বাঁশি
বেতন পঁচিশ
টাকা, ধলেশ্বরী-নদীতীরে
পিসিদের গ্রাম--- বর্ষা ঘনঘোর। গলির মোড়েই
থাকে কান্তবাবু--- এ গান যেখানে
সত্য |
অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী পরীক্ষা, রচনামূলক অংশের সকল বিষয়, সৃজনশীল প্রশ্ন, শিক্ষা, সাহিত্য, কবিতা ও স্বাস্থ্যবিধি
চলমান কথা
Showing posts with label কবিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর. Show all posts
Showing posts with label কবিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর. Show all posts
Tuesday, December 29, 2020
Friday, July 24, 2020
এইক্ষণে
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---বলাকা
এইক্ষণে
মোর
হৃদয়ের প্রান্তে আমার নয়ন-বাতায়নে
যে-তুমি রয়েছ চেয়ে প্রভাত-আলোতে
সে-তোমার
দৃষ্টি যেন নানা দিন নানা রাত্রি হতে
রহিয়া রহিয়া
চিত্তে মোর আনিছে বহিয়া
নীলিমার অপার সংগীত,
নিঃশব্দের উদার ইঙ্গিত।
আজি মনে হয় বারে বারে
যে মোর স্মরণের দূর পরপারে
দেখিয়াছ কত দেখা
কত
যুগে, কত লোকে, কত জনতায়, কত একা।
সেই-সব
দেখা আজি শিহরিছে দিকে দিকে
ঘাসে ঘাসে নিমিখে নিমিখে,
বেণুবনে
ঝিলিমিলি পাতার ঝলক-ঝিকিমিকে।
কত নব নব অবগুণ্ঠনের তলে
দেখিয়াছ কত ছলে
চুপে চুপে
এক প্রেয়সীর মুখ কত রূপে রূপে
জন্মে
জন্মে, নামহারা নক্ষত্রের গোধূলি-লগনে।
তাই আজি নিখিল গগনে
অনাদি মিলন তব অনন্ত বিরহ
এক পূর্ণ বেদনায় ঝংকারি উঠিছে অহরহ।
তাই যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়
যাহা দেখিছ না তারি ভিড়।
তাই আজি দক্ষিণ পবনে
ফাল্গুনের
ফুলগন্ধে ভরিয়া উঠিছে বনে বনে
ব্যাপ্ত ব্যাকুলতা,
বহুশত
জনমের চোখে-চোখে কানে-কানে কথা।
শিলাইদা, ৭ ফাল্গুন, ১৩২২
যৌবন
রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---বলাকা
যৌবন
রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে।
তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের 'পরে
পুচ্ছ নাচাতে।
তুই পথহীন সাগরপারের পান্থ,
তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,
অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে
অবাধ যে তোর ধাওয়া;
ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে
তোর যে দাবিদাওয়া।
যৌবন
রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী।
মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে
তুই যে শিকারি।
মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে
অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;
বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া
মরণ-ঘোমটা টানি।
সেই আবরণ দেখ্ রে উতারিয়া
মুগ্ধ সে মুখখানি।
যৌবন
রে, রয়েছ কোন্ তানের সাধনে।
তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা
পুঁথির বাঁধনে।
তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়
অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,
তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে
ঝড়ের ঝংকারে;
ঢেউয়ের 'পরে বাজিয়ে চলে বেগে
বিজয়-ডঙ্কা রে।
যৌবন
রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে।
বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে
হবে খণ্ডিতে।
খড়গসম তোমার দীপ্ত শিখা
ছিন্ন করুক জরার কুজ্ঝটিকা,
জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক ক'রে
অমর পুষ্প তব
আলোকপানে লোকে লোকান্তরে
ফুটুক নিত্য নব।
যৌবন
রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত।
আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে
রইবি কুণ্ঠিত?
প্রভাত যে তার সোনার মুকুটখানি
তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,
আগুন আছে ঊর্ধ্ব শিখা জ্বেলে
তোমার সে যে কবি।
সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে
দেখে আপন ছবি।
শান্তিনিকেতন,
৪ চৈত্র, ১৩২২
Tuesday, July 21, 2020
সোনার তরী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা
ভারা
ধান কাটা হল
সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি
আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে
ঢাকা
প্রভাতবেলা--
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে
যায়,
কোনো দিকে নাহি
চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে--
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে
চাও,
যারে খুশি তারে
দাও,
শুধু তুমি নিয়ে
যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-'পরে।
আর আছে?-- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু
ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে--
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে
ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি--
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
ফাল্গুন ১২৯৮ শিলাইদহ। বোট
যেতে নাহি দিব
সে কথায় কর্ণপাত
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
চারি দিক হতে আজি
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের
ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ
বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ
নিঃঝুম--
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।
গিয়েছে আশ্বিন-- পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত
হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে।
ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয়
মনে
যত বাড়ে বোঝা। আমি বলি, "এ
কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের
বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে
যাই
কিছু লই সাথে।'
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন। "কী জানি
দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান;
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল;
আমসত্ত্ব আমচুর; সের দুই দুধ--
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে
করে।'
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
তাকানু ঘড়ির পানে, তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে; কহিলাম ধীরে,
"তবে আসি'। অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু-'পরে বস্ত্রাঞ্চল
টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন।
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের। এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার। এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন। শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি
কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল। কহিনু যখন
"মা গো, আসি' সে কহিল বিষণ্ণ-নয়ন
ম্লান মুখে, "যেতে আমি দিব
না তোমায়।'
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায়,
ধরিল না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল--"যেতে আমি দিব না
তোমায়'।
তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়
যেতে দিতে হল।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা, এত স্পর্ধাভরে--
"যেতে আমি দিব না তোমায়'?
চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনী, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র
দেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ।
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা
সাজে
এ জগতে, শুধু বলে রাখা "যেতে
দিতে
ইচ্ছা নাহি'। হেন কথা কে পারে বলিতে
"যেতে নাহি দিব'! শুনি তোর
শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববাণী, সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে,
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ'রে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন,
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন।
চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে। তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে, চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে। বহে খরবেগ
শরতের ভরা গঙ্গা। শুভ্র খণ্ডমেঘ
মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে। দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
"যেতে আমি দিব না তোমায়'।
ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
"যেতে নাহি দিব। যেতে নাহি
দিব।' সবে
কহে "যেতে নাহি দিব'। তৃণ
ক্ষুদ্র অতি
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে "যেতে নাহি
দিব'।
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,
আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
কহিতেছে শত বার "যেতে দিব
না রে'।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন--"যেতে নাহি
দিব'। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
"দিব না দিব না যেতে' ডাকিতে
ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
"দিব না দিব না যেতে'-- নাহি
শুনে কেউ
নাহি কোনো সাড়া।
চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে; শিশুর মতন
বিশ্বের অবোধ বাণী। চিরকাল ধরে
যাহা পায় তাই সে হারায়, তবু তো
রে
শিথিল হল না মুষ্টি, তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে
ডাকি
"যেতে নাহি দিব'। ম্লান মুখ,
অশ্রু-আঁখি,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে
কয়
"যেতে নাহি দিব'। যত বার পরাজয়
তত বার কহে, "আমি ভালোবাসি
যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
আমার আকাঙক্ষা-সম এমন আকুল,
এমন সকল-বাড়া, এমন অকূল,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর!'
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
"যেতে নাহি দিব'। তখনি দেখিতে
পায়,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন,
ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির। তবু প্রেম বলে,
"সত্যভঙ্গ হবে না বিধির। আমি
তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকার-লিপি।'-- তাই স্ফীত
বুকে
সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
বলে, "মৃত্যু তুমি নাই।--
হেন গর্বকথা!
মৃত্যু হাসে বসি। মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার, বিষণ্ণ নয়ন-'পরে
অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
চির-কম্পমান। আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময়। আজি যেন পড়িছে নয়নে--
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে,
স্তব্ধ সকাতর। চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া--
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে
মায়া।
তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
এত ব্যাকুলতা; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা
করে
শুষ্ক পত্র লয়ে; বেলা ধীরে যায়
চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে; শুনিয়া
উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর
কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি
বাণী।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন, স্তব্ধ
মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।
জোড়াসাঁকো, ১৪ কার্তিক, ১২৯৯
মানসসুন্দরী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী
আজ
কোনো কাজ নয়-- সব ফেলে দিয়ে
ছন্দ
বন্ধ গ্রন্থ গীত-- এসো তুমি প্রিয়ে,
আজন্ম-সাধন-ধন
সুন্দরী আমার
কবিতা,
কল্পনালতা। শুধু একবার
কাছে
বোসো। আজ শুধু কূজন গুঞ্জন
তোমাতে
আমাতে; শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এই
সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা--
যতক্ষণ
অন্তরের শিরা-উপশিরা
লাবণ্যপ্রবাহভরে
ভরি নাহি উঠে,
যতক্ষণে
মহানন্দে নাহি যায় টুটে
চেতনাবেদনাবন্ধ,
ভুলে যাই সব--
কী
আশা মেটে নি প্রাণে, কী সংগীতরব
গিয়েছে
নীরব হয়ে, কী আনন্দসুধা
অধরের
প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না
মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি,
এই
মধুরতা, দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের
দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির 'পর
করুণকোমল
আভা গভীর সুন্দর।
বীণা
ফেলে দিয়ে এসো, মানসসুন্দরী--
দুটি
রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে
জড়াইয়া দাও-- মৃণাল-পরশে
রোমাঞ্চ
অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে,
কম্পিত
চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধ
তনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের
সীমান্ত-প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি
ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে।
অর্ধেক
অঞ্চল পাতি বসাও যতনে
পার্শ্বে
তব; সমধুর প্রিয়সম্বোধনে
ডাকো
মোরে, বলো, প্রিয়, বলো, "প্রিয়তম'--
কুন্তল-আকুল
মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের
কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সংগোপনে
বলে যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা
ভাবে-ভরা ভাষা। অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন
মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো
না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,
উজ্জ্বল
রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো
ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ
চুম্বন এক, হাসি স্তরে স্তরে
সরস
সুন্দর; নবষ্ফুট পুষ্প-সম
হেলায়ে
বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি
তুলে ধোরো; আনন্দ-আভায়
বড়ো
বড়ো দুটি চক্ষু পল্লবপ্রচ্ছায়
রেখো
মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত
নির্ভরে। যদি চোখে জল আসে
কাঁদিব
দুজনে; যদি ললিত কপোলে
মৃদু
হাসি ভাসি উঠে, বসি মোর কোলে,
বক্ষ
বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়ো
নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি।
যদি
কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে
বলে
যেয়ো কথা, তরল আনন্দভরে
নির্ঝরের
মতো, অর্ধেক রজনী ধরি
কত-না
কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী--
মধুমাখা
কণ্ঠের কাকলি। যদি গান
ভালো
লাগে, গেয়ো গান। যদি মুগ্ধপ্রাণ
নিঃশব্দ
নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া
থাকিতে চাও, তাই রব প্রিয়া।
হেরিব
অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে
শ্রান্ত
রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া
তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে
আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের
পাতার মতো; সন্ধ্যাতারা ধীরে
সন্তর্পণে
করে পদার্পণ, নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে;
যামিনী শয়ন তার
দেয়
বিছাইয়া, একখানি অন্ধকার
অনন্ত
ভুবনে। দোঁহে মোরা রব চাহি
অপার
তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি,
শুধু
মোর করে তব করতলখানি,
শুধু
অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী,
অসীম
নির্জনে; বিষণ্ণ বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে
আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি--
শুধু
এক প্রান্তে তার প্রলয় মগন
বাকি
আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি
হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি
বক্ষ
দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি
শুধু
একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি
অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা।
আজিকে
এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্য-বিলাসে।
অয়ি নিরভিমানিনী,
অয়ি
মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর
ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্যের শশী,
মনে
আছে কবে কোন্ ফুল্ল যূথীবনে,
বহু
বাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে
আধো-চেনাশোনা?
তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর
মেয়ে, ধরার অস্থির
এক
বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে
সখী,
আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে
নবীন
বালিকামূর্তি, শুভ্রবস্ত্র পরি
উষার
কিরণধারে সদ্য স্নান করি
বিকচ
কুসুম-সম ফুল্ল মুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে
দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি
উপবনে
কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশব-কর্তব্য
হতে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে
দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি,
দেখায়ে
গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা-কারা
হতে; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে
যেতে নির্জনেতে রহস্যভবনে;
জনশূন্য
গৃহছাদে আকাশের তলে
কী
করিতে খেলা, কী বিচিত্র কথা ব'লে
ভুলাতে
আমারে, স্বপ্ন-সম চমৎকার
অর্থহীন,
সত্য মিথ্যা তুমি জান তার।
দুটি
কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে
সোনার
বলয়, দুটি কপোলের 'পরে
খেলিত
অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত
আলোক, নির্মল নির্ঝর-স্রোতে
চূর্ণরশ্মি-সম।
দোঁহে দোঁহা ভালো করে
চিনিবার
আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধুলা
ছুটাছুটি দুজনে সতত--
কথাবার্তা
বেশবাস বিথান বিতত।
তার
পরে একদিন-- কী জানি সে কবে--
জীবনের
বনে যৌবনবসন্তে যবে
প্রথম
মলয়বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস,
মুকুলিয়া
উঠিতেছে শত নব আশ,
সহসা
চকিত হয়ে আপন সংগীতে
চমকিয়া
হেরিলাম-- খেলা-ক্ষেত্র হতে
কখন
অন্তরলক্ষ্মী এসেছ অন্তরে,
আপনার
অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসি
আছ মহিষীর মতো। কে তোমারে
এনেছিল
বরণ করিয়া। পুরদ্বারে
কে
দিয়াছে হুলুধ্বনি! ভরিয়া অঞ্চল
কে
করেছে বরিষন নবপুষ্পদল
তোমার
আনম্র শিরে আনন্দে আদরে!
সুন্দর
সাহানা-রাগে বংশীর সুস্বরে
কী
উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যেদিন
প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে
লজ্জামুকুলিত
মুখে রক্তিম অম্বরে
বধূ
হয়ে প্রবেশিলে চিরদিনতরে
আমার
অন্তর-গৃহে-- যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী
জেগে আছে সুখ দুঃখ লয়ে,
যেখানে
আমার যত লজ্জা আশা ভয়
সদা
কম্পমান, পরশ নাহিকো সয়
এত
সুকুমার! ছিলে খেলার সঙ্গিনী
এখন
হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী,
জীবনের
অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমূলক
হাসি-অশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই,
সে
বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধ দৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছ
নীলাম্বর-সম; হাসিখানি স্থির
অশ্রুশিশিরেতে
ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত
বল্লরীর মতো; প্রীতি স্নেহ
গভীর
সংগীততানে উঠিছে ধ্বনিয়া
স্বর্ণবীণাতন্ত্রী
হতে রনিয়া রনিয়া
অনন্ত
বেদনা বহি। সে অবধি প্রিয়ে,
রয়েছি
বিস্মিত হয়ে--তোমারে চাহিয়ে
কোথাও
না পাই অন্ত। কোন্ বিশ্বপার
আছে
তব জন্মভূমি। সংগীত তোমার
কত
দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে
আমারে
করিবে বন্দী গানের পুলকে
বিমুগ্ধ
কুরঙ্গসম। এই যে বেদনা,
এর
কোনো ভাষা আছে? এই যে বাসনা,
এর
কোনো তৃপ্তি আছে? এই যে উদার
সমুদ্রের
মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ
সুন্দর তরণী, দশ দিশি
অস্ফুট
কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি
কী
কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে,
এর
কোনো কূল আছে? সৌন্দর্য পাথারে
যে
বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী
সে
বাতাসে, কত বার মনে শঙ্কা করি,
ছিন্ন
হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল;
অভয়
আশ্বাসভরা নয়ন বিশাল
হেরিয়া
ভরসা পাই বিশ্বাস বিপুল
জাগে
মনে-- আছে এক মহা উপকূল
এই
সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে
মোদের
দোঁহের গৃহ।
হাসিতেছ ধীরে
চাহি
মোর মুখে, ওগো রহস্যমধুরা!
কী
বলিতে চাহ মোরে প্রণয়বিধুরা
সীমান্তিনী
মোর, কী কথা বুঝাতে চাও।
কিছু
বলে কাজ নাই-- শুধু ঢেকে দাও
আমার
সর্বাঙ্গ মন তোমার অঞ্চলে,
সম্পূর্ণ
হরণ করি লহ গো সবলে
আমার
আমারে; নগ্ন বক্ষে বক্ষ দিয়া
অন্তর
রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া।
তোমার
হৃদয়কম্প অঙ্গুলির মতো
আমার
হৃদয়তন্ত্রী করিবে প্রহত,
সংগীত-তরঙ্গধ্বনি
উঠিবে গুঞ্জরি
সমস্ত
জীবন ব্যাপী থরথর করি।
নাই
বা বুঝিনু কিছু, নাই বা বলিনু,
নাই
বা গাঁথিনু গান, নাই বা চলিনু
ছন্দোবদ্ধ
পথে, সলজ্জ হৃদয়খানি
টানিয়া
বাহিরে। শুধু ভুলে গিয়ে বাণী
কাঁপিব
সংগীতভরে, নক্ষত্রের প্রায়
শিহরি
জ্বলিব শুধু কম্পিত শিখায়,
শুধু
তরঙ্গের মতো ভাঙিয়া পড়িব
তোমার
তরঙ্গ-পানে, বাঁচিব মরিব
শুধু,
আর কিছু করিব না। দাও সেই
প্রকাণ্ড
প্রবাহ, যাহে এক মুহূর্তেই
জীবন
করিয়া পূর্ণ, কথা না বলিয়া
উন্মত্ত
হইয়া যাই উদ্দাম চলিয়া।
মানসীরূপিণী
ওগো, বাসনাবাসিনী,
আলোকবসনা
ওগো, নীরবভাষিণী,
পরজন্মে
তুমি কে গো মূর্তিমতী হয়ে
জন্মিবে
মানব-গৃহে নারীরূপ লয়ে
অনিন্দ্যসুন্দরী?
এখন ভাসিছ তুমি
অনন্তের
মাঝে; স্বর্গ হতে মর্তভূমি
করিছ
বিহার; সন্ধ্যার কনকবর্ণে
রাঙিছ
অঞ্চল; উষার গলিত স্বর্ণে
গড়িছ
মেখলা; পূর্ণ তটিনীর জলে
করিছ
বিস্তার, তলতল ছলছলে
ললিত
যৌবনখানি, বসন্তবাতাসে,
চঞ্চল
বাসনাব্যথা সুগন্ধ নিশ্বাসে
করিছ
প্রকাশ; নিষুপ্ত পূর্ণিমা রাতে
নির্জন
গগনে, একাকিনী ক্লান্ত হাতে
বিছাইছ
দুগ্ধশুভ্র বিরহ-শয়ন;
শরৎ-প্রত্যুষে
উঠি করিছ চয়ন
শেফালি,
গাঁথিতে মালা, ভুলে গিয়ে শেষে,
তরুতলে
ফেলে দিয়ে, আলুলিত কেশে
গভীর
অরণ্য-ছায়ে উদাসিনী হয়ে
বসে
থাক; ঝিকিমিকি আলোছায়া লয়ে
কম্পিত
অঙ্গুলি দিয়ে বিকালবেলায়
বসন
বয়ন কর বকুলতলায়;
অবসন্ন
দিবালোকে কোথা হতে ধীরে
ঘনপল্লবিত
কুঞ্জে সরোবর-তীরে
করুণ
কপোতকণ্ঠে গাও মুলতান;
কখন
অজ্ঞাতে আসি ছুঁয়ে যাও প্রাণ
সকৌতুকে;
করি দাও হৃদয় বিকল,
অঞ্চল
ধরিতে গেলে পালাও চঞ্চল
কলকণ্ঠে
হাসি', অসীম আকাঙক্ষারাশি
জাগাইয়া
প্রাণে, দ্রুতপদে উপহাসি'
মিলাইয়া
যাও নভোনীলিমার মাঝে।
কখনো
মগন হয়ে আছি যবে কাজে
স্খলিতবসন
তব শুভ্র রূপখানি
নগ্ন
বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি
চকিতে
চমকি চলি যায়। জানালায়
একেলা
বসিয়া যবে আঁধার সন্ধ্যায়,
মুখে
হাত দিয়ে, মাতৃহীন বালকের
মতো
বহুক্ষণ কাঁদি স্নেহ-আলোকের
তরে--
ইচ্ছা করি, নিশার আঁধারস্রোতে
মুছে
ফেলে দিয়ে যায় সৃষ্টিপট হতে
এই
ক্ষীণ অর্থহীন অস্তিত্বের রেখা,
তখন
করুণাময়ী দাও তুমি দেখা
তারকা-আলোক-জ্বালা
স্তব্ধ রজনীর
প্রান্ত
হতে নিঃশব্দে আসিয়া; অশ্রুনীর
অঞ্চলে
মুছায়ে দাও; চাও মুখপানে
স্নেহময়
প্রশ্নভরা করুণ নয়ানে;
নয়ন
চুম্বন কর, স্নিগ্ধ হস্তখানি
ললাটে
বুলায়ে দাও; না কহিয়া বাণী,
সান্ত্বনা
ভরিয়া প্রাণে, কবিরে তোমার
ঘুম
পাড়াইয়া দিয়া কখন আবার
চলে
যাও নিঃশব্দ চরণে।
সেই তুমি
মূর্তিতে
দিবে কি ধরা? এই মর্তভূমি
পরশ
করিবে রাঙা চরণের তলে?
অন্তরে
বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে
সর্ব
ঠাঁই হতে সর্বময়ী আপনারে
করিয়া
হরণ, ধরণীর একধারে
ধরিবে
কি একখানি মধুর মুরতি?
নদী
হতে লতা হতে আনি তব গতি
অঙ্গে
অঙ্গে নানা ভঙ্গে দিবে হিল্লোলিয়া--
বাহুতে
বাঁকিয়া পড়ি, গ্রীবায় হেলিয়া
ভাবের
বিকাশভরে? কী নীল বসন
পরিবে
সুন্দরী তুমি? কেমন কঙ্কণ
ধরিবে
দুখানি হাতে? কবরী কেমনে
বাঁধিবে,
নিপুণ বেণী বিনায়ে যতনে?
কচি
কেশগুলি পড়ি শুভ্র গ্রীবা-'পরে
শিরীষকুসুম-সম
সমীরণভরে
কাঁপিবে
কেমন? শ্রাবণে দিগন্তপারে
যে
গভীর স্নিগ্ধ দৃষ্টি ঘন মেঘভারে
দেখা
দেয় নব নীল অতি সুকুমার,
সে
দৃষ্টি না জানি ধরে কেমন আকার
নারীচক্ষে!
কী সঘন পল্লবের ছায়,
কী
সুদীর্ঘ কী নিবিড় তিমির-আভায়
মুগ্ধ
অন্তরের মাঝে ঘনাইয়া আনে
সুখবিভাবরী!
অধর কী সুধাদানে
রহিবে
উন্মুখ, পরিপূর্ণ বাণীভরে
নিশ্চল
নীরব! লাবণ্যের থরে থরে
অঙ্গখানি
কী করিয়া মুকুলি বিকশি
অনিবার
সৌন্দর্যেতে উঠিবে উচ্ছ্বসি
নিঃসহ
যৌবনে?
জানি, আমি জানি সখী,
যদি
আমাদের দোঁহে হয় চোখোচোখি
সেই
পরজন্ম-পথে, দাঁড়াব থমকি;
নিদ্রিত
অতীত কাঁপি উঠিবে চমকি
লভিয়া
চেতনা। জানি মনে হবে মম,
চিরজীবনের
মোর ধ্রুবতারা-সম
চিরপরিচয়ভরা
ওই কালো চোখ।
আমার
নয়ন হতে লইয়া আলোক,
আমার
অন্তর হতে লইয়া বাসনা,
আমার
গোপন প্রেম করেছে রচনা
এই
মুখখানি। তুমিও কি মনে মনে
চিনিবে
আমারে? আমাদের দুই জনে
হবে
কি মিলন? দুটি বাহু দিয়ে, বালা,
কখনো
কি এই কণ্ঠে পরাইবে মালা
বসন্তের
ফুলে? কখনো কি বক্ষ ভরি
নিবিড়
বন্ধনে, তোমারে হৃদয়েশ্বরী,
পারিব
বাঁধিতে? পরশে পরশে দোঁহে
করি
বিনিময় মরিব মধুর মোহে
দেহের
দুয়ারে? জীবনের প্রতিদিন
তোমার
আলোক পাবে বিচ্ছেদবিহীন,
জীবনের
প্রতি রাত্রি হবে সুমধুর
মাধুর্যে
তোমার, বাজিবে তোমার সুর
সর্ব
দেহে মনে? জীবনের প্রতি সুখে
পড়িবে
তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে
পড়িবে
তোমার অশ্রুজল। প্রতি কাজে
রবে
তব শুভহস্ত দুটি, গৃহ-মাঝে
জাগায়ে
রাখিবে সদা সুমঙ্গল--জ্যোতি।
এ
কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি,
কল্পনার
ছল? কার এত দিব্যজ্ঞান,
কে
বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ--
পূর্বজন্মে
নারীরূপে ছিলে কি না তুমি
আমারি
জীবন-বনে সৌন্দর্যে কুসুমি,
প্রণয়ে
বিকশি। মিলনে আছিলে বাঁধা
শুধু
এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা
আজি
বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে,
তোমারে
দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে।
ধূপ
দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধবাষ্প তার
পূর্ণ
করি ফেলিয়াছে আজি চারি ধার।
গৃহের
বনিতা ছিলে, টুটিয়া আলয়
বিশ্বের
কবিতারূপে হয়েছ উদয়--
তবু
কোন্ মায়া-ডোরে চিরসোহাগিনী,
হৃদয়ে
দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী
জাগায়ে
তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়।
তাই
তো এখনো মনে আশা জেগে রয়
আবার
তোমারে পাব পরশবন্ধনে।
এমনি
সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে
জ্বলিছে
নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি,
কখনো
বা ভাবময়, কখনো মুরতি।
রজনী
গভীর হল, দীপ নিবে আসে;
পদ্মার
সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে
কখন
যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণরেখা
মিলাইয়া
গেছে; সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা
তিমিরগগনে;
শেষ ঘট পূর্ণ ক'রে
কখন
বালিকা-বধূ চলে গেছে ঘরে;
হেরি
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি, একাদশী তিথি,
দীর্ঘ
পথ, শূন্য ক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি
গ্রামে
গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী;
কখন
গিয়েছে থেমে কলরবরাশি
মাঠপারে
কৃষিপল্লী হতে; নদীতীরে
বৃদ্ধ
কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটিরে
কখন
জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যাদীপখানি,
কখন
নিভিয়া গেছে-- কিছুই না জানি।
কী
কথা বলিতেছিনু, কী জানি, প্রেয়সী,
অর্ধ-অচেতনভাবে
মনোমাঝে পশি
স্বপ্নমুগ্ধ-মতো।
কেহ শুনেছিলে সে কি,
কিছু
বুঝেছিলে প্রিয়ে, কোথাও আছে কি
কোনো
অর্থ তার? সব কথা গেছি ভুলে,
শুধু
এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের
অন্তহীন অশ্রু-পারাবার
উদ্বেলিয়া
উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর
নিস্বনে।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো
প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে
মোরে লহো টানি-- শোয়াও যতনে
মরণসুস্নিগ্ধ
শুভ্র বিস্মৃতিশয়নে।
পৌষ ১২৯৯ শিলাইদহ বোট
Subscribe to:
Posts (Atom)