকে বিরোধাভাস অলঙ্কার বলে।যেমন:

   ১. ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে-
       ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।--গোলাম মোস্তফা।
"শিশুদের অন্তরে " শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে,আপাতবিরোধী বক্তব্য।কিন্তু 'Child is the father of man' – এ সত্য বিরোধের অবসান।
 
২. হেলা করি চলি গেলা
    বীর।বাঁচিতাম, সে মুহূর্তে মরিতাম
    যদি                                    --রবীন্দ্রনাথ।
অর্জুন পুরুষবেশী-চিত্রাঙ্গদাকে উপেক্ষা করে চলে গেছে বন-অন্তরালে।রূপমুগ্ধা নারী (চিত্রাঙ্গদা) আহত হয়েছেন এ নীরব অবহেলায়।এখানে বাঁচিতাম"- নীরব উপেক্ষার অপমান থেকে মুক্তি পেতাম অর্থে গ্রহণ করলেই বিরোধের অবসান ঘটে।

৩. তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।--রবীন্দ্রনাথ।

 বিরোধমূলক/বিরোধাভাস অলঙ্কার প্রকারভেদ: বিভাবনা, বিশেষোক্তি, বিষম, অসংগতি, অধিক, অন্যান্য, অনুকূল। 

০৩. শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার: অনেক সময় বাক্য এমনভাবে সংযোজিত হয়, যাতে এক বাক্যের একটি কাজ অন্য বাক্যের কারণ হয়, সেই কারণের কাজ আবার অন্য বাক্যের কারণ হয়। এই প্রেক্ষাপটে শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার তৈরি হয়। কারণমালা, একাবলী ও সার এই তিন প্রকার শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার রয়েছে। যেমন:

লোভে পাপ পাপে মৃত্যু শাস্ত্রের বচন।
অতএব কর সবে লোভ সন্বরণ।
এখানে ‘লোভ’ কার্যের কারণ ‘পাপ’; আবার ‘পাপ’ কার্যের কারণ মৃত্যু।

শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কারভেদ: কারণমালা, একাবলী ও সার।  

০৪. ন্যায়মূলক অলঙ্কার: বক্তব্যের মধ্যে ন্যায়বাচক থাকলে এবং উক্তির ধারা বক্তব্যকে জোরালো করলে ন্যায়মূলক অলঙ্কার হয়। যেমন:
চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিয়ে সে কিছে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
এখানে চিরসুখী ভোলে না আবার ব্যথিত জনই কেবল বেদনা বুঝতে পারে।

 ন্যায়মূলক অলঙ্কারের প্রকার: অর্থান্তরন্যাস, কাব্যলিঙ্গ, অনুমান, পরিবৃত্তি বা বিনিময়, পর্যায় ও সমুচ্চয়। 

০৫. গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক অলঙ্কার:  অর্থান্তরন্যাস , অপ্রস্তুতশংসাআক্ষেপউদাত্তব্যাজস্তুতিব্যাজোক্তিপর্যায়োক্তপরিকরভাবিক
স্বভাবোক্তিসূক্ষ।

তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

অর্থালঙ্কার

০১. সাদৃশ্যমূলক: দুটো বিসদৃশ বিজাতীয় বস্তুর সাহায্যে যে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার নিমার্ণ করা হয়, তাকে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার বলে। যেমন:

বিচক-কুসুম-সম ফুল্লমুখখানি।–রবীন্দ্রনাথ।
জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়।–কাজী নজরুল ইসলাম।

সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের চারটি বিষয় মনে রাখতে হয়।
ক. যাকে তুলনা করা হয় অর্থাৎ বর্ণনীয় বস্তু-উপমেয়।
খ. যার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে-উপমান।
গ. যে সাধারণ ধর্মের জন্যে তুলনা করা হয়, তাকে বলা হয়-সাধারণ ধর্ম
ঘ. যে শব্দের দ্বারা বা ভঙ্গিতে তুলনাটি বোধগম্য হয়ে ওঠে-সাদৃশ্যবাচক শব্দ কিংবা তুলনা বাচক শব্দ।

সাদৃশ্যমূলক শব্দ: ন্যায়, মতো, যথা, যেন, প্রায়, তুল্য, সম, সদৃশ, বৎ, যেমন, নিভ, তুলনা, উপমা, হেন, কল্প, জাতীয় ইত্যাদি সাদৃশ্যমূলক শব্দ।

সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার: উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নূতি, প্রতিবস্তুপমা, ব্যতিরেক, নিদর্শনা, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ, সন্দেহ, দৃষ্টান্ত, নিশ্চয়, তুল্যযোগিতা, দীপক, উল্লেখ, সহোক্তি, সূক্ষ্ম অলঙ্কার, অর্থ-শ্লেষ, অর্থাপক্তি, অনন্বয়, সামান্য ইত্যাদি।
সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হল-

ক. উপমা: দুই বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কারের ফলে যে চমৎকৃতি,-তা-ই উপমা। যেমন:
জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়।–কাজী নজরুল ইসলাম।
‘জোঁক’ এবং ‘মহাজন’ দুটো বিজাতীয় প্রাণী। এখানে শোষে বা শোষণ করে-সাধারণ ধর্ম। মহাজন-উপমেয়, জোঁক-উপমান, সম-তুলনাবাচক শব্দ।

উপমা ছয় প্রকার। যথা: i. পূর্ণোপমা, ii. লুপ্তোপমা, iii. মালোপমা, iv. বস্তুপ্রতিবস্তভাবের উপমা, v. বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমা,
vi. স্মরণোপমা

i. পূর্ণোপমা: যে উপমায় উপমেয়, উপমান, তুলনাবাচক শব্দ ও সাধারণ ধর্ম এ চারটি অবয়বই স্পষ্ট উল্লেখিত, তাকে পূর্ণোপমা বলে। যেমন:

বজ্রসম অপবাদ বাজে পোড়া বুকে।–মধুসূদন।
এখানে উপমেয়-অপবাদ; উপমান-বজ্র; সাধারণ ধর্ম-বাজে; তুলনাবাচক শব্দ-সম।
কাকের চোখের মত কালোচুল।–সৈয়দ আলী আহসান।
এখানে উপমেয়-চুল; উপমান-কাকের চোখ; সাধারণ ধর্ম-কালো; তুলনাবাচক শব্দ-মত।

ii. লুপ্তোপমা: যে উপমা অলঙ্কারে কেবলমাত্র উপমেয় ব্যতীত অন্য তিনটি অঙ্গের (উপমান, সাধারণ ধর্ম, তুলনাবাচক শব্দ) একটি, দুটি আবার কোথাও তিনটিই লুপ্ত বা উহ্য থাকে, তাকে লুপ্তোপমা বলে। যেমন:

১. তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত:
নির্জন গগনে একাকিনী ক্লান্তহাতে
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহশয়ন;--রবীন্দ্রনাথ।
এখানে উপমেয়-শয়ন, উপমান-দুগ্ধ, সাধারণ ধর্ম-শুভ্র কিন্তু দুগ্ধের ‘সম’ শুভ্র তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত।

২. সাধারণ ধর্ম লুপ্ত:
মরণ রে, তুহু মম শ্যাম সমান।--রবীন্দ্রনাথ।
এখানে উপমেয়-মরণ, উপমান-শ্রাম, তুলনাবাচক শব্দ-সমান কিন্তু সাধারণ ধর্ম অনুপস্থিত।

৩. উপমান ও তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত:
মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।--রবীন্দ্রনাথ।
হরিণের চোখের মত চোখ = হরিণ চোখ; এখানে উপমান ও তুলনাবাচক শব্দ অবিদ্যমান। আছে কেবল উপমেয় চোখ এবং কালো- এ সাধারণ ধর্ম।

৪. উপমান, সাধারণ ধর্ম ও তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত:
তড়িত-বরণী হরিণ-নয়নী

দেখিনু আঙিনা মাঝে।–চণ্ডীদাস।
একটি বিখ্যাত উদাহরণ। অনেকেই গ্রহণ করেছেন। তড়িতের বরনের মত বরণ যার (রাধার)-বহুব্রীহি সমাস এবং হরিণ-নয়নের মত নয়ন (রাধার) বহুব্রীহি সমাস-সেই রাধা, উপমেয় কেবল (বরণী বা নয়নী স্ত্রীলিঙ্গে ‘ঙ্গ’ প্রত্যয় যুক্ত), না আছে কোন তুলনাবাচক শব্দ, সাধারণ ধর্মজ্ঞাপক শব্দ (শুভ্র, চঞ্চল) এমন কি উপমানও (বরণ, নয়ন) বিস্ময়করভাবে অবিদ্যমান। অথচ চণ্ডীদাসের কল্পনায় এটি একটি মনোহর উপমায় ঊত্তীর্ণ।

iii. মালোপমা:  যেখানে উপমেয় একটি কিন্তু তার উপমান একাধিক, এ ধরণের উপমাকে মালোপমা বলে যেমন:

১. দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,
 রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধ তীরে যথা,
নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা আকাশ-মণ্ডল।–মধুসূদন।
উপমেয়-‘রিপুবৃন্দ’ আর উপমান-‘বালিবৃন্দ’ এবং ‘নক্ষত্র-মণ্ডল’।

iv. বস্তুপ্রতিবস্তভাবের উপমা:  উপমেয় এবং উপমানে সাধারণ ধর্মজ্ঞাপক শব্দটি যদি দুটি ভিন্ন শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে বস্তুপ্রতিবস্তভাবের উপমা বলে। যেমন:

১. দারুণ নখের ঘা ‍হিয়াতে বিরাজে
রক্তোৎপল ভাসে হেন নীল সরোমাঝে।–চণ্ডীদাস।
উপমেয়-নখের ঘা, উপমান-রক্তোৎপল, তুলনাবাচক শব্দ-হেন এবং সাধারণ ধর্ম- ভিন্ন শব্দ বিরাজে ভাসে অর্থ এক।
২. দুঃখে সুখে দিন হয়ে যায় গত   
 স্রোতের জলে ঝরে পড়া ভেসে যাওয়া ফুলের মতো।–রবীন্দ্রনাথ।
উপমেয়-দিন, উপমান-ফুল, তুলনাবাচক শব্দ-মতো এবং সাধারণ ধর্ম- ভিন্ন শব্দ গত ভেসে যাওয়া অর্থ এক।

v. বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমা: উপমেয় এবং উপমানের ধর্ম যদি একদম ভিন্ন হয়, অথচ তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সাদৃশ্য অনুভূত হয়, তবে ও ধর্ম দুটোকে বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমা বলে। যেমন:
১. দিনের শেষে শেষ আলোটি পড়েছে ওইপারে
জলের কিনারায়,
পথ চলতে বধূ যেমন নয়ন রাঙা করে
বাপের ঘরে চায়।                            –রবীন্দ্রনাথ।

এখানে উপমেয় -শেষ আলোটি, উপমান-বধূ। আত্মীয়-বিচ্ছেদ-বেদনা বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। ‘শে আলোটির রঙিন আভা-বধূর বেদনায় নয়ন রাঙা’।

২. আগনে যেমন সব বিষ যায়,
  প্রেমেও তেমনি সকলি শুচি।   --মোহিতলাল।
এখানে উপমেয় -আগুন, উপমান-প্রেম। আগুন যেমন সব কিছুকে পুড়িয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তেমনি প্রেম হৃদয়ে আগুন জ্বেলে সমস্ত পঙ্কিলতাকে বিনষ্ট করে নিজের মহিমা প্রকাশ করে, এ গভীরতর ক্ষমতা পরস্পরের সাদৃশ্য করে বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। ‘সব বিষ যায়’ ও ‘সকলি শুচি’ এ ধর্ম ভিন্ন হলেও সূক্ষ্ম সাদৃশ্য বর্তমান।

vi. স্মরণোপমা: কোন বস্তু বা বিষয়ের অনুভব থেকে যদি সে রকম কোনো বস্তুর স্মৃতি জাগে তবে তাকে স্মরণোপমা বলা যায়। াবশ্য এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, যে বস্তুর স্মৃতি অন্য বস্তুকে স্মরণে আনছে সে দুটোকে ভিন্ন জাতীয় হতে হবে।

১. কালো জল দেখিয়া কালারে মনে পড়ে।–চণ্ডীদাস।
এখানে উপমেয়-জল আর কালা (কৃষ্ণকে) রাধার মনে পড়ে।

খ. উৎপ্রেক্ষা: উৎপ্রক্ষা কথাটি এসেছে উৎকট থেকে ; যার অর্থ দাঁড়ায় উদ্ভট,মিথ্যা বা সংশয় বা কল্পনা। কবি তার কবি
শক্তির নৈপুণ্যে মিথ্যা বা সংশয় বা কল্পনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, পাঠক সহজেই তার আবেদনকে
গ্রহণ করেন।
মোটকথা; ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যের কারণে উপমেয়কে উপমান বলে সংশয় হলে উৎপ্রেক্ষা অলঙ্কার বলে।
উৎপ্রক্ষা দুই প্রকার:

১. বাচ্যোৎপ্রেক্ষা: যে উৎপ্রক্ষায় সম্ভাবনাবাচক শব্দ (যেন, মনে হয়, বুঝি, মনে ইত্যাদি) উল্লিখিত, তাকে বাচ্যোৎপ্রেক্ষা বলে। যেমন:

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

পূর্ণিমা চাঁদ(উপমেয়) যেন ঝলসানো রুটি(উপমান)।–সুকান্ত ভট্টাচায।

২. প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা: যে উৎপ্রেক্ষায় সম্ভাবনাবাচক শব্দ (যেন, মনে হয় ইত্যাদি) অনুপস্থিত অথচ অর্থ থেকে সম্ভাবনার ভাবটি

প্রতীয়মান হয়ে উঠে, তাকে বলে প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা। যেমন:
আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে - পাঁচটি রঙের ফুল ; --জসীম উদদীন।
পাঁচটি মেয়ে তো আর প্রকৃত ফুল নয়,যেন পাঁচটি রঙের ফুল; 'যেন'- অনুক্ত, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না।

গ. রূপক: উপমেয়কে সম্পূর্ণ অস্বীকার না করে যদি তার উপর উপমানের অভেদারোপ করা হয়-তবে তাকে রূপক বলে। যেমন:

আসল কথাটি চাপা ‍দিতে ভাই, কাব্যের জাল বুনি-   --যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
এখানে উপমেয়-কাব্য, উপমান-জাল অর্থাৎ কাব্যের জাল বুনি।
রূপক দুই প্রকার। যথা: ১. কেবল ও ২. মালা।

১. কেবল: যেখানে একটি উপমেয় বা বিষয়ের ওপর একটি মাত্র উপমান বা বিষয়ী আরোপ করা হয়, সেখানে কেবল রূপক হবে। যেমন:
আসল কথাটি চাপা ‍দিতে ভাই, কাব্যের জাল বুনি-   --যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
এখানে উপমেয়-কাব্য, উপমান-জাল অর্থাৎ কাব্যের জাল বুনি।

২. মালা: যেখানে একটি উপমেয় বা বিষয়ের ওপর বহু উপমান বা বিষয়ী আরোপ করা হয়, সেখানে মালা রূপক হবে। যেমন:
আমি কি তোমার উপদ্রব, অভিশাপ,
দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন, করলগ্ন কাঁটা?-রবীন্দ্রনাথ।
এখানে একটি মাত্র উপমেয়-আমি; উপমান-উপদ্রব, অভিশাপ, দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন এবং করলগ্ন কাঁটা।
আমি পিনাক পানির ডমরু, ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি চক্র মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড।–নজরুল ইসলাম।
এখানে একটি মাত্র উপমেয়-আমি; উপমান-ডমরু, ত্রিশূল, দণ্ড, চক্র, মহাশঙ্খ এবং প্রবণনাথ।

ঘ. অতিশয়োক্তি: আতিশয্যপূর্ণ বা সীমাতিরিক্ত কথা থেকে অতিশয়োক্তি কথাটি প্রচলন।তার অর্থ এখানে আতিশয্যপূর্ণ বা সীমাতিরিক্ত কিছু থাকবে। মোটকথা, কবি কল্পনায় যখন উপমান উপমেয়কে সম্পূর্ণরুপে গ্রাস করে উপমানের চরম প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয় এবং সাধারণ উপমেয় উল্লিখিত হয় না, তখন অতিশয়োক্তি অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়।যেমন:

বন থেকে এল এক টিয়ে মনোহর।

সোনার টোপর শোভে মাথার উপর।
এখানে উপমেয় ' আনারস'- অবিদ্যমান, 'সোনার টোপর-পরা টিয়ে'- উপমানের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
উৎপ্রক্ষায় উপমেয়কে উপমান বলে মনে হয়। আর অতিশয়োক্তিতে উপমানই উপমেয়কে সম্পূর্ণরুপে গ্রাস করে।
অপহ্নূতি: অপহ্নুতি [অপহ্নু (গোপন করা) + তি ভাববাচ্যে] বিশেষ্য, গোপন; অপলাপ; অস্বীকার। ২ বিশেষ্য, কাব্যের অর্থালঙ্কার বিশেষ denial. উপমেয়ের অপলাপ বা গোপন করিয়া উপমানের বিধান বা স্থাপন বা কোন গোপনীয় বিষয় স্বয়ং কোন প্রকারে প্রকাশ করিয়া পুনরায় প্রকারান্তরে তার গোপন করায় অপহ্নুতি অলঙ্কার হয়। যেমন:
চোখে চোখে কথা নয় গো বন্ধু, আগুনে আগুনে কথা।–অন্নদাশঙ্কর রায়।

এখানে উপমেয় চোখ-চোখ, উপমান-আগুন। চোখকে অস্বীকার করে আগুন প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই আগুনে আগুনে কথা।
প্রতিবস্তুপমা: প্রতিবস্তু+উপমা। বস্তুতে বস্তুতে একই সাধারণ ধর্ম যদি ভিন্ন ভাষায় (শব্দে) প্রকাশিত হয়ে বস্তুদ্বয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের বা সাম্যের ভাব সুষ্টি করে, তবে তাকে প্রতিবস্তুপমা বলে। যেমন:
         নানান দেশে নানান ভাষা,
বিনা স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?
কত নদী সরোবরে কিবা ফল চাতকীর?
ধারাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?

এখানে ‘নানান দেশে নানান ভাষা’ এবং ‘কত নদী সরোবরে’ আর ‘স্বদেশী ভাষা’ (মাতৃভাষা) ‘ধারাজল (বৃষ্টির জল) যথাক্রমে উপমেয়-উপমান। ‘আশা’ এবং‘তৃষা’-ভিন্ ভাষায়, স্বতন্ত্র বাক্যে কিন্তু তাৎপর্যে এক,-এজন্যে বস্তুপ্রতি-বস্তুভাবের সাধারণ ধর্ম। তুলনাবাচক শব্দ নেই।–অতএব প্রতিবস্তুপমা।

ঙ. ব্যতিরেক: যদি উপমানের চেয়ে উপমেয়কে উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট করে দেখানো হয়, তবে তাকে ব্যতিরেক অলঙ্কার বলে। যেমান:
কিমতে বোলিব ভাল মৃগাঙ্ক!
সকলঙ্ক চনিদ্রমা ললাট নিষ্কলঙ্ক।। --আলাওল।
এখানে উপমেয়-ললাট এবং উপমান-চন্দ্রিমা। চন্দ্র কলঙ্কযুক্ত কিন্তু ললাট কলঙ্ক চিহ্নহীন।

চ. নিদর্শনা: যে অলঙ্কারে দুটো বস্তুর যে ধরনের সম্পর্ক বোঝায় যা সাধারণ মানুষের পরিচিত নয় বলে বুঝতে অসুবিধা হয়; উপমেয়-উপমানভাব পরিস্ফুট করে, তাকে নিদর্শন বলে। যেমন:
মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবাল; ভুলি কমল কানন!-মধুসূদন।
এখানে কবি প্রথম জীবনে মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা করে বিদেশী ভাষাকে বরণ করলেও তিনি কমলকাননকে ভুলে শৈবালে খেলা করেন নি।

ছ. ভ্রান্তিমান: প্রবল সাদৃশ্যহেতু যখন এক বস্তুকে অন্য বস্তু বরে ভ্রম বা ভুল হয় এবং সে ভ্রান্তি নিতান্ত সাধারণ ভুল না হয়ে যদি কবি কল্পনায় মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে, তবে তাকে ভ্রান্তিমান অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. পদ পরশনে রেণু রক্তবর্ণ হয়।
    সিন্দুর বলিয়া কুল-রমণী পরয়।।--আলাওল।
এখানে নায়িকা পদ্মাবতী রাতুল চরণ-স্পর্শে পথের ধুলি রক্তবর্ণ হয়, এবং সে ধুলিকে সিন্দুর ভ্রমে কুল রমণীরা যখন সিঁথিতে ধারণ করেন, তখনই ভ্রান্তিমান অলঙ্কার। রক্তবর্ণ রেণুকে প্রবল সাদৃশ্যহেতু তাঁরা সিন্দুর বলে ভুল করেছেন।
২. রাই রাই কবি সঘনে জপয়ে হরি তুয়া ভাবে তরু দেই কোর।–গোবিন্দ দাস।
কৃষ্ণ রাধা ভেবে (ভ্রমে) তরুকে আলিঙ্গন করে।

জ. সমাসোক্তি: উপমেয়ের ওপর উপমানের সমানভাবে রূপ আরোপিত হলে তাকে সমাসোক্তি অরঙ্কার বলে। যেমন:

১. মৃদুপদে নিদ্রাদেবী আইলা কৈলাসে;
লভিল কৈলাস-বাসী কুসুম-শয়নে
বিরাম;                                    --মধুসূদন।
নিদ্রা বা ঘুমরে ওপর নারীর ব্যবহার আরোপ করা হয়েছে।
২. পবর্ত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ; --রবীন্দ্রনাথ।
এখানে নিশ্চল পবর্তে চলিষ্ণু মেঘের গতিময়তা আরোপিত।
৩. আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
  ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই, কিছু নাই!কাজী নজরুল ইসলাম।
নিষ্প্রাণ সানাই ব্যথাতুর প্রাণের আরোপ। 

ঝ. প্রতীপ: যদি উপমানই উপমেয় রূপে কল্পিত হয় কিংবা উপমেয় তার নিজের উৎকর্ষ বা শ্রেষ্ঠত্ব হেতু উপমানকে নিষ্প্রয়োজন বিধায় প্রত্যাখ্যান করে-তবে তাকে প্রতীপ অলঙ্কার বলে। যেমন:
মায়ের মুখের হাসির মত কমল-কলি উঠল ফুটে।–গোলাম মোস্তাফা।
এখানে উপমেয়-মায়ের মুখের হাসি; উপমান-কমল-কলি উঠল ফুটে। কমল-কলির হাসি না হয়ে হাসির মত কমল-কলি ফুটে উঠেছে।
সন্দেহ: কবি বর্ণনায় যদি উপমেয় এবং উপমান দুটোতেই সংশয় আরোপিত হয়-তবে তাকে সন্দেহ অলঙ্কার বলে। যেমন:
ও কি গান? ও কি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল
ও কি হুহুঙ্কার?         --নজরুল ইসলাম।

ঞ. দৃষ্টান্ত: উপমেয়ের যে ধর্ম, তার থেকে যদি উপমানের ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক হয় এবং এ দুয়ের মধ্যে থাকে কেবল ভাবগত সাদৃশ্য-তাও আবিষ্কার সাপেক্ষ তবে তাকে দৃষ্টন্ত অলঙ্কার বলে। যেমন:

স্রভাজন দুঃখী রাজদুঃখে।
আঁধার জগৎ, মরি ঘন আবরিলে
দিননাথ-   -- মধুসূদন।
এখানে উপমেয়-সভাজন, রাজা; উপমান-জগৎ, দিননাথ; সাধারন ধর্ম-দুঃখ এবং ঘন।
 নিশ্চয়: উপমানকে অস্বীকার করে যদি উপমেয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়-তবে তাকে নিশ্চয় অলঙ্কার বলে। যেমন:
কাঁপিছে এ পুরী
রক্ষোবীরপদভরে;-নহে ভূকম্পনে!মধুসূদন।
এখানে উপমান-নহে ভূকম্পনে অস্বীকার করে উপমেয়-রক্ষোবীরপদভরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
 তুল্যযোগিতা: যদি উপমেয় বা উপমান একই ধর্মের দ্বারা গ্রথিত হয়, তবে তাকে তুল্যযোগিতা অলঙ্কার বলে। যেমন:
সানে বান্ধা হিয়া মোর পাষানে বান্ধা প্রাণ।
এখানে উপমেয়-হিয়া ও প্রাণ বান্ধা পড়েছে এক ধর্ম দ্বারা।

ট. দীপক: যদি উপমেয় এবং উপমান দুটোকেই একই পদ বা ধর্মের দ্বারা যুক্ত করা হয়, তাহলে তাকে দীপক অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. তীরে উত্তরিল তরী, তারা উত্তরিলা।–ভারতচন্দ্র।
২. যুগে যুগে পূণ্য খোঁজ; পূণ্য আজি তোময় চায়।–সত্যেন্দ্রনাথ।
 উল্লেখ: একই বস্তুর নানাবিধ গুণ থাকার জন্যে যদি ব্যক্তিভেদে বিভিন্নবাবে বর্ণিত বা গৃহীত হয়, কিংবা একই ব্যক্তি তাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ভাবে গ্রহণ করেন-তবে তাকে উল্লেখ অলঙ্কার বলে। যেমন:
হে তন্বী, ভোগীর তুমি কামনার ধন,
তপস্বীর বিভীষিকা কবির স্বপন।–শ্যামাপদ চক্রবর্তী।
এখানে একই ‘তন্বী’ ব্যক্তিভেদে ভোগীর কামনার ধন, তপস্বীর বিভীষিকা এবং কবির স্বপন।

ঠ. সহোক্তি: উপমেয় কিংবা উপমানের যে কোনো একটিকে প্রাধান্য দিয়ে যদি সহার্থক শব্দের (সহ, সাথে, সনে, সহিত) বন্ধনে দুটোকে (উপমেয়-উপমান) বাঁধা হয়, তবে তাকে সহোক্তি অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. চলে নীলশাড়ী নিঙাড়ি নিঙাড়ি
পরাণ সহিতে মোর।–চণ্ডীদাস।
এখানে রাধা স্নান শেষ করে নীলশাড়ী নিঙড়াতে নিঙড়াতে যাচ্ছে তার প্রতিক্রিয়ায় কৃষ্ণের প্রানে মোচড় মারে।
২. বন্ধীরা গাহে না গান,
যমুনাকল্লোল-সাথে নববত মিলায় না তান।–রবীন্দ্রানাথ।
ড. অনন্বয়: উপমেয় এবং উপমান দুই বস্তু না হয়ে এক বস্তু হয় তখন যে অলঙ্কার হয়, তাকে অনন্বয় অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. অকিখল অতিছল অতীব কুটিল-
তুমিই তোমার মাত্র উপমা কেবল।
এখানে উপমেয় এবং উপমান একই বস্তু তুমি।
২. তার যাহা কিছু তাহারি মতন-একবার হলে গত,
এ ছায়া আরোকে আর পড়িবে না কায়াখানি তার মত।– মোহিতলাল মজুমদার।
এখানে উপমেয় এবং উপমান একই বস্তু তার। 

সামান্য: কোনো বৈশিষ্টের কিংবা গুণের সাদৃশ্য হেতু উপমেয় যদি উপমানের সাথে অভিন্নভাবে মিশে যায়, তবে তাকে সামান্য অলঙ্কার বলে। যেমন:

কালো জলে কালো তনু লখিতে না পারিগো,
ছুঁইয়া করিল জাতিনাশ। --কানুদাস।
এখানে উপমেয়- কালো তনু (কৃষ্ণের), উপমান-কালো জলে (যমুনার জলে) অভেদ মিশে গেছে বলে সামান্য অলঙ্কার।

তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।
02. বিরোধমূলক/বিরোধাভাস অলঙ্কার: যেখানে দুইটি বস্তুকে আপাত দৃষ্টিতে বিরোধী মনে হলেও তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেখা যায় এদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই, তাকে বিরোধাভাস অলঙ্কার বলে।যেমন:

   ১. ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে-
       ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে।--গোলাম মোস্তফা।
"শিশুদের অন্তরে " শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে,আপাতবিরোধী বক্তব্য।কিন্তু 'Child is the father of man' – এ সত্য বিরোধের অবসান।

২. হেলা করি চলি গেলা
    বীর।বাঁচিতাম, সে মুহূর্তে মরিতাম
    যদি                                    --রবীন্দ্রনাথ।
অর্জুন পুরুষবেশী-চিত্রাঙ্গদাকে উপেক্ষা করে চলে গেছে বন-অন্তরালে।রূপমুগ্ধা নারী (চিত্রাঙ্গদা) আহত হয়েছেন এ নীরব অবহেলায়।এখানে বাঁচিতাম"- নীরব উপেক্ষার অপমান থেকে মুক্তি পেতাম অর্থে গ্রহণ করলেই বিরোধের অবসান ঘটে।

৩. তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।--রবীন্দ্রনাথ।

ক. বিভাবনা: কারণের অভাবের জন্য কার্যভাবনাকে বিভাবনা বলে। সোজা কথায়, কারণ ছাড়া কোন কাজ হলেই বিভাবনা অলঙ্কার হয়। যেমন :
এলে জীবনের বিমূঢ় অন্ধকারে
ঘরে দীপ নেই তবু আলোকোজ্জ্বল
তোমার সৃষ্টায় দেখে নিই আপনারে।
এখানে কারণ ছাড়াই অন্ধকার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছ।

খ. বিশেষোক্তি : কারণ থাকা সত্ত্বেও কাজ না হলে বিশেষেক্তি অলঙ্কার হয়। কবিতার উৎকর্ষের জন্য এ রকম ভারের অবতারণা হয়। যেমন:
আছে চক্ষু, কিন্তু তার দেখা নাহি যায়।
আছে কর্ণ, কিন্তু তাহে শব্দ নাহি ধায়।–ঈশ্বরগুপ্ত।
এখানে চোখ থাকতেও দেখা য়ায় না, কান আছে কিন্তু শোনা যায় না।

শাশুড়ী ননদী নাহি নাহি তোর সতা।
কার সনে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কৈলি রাতা।।--মুকুন্দরাম।
এখানে ফুল্লরার ঘরে শাশুড়ী, ননদিনী কিংবা সতীন কেউ (কারণ) নেই, তবু তার চোখ রাতা কেন?

গ.বিষম : বিসদৃত বস্তুর বর্ণনাকে বিষম অলঙ্কার বলে, অবশ্য বর্ণনা চমৎকার হতে হয়। অন্যকথায়, কার্য ও কারণের মধ্যে যদি কোনো বৈষম্য দেখা যায়। কিংবা যেখানে কোনো আরদ্ধ বিষয়ের বিফলতা বোঝায়। তাহলেই বিষম অলঙ্কার হয়। যেমন:
১. যমুনার জলে যদি দেই গিয়া ঝাঁপ।
পরাণ জুড়াবে কি, অধিক উঠে তাপ।

২. সুখের লাগি এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।–চণ্ডীদাস।

ঘ. অসংগতি : কার্য ও কারণের স্থান যদি বিভিন্ন হয় অর্থাৎ এক যায়গায় কারণ ঘটে আর অন্য যায়গায় ফল দেখা যায়, তাহলে অসংগতি অলঙ্কার হয়। যেমন:
ওদের বনে ঝরে শ্রাবণ ধারা
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।
এখানে এক স্থানে শ্রাবণের ধারা অন্য স্থানে কদম ফুল ফুটে।

ঙ. অধিক: যদি আধার এবং আধেয় পরস্পরের যোগ্য না হয়, কিংবা সম্পূর্ণ অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তবে তাকে অধিক অলঙ্কার বলে। যেমন:
দেখিতে দেখিতে কবির অধরে
হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে,
মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে
ফাটিয়া বাহির হয়।–রবীন্দ্রনাথ।
এখানে আধার-কবির অধর এবং আধেয়-হাসি রাশি-আর কিছুতে না ধরে বা অযোগ্য।

চ. অন্যান্য: যদি দুটো বস্তু পরস্পর পরস্পরের কারণ হয়ে ওঠে তবে তাকে অন্যান্য অলঙ্কার বলে। যেমন:
সোনার হাতে সোনার চুড়ী
কে কার অলঙ্কার?
এখানে সোনার হাত এবং সোনার চুড়ী পরস্পর পরস্পরের কারণ হয়ে ওঠেছে।

ছ. অনুকূল: যদি প্রতিকূল বা বিপরীত বস্তু অনুকূল হয়ে উঠে, তবে তাকে অনুকূল অলঙ্কার বলে। যেমন:
অপরাধ করিয়াছি হুজুরে হাজির আছি
ভুজপাশে বাঁধি কর দণ্ড।–ভারতচন্দ্র।
নায়িকা অপরাধ করেছে তাই তার জেল হবে কারগারে কিন্তু  নায়ককে তার কোমল বাহুতে আবদ্ধ করতে বলেছে-তাই অনুকূল অলঙ্কার।
তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

অর্থালঙ্কার

০৩. শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার: অনেক সময় বাক্য এমনভাবে সংযোজিত হয়, যাতে এক বাক্যের একটি কাজ অন্য বাক্যের কারণ হয়, সেই কারণের কাজ আবার অন্য বাক্যের কারণ হয়। এই প্রেক্ষাপটে শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার তৈরি হয়। কারণমালা, একাবলী ও সার এই তিন প্রকার শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার রয়েছে। যেমন:
লোভে পাপ পাপে মৃত্যু শাস্ত্রের বচন।
অতএব কর সবে লোভ সন্বরণ।
এখানে ‘লোভ’ কার্যের কারণ ‘পাপ’; আবার ‘পাপ’ কার্যের কারণ মৃত্যু।

কারণমালা: কোনো কারণের কাজ যদি পরের বাক্যে কারণরূপে প্রতিভাত হয় এবং এ কারণের কাজ আবার তার পরের বাক্যের কারণ হয়ে ওঠে তবে কারণমালা অলঙ্কার হয়। যেমন:
ক. লোভে পাপ পাপে মৃত্যু শাস্ত্রের বচন।
    অতএব কর সবে লোভ সন্বরণ।
এখানে ‘লোভ’ কার্যের কারণ ‘পাপ’; আবার ‘পাপ’ কার্যের কারণ মৃত্যু।

খ. থাকিলে বিজ্ঞের কাছে হয় বিদ্যালয়।
    বিদ্যা থেকে হয় অর্থ, অর্থে হয় বশ
   অর্থ হতে কিনা হয়? পৃথিবী ও বশ!
এখানে ‘বিদ্যা’ কার্যের কারণ ‘বিদ্যালয়’; আবার ‘বিদ্যা’ কার্যের কারণ ‘অর্থ’ আবার ‘অর্থ’ হয় ‘পৃথিবী’ বশ।

একাবলী: এই শৃঙ্খলাক্রমে যখন একটি বাক্যের বিশেষ্যপদ তার আগের বিশেষণ রূপে বসে, তখন একাবলী অলঙ্কার হয়। যেমন:


ক. সুনীল আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাস, বিমল নদীর জল
   গাছে গাছে ফুল, ভুলে ভুলে অলি সুন্দর ধরাতল।–যতীন্দ্রমোহন।
এখানে গাছ, ফুল এবং অলি! পূর্ববর্তী বিশেষ্য গাছ, পরবর্তী ফুলের বিশেষণ আবার এই ফুলই পরবর্তী পদ অলির বিশেষণ।

সার: আগে উল্লিখিত পদার্থের চেয়ে যদি পরের বর্ণিত পদার্থের উৎকর্ষ বোঝানো হয়, তবে সার অলঙ্কার হয়। যেমন:
নিজের সে বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার
সন্তান নহে গো মাতা: সম্পত্তি তোমার।
এখানে নিজের তারপর বিশ্বের; তারপর বিশ্বদেবতার এভাবে উত্তর উত্তর উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

অর্থালঙ্কার

০৪. ন্যায়মূলক অলঙ্কার: বক্তব্যের মধ্যে ন্যায়বাচক থাকলে এবং উক্তির ধারা বক্তব্যকে জোরালো করলে ন্যায়মূলক অলঙ্কার হয়। যেমন:
চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিয়ে সে কিছে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
এখানে চিরসুখী ভোলে না আবার ব্যথিত জনই কেবল বেদনা বুঝতে পারে।

অর্থ ন্যায়মূল অলঙ্কার দুই প্রকার: অর্থান্তরন্যাস ও কাব্যলিঙ্গ।

অর্থান্তরন্যাস: সামান্যের দ্বারা বিশেষ অথবা বিশেষের দ্বারা সামান্য যখন সমন্বিত হয় এবং কাজের দ্বারা কারণ অথবা কারণের দ্বারা যখন কাজ সমর্থিত হয়, তখন অর্থান্তরন্যাস অলঙ্কার হয়। যেমন-
চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিয়ে সে কিছে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
এখানে চিরসুখী ভোলে না আবার ব্যথিত জনই কেবল বেদনা বুঝতে পারে।

কাব্যলিঙ্গ: যখন কোন পদের অথবা বাক্যের অর্থ ব্যঞ্জনার দ্বারা বর্ণনীয় বিষয়ের কারণ বলে মনে হবে, তখন কাব্যলিঙ্গ অলঙ্কার হয়। যেমন: নির্ভর হৃদয়ে কহ, হনুমান আমি রঘুদাস, দয়াসিন্ধু রঘুকুলনিধি।
এখানে নির্ভর হৃদয় কারণ রঘুদাস-দয়াসিন্ধু।

ন্যায়মূলক অলঙ্কার: বক্তব্যের মধ্যে ন্যায়বাচক থাকলে এবং উক্তির ধারা বক্তব্যকে জোরালো করলে ন্যায়মূলক অলঙ্কার হয়। অর্থ ন্যায়মূল অলঙ্কারের প্রকার: অর্থান্তরন্যাস, কাব্যলিঙ্গ, অনুমান, পরিবৃত্তি বা বিনিময়, পর্যায় ও সমুচ্চয়।

অর্থান্তরন্যাস: সামান্যের দ্বারা বিশেষ অথবা বিশেষের দ্বারা সামান্য যখন সমন্বিত হয় এবং কাজের দ্বারা কারণ অথবা কারণের দ্বারা যখন কাজ সমর্থিত হয়, তখন অর্থান্তরন্যাস অলঙ্কার হয়। যেমন-
চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিয়ে সে কিছে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।

কাব্যলিঙ্গ: যখন কোন পদের অথবা বাক্যের অর্থ ব্যঞ্জনার দ্বারা বর্ণনীয় বিষয়ের কারণ বলে মনে হবে, তখন কাব্যলিঙ্গ অলঙ্কার হয়। যেমন- নির্ভর হৃদয়ে কহ, হনুমান আমি রঘুদাস, দয়াসিন্ধু রঘুকুলনিধি।

অনুমান: কারণের দ্বারা যখন জ্ঞানের উদয় হয়, তাকে অনুমান অলঙ্কার বলে। যেমন:
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
সেনএহর সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।--রবীন্দ্রনাথ।
এখানে পাকা দুটি বাতাসে মাটিতে পড়ায় উপেন ভেবেছে মাতা তাকে চিনতে পেরেছে।

পরিবৃত্তি বা বিনিময়: যেখানে দুই বস্তুর বিনিময় কবি-কল্পনায় চমৎকৃতি লাভ হয় সেখানে পরিবৃত্তি বা বিনিময় অলঙ্কার হয়। যেমন:
মানুষ কাউকে চায়-তার সেই নিহিত উজ্জ্বল,
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।–জীবনানন্দ দাশ।

পর্যায়: যদি একই বস্তু একই সময়ে বহু স্থানে পতিত হয়, তবে তাকে পর্যায় অলঙ্কার বল। যেমন:

অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মহামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে; তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্নরৌদ্র-ললাটে, অধরে,
উরু-পরে কটিতটে, স্তনাগ্র চূড়ায়,
বাহুযুগে, সিক্তদেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে।                      --রবীন্দ্রনাথ।

 সমুচ্চয়: যেখানে কোনো একটি বিষয়ের জন্য একটি কারণ যথেষ্ট হলেও একাধিক কারণের সমাবেশ ঘটানো হয়, সেখানে সমুচ্চয় অলঙ্কার হয়। যেমন:
প্রিয় তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ,
রুধিল না সমুদ্র পর্বত।–রবীন্দ্রনাথ।

এখানে ‘প্রিয় তারে রাখিল না’ কারণ যথেষ্ট কিন্তু সেখানে রাজ্য পথ ছেড়ে দিল; সমুদ্র-পর্বত প্রতিরোধ সৃষ্টি করল না।

তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

অর্থালঙ্কার

০৫. গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক অলঙ্কার:  অর্থান্তরন্যাস , অপ্রস্তুতশংসাআক্ষেপউদাত্তব্যাজস্তুতিব্যাজোক্তি,  পর্যায়োক্তপরিকরভাবিক
স্বভাবোক্তিসূক্ষ।







তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

Sunday, July 5, 2020

শব্দালঙ্কার

# অলঙ্কার কাকে বলে? শব্দালঙ্কারের শ্রেণিবিভাগ উদাহরনসহ আলোচনা কর।

অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ আভরণ, ভূষণ অর্থাৎ যা দিয়ে শরীরকে সজ্জিত বা ভূষিত করা যায়। সুতরাং নিরাভরণ দেহকে যেমন হার, দুল, বলয়, কাঁকন ইত্যাদি আভরণে মনের মতো সাজানো যায়, তেমনি কাব্য শরীরকেও কবিগণ বিভিন্ন অলঙ্কার দিয়ে ভূষিত করেন।

হার, দুল, বলয় এসব অলঙ্কার নারীদেহে যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তেমনি কাব্যক্ষেত্রে অলঙ্কার মানে সৌন্দর্য।

খ্রীঃ সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে ভামহ, বামন প্রমুখ সাহিত্যাচার্য মনে করতেন, অলঙ্কারের গুনেই শুধু কাব্য গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। অবশ্য তারা পরে বলে গেছেন যে, সৌন্দর্যই অলঙ্কার।

আচার্য দন্ডী বলেছেন, কাব্যের শোভাকর তথা সৌন্দর্যবিধায়ক ধর্মকে বলা হয় অলঙ্কার।

সুধীরকুমার দাশগুপ্ত বলেছেন, “অলঙ্কারশাস্ত্র এর প্রকৃত অর্থ সৌন্দর্যশাস্ত্র বা কাব্য সৌন্দর্যবিজ্ঞান, ইংরেজিতে যাহাকে বলা যাইতে পারে Aesthetic of poetry”.

ইংরেজিতে Alexander bain বলেছেন, “A figure of speech is a deviation from the plain & ordinary mood of speaking, with a view to greater effect”
এখানেও শব্দের সাধারণ অর্থ-অতিক্রামক সেই বৈচিত্র এবং সৌন্দর্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

Beautifying Instrument.অর্থাৎ কাব্যের শোভাবর্ধন করা তথা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাই অলঙ্কারের ধর্ম।

যে কোন সুন্দর পরিমিতি মানতে বাধ্য এবং অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলা সবসময়ই সৌন্দর্য বিরোধী। অঙ্গদকে কেউ পায়ের মল হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি হবে না কারন তা অনিয়ম। তেমনি কাব্যেও যথেচ্ছ অলঙ্কার চাপিয়ে দিলেই হয় না, বিচার করতে হবে সেটা নিয়মমাফিক কিনা, প্রয়োগসিদ্ধ কিনা।

শব্দ ধ্বনিকে শ্রুতিমধুর এবং অর্থকে মনোহর আর হৃদয়গ্রাহী করার জন্যে অলঙ্কারকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে- অ) শব্দালঙ্কার আ) অর্থালঙ্কার।

শব্দালঙ্কার: অর্থবহ ধ্বনি সমষ্টিকে বলা হয় শব্দ। শব্দ বা ধ্বনিই শব্দালঙ্কারের নিয়ন্তা। অর্থাৎ যে অলঙ্কার ধ্বনির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং শ্রুতিসৌন্দর্য বিধায়ক তাকেই শব্দালঙ্কার বলা হয়।

শব্দালঙ্কারগুলো হচ্ছে:
১. অনুপ্রাস
২. যমক
৩. শ্লেষ
৪. বক্রোক্তি
৫. পুনরুক্তবদাভাস

০১. অনুপ্রাস: ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যদি যুক্ত বা বিযুক্তভাবে বাক্যমধ্যে একাধিকবার ধ্বনিত হয় তবে তাকে অনুপ্রাস বলে। যেমন:

   কান্তা ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন রিল।–বিদ্যাসাগর।
   --‘ক’ পাঁচবার আবৃত্ত।
  গুরু গুরু র্জন- গুগুন স্বর।--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 ‘গ’ পাঁচবার আবৃত্ত।

অনুপ্রাসের প্রকারের অনুপ্রাস দেখা যায়। যেমন:
ক. অন্ত্যানুপ্রাস;
খ. বৃত্তানুপ্রাস;
গ. ছেকানুপ্রাস;
ঘ. শ্রুত্যনুপ্রাস;
ঙ. আদ্যানুপ্রাস।

ক. অন্ত্যানুপ্রাস: কবিতার পাদান্তের সাথে এবং চরণের শেষের শব্দটির সাথে পরবর্তী চরনের শেষ শব্দটির ধ্বনিসাম্য থাকলে তাকে অন্ত্যানুপ্রাস বলে। যেমন:

১. সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের লেন-দেন
    থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বলনতা সেন। --জীবনানন্দ দাশ।

২. আমার অঙ্গন আঁধারে হল বন,
    নিয়েছি বুক পেতে জলের দংশন। --শামসুর রহমান।

৩. নাকি, তুমি অজানিতে ভ’রে দাও ডালি?
    নাকি, তুমি সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি।–বিষ্ণু দে।

খ. বৃত্তানুপ্রাস: একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্তভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে বৃত্তানুপ্রাস সৃষ্টি হয়। যেমন:
এটি চারধরনের হতে পারে
১. একটি মাত্র ব্যঞ্জনের দুবার ধ্বনিত হওয়া-
   ধ্বংশান্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না। --রফিক আজাদ।
এখানে ‘শ’ দ দুবার করে আবৃত্ত।

২. একটিমাত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বহুবার ধ্বনিত হলে
বাঙালি কৌমের কেলি ল্লোলিত লাবতী --আল মাহমুদ।
এখানে ক ধ্বনি পাঁচবার ধ্বনিত হয়েছে।

৩. ব্যঞ্জনগুচ্ছ স্বরূপানুসারে মাত্র দুবার ধ্বনিত হলে
ফুটেছে যৌবন বনে আনন্দের ফুল
জেগেছে যৌবন নব বসুধার দেহে --শ্যামাপদ চক্রবর্তী।
বর্ণগুলোর (যৌবন বনে এবং যৌবন নব) ক্রম অক্ষুন্ন এবং ধ্বনিসাদৃশ্য বর্তমান।

৪. যুক্ত বা বিযুক্তভাবে ব্যঞ্জনগুচ্ছ ক্রমানুসারে বহুবার ধ্বনিত হলে
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথ- প্রান্তে ফেলে যেতে হয়। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখানে যুক্ত ‘ন্ত’ ক্রমানুসারে তিনবার ধ্বনিত হয়েছে।

৫. কাক কালো কোকিকালো কালো ন্যার কেশ।
  ‘ক’ নয় বার ধ্বনিত হয়েছে।

গ. ছেকানুপ্রাস: দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত অবস্থায় ক্রমানুসারে যদি মাত্র দুবার ধ্বনিত হয় তবে তাকে ছেকানুপ্রাস বলে। যেমন:
১. অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? --সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
২. ভুরুর ভঙ্গিমা হেরি ভুজঙ্গ সকল।–আলাওল।
৩. লঙ্কার পঙ্কজ রবি যাবে অস্তাচলে।–মধুসূদন।
৪. কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে।–রবীন্দ্রনাথ।

ঘ. শ্রুত্যনুপ্রাস: বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে যে সকল ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলো একই ধ্বনি হলেও সদৃশ ধ্বনি; সেই সদৃশ ধ্বনির সাম্যে জাত অনুপ্রাসকে শ্রুত্যনুপ্রাস বলে। যেমন:
১.ক-খ:
বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে
ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে।--রবীন্দ্রনাথা ঠাকুর।
এখানে লক্ষ্য করুন প্রথম চরনের শেষে ‘ক’ ধ্বনি আছে আবার দ্বিতীয় চরনের শেষে ‘খ’ ধ্বনি আছে। এটাই শ্রুত্যনুপ্রাস।
২. গ-ঘ:
উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে
উন্মাদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে।--কাজী নজরুল ইসলাম।
এখানে লক্ষ্য করুন প্রথম চরনের শেষে ‘ঘ’ ধ্বনি আছে আবার দ্বিতীয় চরনের শেষে ‘গ’ ধ্বনি আছে। তাই গ-ঘ যেমন হতে পারে তেমনি ঘ-গ হতে পারে।
এরকম আরো হতে পারে যেমন, চ-ছ, ট-ঠ, ত-থ, দ-ধ, র-ড় ইত্যাদি।

আরো কিছু অনুপ্রাস আছে বলে মনে করা হয়। সেগুলো দেওয়া হল।

ঙ. আদ্যানুপ্রাস: কবিতার আদান্তের সাথে এবং চরণের প্রথম শব্দটির সাথে পরবর্তী চরনের প্রথম শব্দটির ধ্বনিসাম্য থাকলে তাকে আদ্যানুপ্রাস বলে। যেমন:

১. যতবার লেখা শুরু করি
   ততবার ধরা পড়ে, এ খবর সহজ তো নয়।--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখানে প্রথম চরণের প্রথম শব্দ যতবার এর সাথে পরবর্তী চরণের প্রথম শব্দ ততবার এর সাথে মিল আছে।
২. পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে
    শাখা আবার চায় কি তাহার পানে?--রবীন্দ্রনাথ।

চ. মধ্যানুপ্রাস: সাধারণত কবিতার চরণের মধ্যে ধ্বনিসাম্য থাকলে তাকে মধ্যানুপ্রাস বলা হয়।যেমন:

১. চুল তা কবেকা অন্ধকা বিদিশা নিশা।--জীবনানন্দ দাশ।
এখানে ‘র’ ধ্বনি কয়েকবার উচ্চারিত হয়েছে।

০২. যমক: একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনিসহ নির্দিষ্টক্রমে সার্থক কিংবা নিরর্থকভাবে যদি একাধিকবার উচ্চারিত হয় তাকে যমক অলঙ্কার বলে।যেমন:

১. ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে। --ভারতচন্দ্র।
এখানে ভারত শব্দটি দুইবার উচ্চারিত।
২. কীর্তিবাস কীর্তিবাস কবি
এ বঙ্গের আলঙ্কার। --মধুসূদন।
এখানে কীর্তিবাস শব্দটি দুইবার উচ্চারিত।

প্রচলিত অলঙ্কারসমূহে চার রমক যমক আছে। আদ্য, মধ্য, অন্ত্য, এবং সর্বযমক

# আদ্যযমক: চরণের আদিতে এ যমক ঘটে। যেমন:
১. ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে। --ভারতচন্দ্র।
   এখানে ভারত শব্দটি দুইবার উচ্চারিত।

২. মৌ-লোভী যত মৌলভী আর মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে। --কাজী নজরুল ইসলাম।

# মধ্যযমক: চরণের মধ্যভাগে এ যমক ঘটে। যেমন:

১. তোমার এ বিধি, বিধি, কে পারে বুঝিতে। --মধুসূদন।
২. দুরুহ বিরহকাল কাল যেন দেখি সমুখে! --মধুসূদন।

# অন্ত্যযমক: চরণের শেষে এ যমক ঘটে। যেমন:

১. তখন একটি কবিতা তো নয়,
যখন রক্তে আকুল বিনয়। --সৈয়দ আলী আহসান।

২. কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ
    বসি একাকিনী বাতায়ন পাশ।--রবীন্দ্রনাথ।

# সর্বযমক: অনেক সময় বহুর্থক শব্দযোগে বহুবিধ অর্থেও যমক অলঙ্কারে প্রয়োগ দেখা যায়।যেমন:

কুসুমের বাস ছাড়ে কুসুমের বাস,
বায়ু ভরে করে এসে নাসিকায় বাস।
(বাস-আশ্রয়, গন্ধ, বসতি)

০৩. শ্লেষ: একটি শব্দ বাক্যে একবার ব্যবহৃত হলেও যদি তার একাধিক অর্থ বর্তমান থাকে এবং শ্রোতা বা পাঠক উভয় অর্থই গ্রহণ করেন তখন শ্লেষ অলঙ্কার হয়। যেমন:

শ্লেষ দু প্রকার: সভঙ্গ ও অভঙ্গ শ্লেষ।

# সভঙ্গ শ্লেষ: শব্দটি অটুট থাকলে এক অর্থ এবং শব্দটি ভাঙ্গলে যদি ভিন্ন অর্থ দ্যোতিত হয় তবে তাকে সভঙ্গ শ্লেষ বলে।
যেমন:
অর্ধেক বয়স রাজা, এক পাটারাণী।
পাঁচপুত্র নৃপতির, সবে যুব জানি।।

যুবজানি- এক অর্থে, সকলকেই যুবক বলে জানি। অপর অর্থে- সকলেরই যুবতী স্ত্রী। যুবজানি শব্দের বিশ্লেষণে-যুবতী জায়া যার।

# অভঙ্গ শ্লেষ: এখানে শব্দকে না ভেঙ্গেই একাধিক অর্থ পরিস্ফুট হয়। যেমন:

মধুহীন কর না গো তব মন কোকনদে

এক অর্থে মনরূপ পদ্মকে মধুহীন করো না, অপর অর্থে মধুসূদন দত্তকে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না।

০৪. বক্রোক্তি: বক্তা বা প্রশ্নকারী যদি কোনো কথাকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন অথচ শ্রোতা বা উত্তরদাতা সে অর্থ গ্রহন না করে কথাটিকে ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করেন কিংবা সে অনু্সারে উত্তর দেন, তবে সেখানে বক্রোক্তি অলঙ্কার হয়। যেমন:

বক্রোক্তি দুপ্রকার- শ্লেষ ও কাকু বক্রোক্তি।

# শ্লেষ বক্রোক্তি: একটি শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় বলে একে বলা হয় শ্লেষ বক্রোক্তি। যেমন:

আপনার ভাগ্যে রাজানুগ্রহ আছে
-তিন মাস জেল খেটেছি; আর কতদিন খাটব?
-রাজানুগ্রহ যে অর্থে বক্তা প্রয়োগ করেছেন-উত্তরদাতা সে অর্থে না ধরে জেলখাটা অর্থ ধরে উত্তর দিলেন।

# কাকু বক্রোক্তি: এখানে বক্তার কণ্ঠস্বরের ভঙ্গিতে অর্থের পরিবর্তন ঘটে যায়; সাধারণতঃ বিধি নিষেধে এবং নিষেধ বিধিরূপে গৃহীত হয়। যেমন:

কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ?
-অর্থাৎ কেউ পদ্মের পর্ণ ছেঁড়ে না।

০৫. পুনরুক্তবদাভাস: আপাতদৃষ্টিতে কোনো বাক্যে যদি মনে হয় একই অর্থে একাধিক শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে অথচ একটু মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, তারা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত তাহলে পুনরুক্তবদাভাস হয়। যেমন:

তনু দেহে রক্তাম্বর নীবীবন্ধে বাঁধা
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।
তনু ও দেহ দুয়ের অর্থই এক, কিন্তু এখানে তনু ছিপছিপে অর্থে ব্যবহৃত।



তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।