চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Friday, July 10, 2020

অর্থালঙ্কার

০১. সাদৃশ্যমূলক: দুটো বিসদৃশ বিজাতীয় বস্তুর সাহায্যে যে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার নিমার্ণ করা হয়, তাকে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার বলে। যেমন:

বিচক-কুসুম-সম ফুল্লমুখখানি।–রবীন্দ্রনাথ।
জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়।–কাজী নজরুল ইসলাম।

সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের চারটি বিষয় মনে রাখতে হয়।
ক. যাকে তুলনা করা হয় অর্থাৎ বর্ণনীয় বস্তু-উপমেয়।
খ. যার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে-উপমান।
গ. যে সাধারণ ধর্মের জন্যে তুলনা করা হয়, তাকে বলা হয়-সাধারণ ধর্ম
ঘ. যে শব্দের দ্বারা বা ভঙ্গিতে তুলনাটি বোধগম্য হয়ে ওঠে-সাদৃশ্যবাচক শব্দ কিংবা তুলনা বাচক শব্দ।

সাদৃশ্যমূলক শব্দ: ন্যায়, মতো, যথা, যেন, প্রায়, তুল্য, সম, সদৃশ, বৎ, যেমন, নিভ, তুলনা, উপমা, হেন, কল্প, জাতীয় ইত্যাদি সাদৃশ্যমূলক শব্দ।

সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার: উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নূতি, প্রতিবস্তুপমা, ব্যতিরেক, নিদর্শনা, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ, সন্দেহ, দৃষ্টান্ত, নিশ্চয়, তুল্যযোগিতা, দীপক, উল্লেখ, সহোক্তি, সূক্ষ্ম অলঙ্কার, অর্থ-শ্লেষ, অর্থাপক্তি, অনন্বয়, সামান্য ইত্যাদি।
সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হল-

ক. উপমা: দুই বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কারের ফলে যে চমৎকৃতি,-তা-ই উপমা। যেমন:
জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়।–কাজী নজরুল ইসলাম।
‘জোঁক’ এবং ‘মহাজন’ দুটো বিজাতীয় প্রাণী। এখানে শোষে বা শোষণ করে-সাধারণ ধর্ম। মহাজন-উপমেয়, জোঁক-উপমান, সম-তুলনাবাচক শব্দ।

উপমা ছয় প্রকার। যথা: i. পূর্ণোপমা, ii. লুপ্তোপমা, iii. মালোপমা, iv. বস্তুপ্রতিবস্তভাবের উপমা, v. বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমা,
vi. স্মরণোপমা

i. পূর্ণোপমা: যে উপমায় উপমেয়, উপমান, তুলনাবাচক শব্দ ও সাধারণ ধর্ম এ চারটি অবয়বই স্পষ্ট উল্লেখিত, তাকে পূর্ণোপমা বলে। যেমন:

বজ্রসম অপবাদ বাজে পোড়া বুকে।–মধুসূদন।
এখানে উপমেয়-অপবাদ; উপমান-বজ্র; সাধারণ ধর্ম-বাজে; তুলনাবাচক শব্দ-সম।
কাকের চোখের মত কালোচুল।–সৈয়দ আলী আহসান।
এখানে উপমেয়-চুল; উপমান-কাকের চোখ; সাধারণ ধর্ম-কালো; তুলনাবাচক শব্দ-মত।

ii. লুপ্তোপমা: যে উপমা অলঙ্কারে কেবলমাত্র উপমেয় ব্যতীত অন্য তিনটি অঙ্গের (উপমান, সাধারণ ধর্ম, তুলনাবাচক শব্দ) একটি, দুটি আবার কোথাও তিনটিই লুপ্ত বা উহ্য থাকে, তাকে লুপ্তোপমা বলে। যেমন:

১. তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত:
নির্জন গগনে একাকিনী ক্লান্তহাতে
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহশয়ন;--রবীন্দ্রনাথ।
এখানে উপমেয়-শয়ন, উপমান-দুগ্ধ, সাধারণ ধর্ম-শুভ্র কিন্তু দুগ্ধের ‘সম’ শুভ্র তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত।

২. সাধারণ ধর্ম লুপ্ত:
মরণ রে, তুহু মম শ্যাম সমান।--রবীন্দ্রনাথ।
এখানে উপমেয়-মরণ, উপমান-শ্রাম, তুলনাবাচক শব্দ-সমান কিন্তু সাধারণ ধর্ম অনুপস্থিত।

৩. উপমান ও তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত:
মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।--রবীন্দ্রনাথ।
হরিণের চোখের মত চোখ = হরিণ চোখ; এখানে উপমান ও তুলনাবাচক শব্দ অবিদ্যমান। আছে কেবল উপমেয় চোখ এবং কালো- এ সাধারণ ধর্ম।

৪. উপমান, সাধারণ ধর্ম ও তুলনাবাচক শব্দ লুপ্ত:
তড়িত-বরণী হরিণ-নয়নী

দেখিনু আঙিনা মাঝে।–চণ্ডীদাস।
একটি বিখ্যাত উদাহরণ। অনেকেই গ্রহণ করেছেন। তড়িতের বরনের মত বরণ যার (রাধার)-বহুব্রীহি সমাস এবং হরিণ-নয়নের মত নয়ন (রাধার) বহুব্রীহি সমাস-সেই রাধা, উপমেয় কেবল (বরণী বা নয়নী স্ত্রীলিঙ্গে ‘ঙ্গ’ প্রত্যয় যুক্ত), না আছে কোন তুলনাবাচক শব্দ, সাধারণ ধর্মজ্ঞাপক শব্দ (শুভ্র, চঞ্চল) এমন কি উপমানও (বরণ, নয়ন) বিস্ময়করভাবে অবিদ্যমান। অথচ চণ্ডীদাসের কল্পনায় এটি একটি মনোহর উপমায় ঊত্তীর্ণ।

iii. মালোপমা:  যেখানে উপমেয় একটি কিন্তু তার উপমান একাধিক, এ ধরণের উপমাকে মালোপমা বলে যেমন:

১. দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,
 রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধ তীরে যথা,
নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা আকাশ-মণ্ডল।–মধুসূদন।
উপমেয়-‘রিপুবৃন্দ’ আর উপমান-‘বালিবৃন্দ’ এবং ‘নক্ষত্র-মণ্ডল’।

iv. বস্তুপ্রতিবস্তভাবের উপমা:  উপমেয় এবং উপমানে সাধারণ ধর্মজ্ঞাপক শব্দটি যদি দুটি ভিন্ন শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে বস্তুপ্রতিবস্তভাবের উপমা বলে। যেমন:

১. দারুণ নখের ঘা ‍হিয়াতে বিরাজে
রক্তোৎপল ভাসে হেন নীল সরোমাঝে।–চণ্ডীদাস।
উপমেয়-নখের ঘা, উপমান-রক্তোৎপল, তুলনাবাচক শব্দ-হেন এবং সাধারণ ধর্ম- ভিন্ন শব্দ বিরাজে ভাসে অর্থ এক।
২. দুঃখে সুখে দিন হয়ে যায় গত   
 স্রোতের জলে ঝরে পড়া ভেসে যাওয়া ফুলের মতো।–রবীন্দ্রনাথ।
উপমেয়-দিন, উপমান-ফুল, তুলনাবাচক শব্দ-মতো এবং সাধারণ ধর্ম- ভিন্ন শব্দ গত ভেসে যাওয়া অর্থ এক।

v. বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমা: উপমেয় এবং উপমানের ধর্ম যদি একদম ভিন্ন হয়, অথচ তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সাদৃশ্য অনুভূত হয়, তবে ও ধর্ম দুটোকে বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমা বলে। যেমন:
১. দিনের শেষে শেষ আলোটি পড়েছে ওইপারে
জলের কিনারায়,
পথ চলতে বধূ যেমন নয়ন রাঙা করে
বাপের ঘরে চায়।                            –রবীন্দ্রনাথ।

এখানে উপমেয় -শেষ আলোটি, উপমান-বধূ। আত্মীয়-বিচ্ছেদ-বেদনা বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। ‘শে আলোটির রঙিন আভা-বধূর বেদনায় নয়ন রাঙা’।

২. আগনে যেমন সব বিষ যায়,
  প্রেমেও তেমনি সকলি শুচি।   --মোহিতলাল।
এখানে উপমেয় -আগুন, উপমান-প্রেম। আগুন যেমন সব কিছুকে পুড়িয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তেমনি প্রেম হৃদয়ে আগুন জ্বেলে সমস্ত পঙ্কিলতাকে বিনষ্ট করে নিজের মহিমা প্রকাশ করে, এ গভীরতর ক্ষমতা পরস্পরের সাদৃশ্য করে বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। ‘সব বিষ যায়’ ও ‘সকলি শুচি’ এ ধর্ম ভিন্ন হলেও সূক্ষ্ম সাদৃশ্য বর্তমান।

vi. স্মরণোপমা: কোন বস্তু বা বিষয়ের অনুভব থেকে যদি সে রকম কোনো বস্তুর স্মৃতি জাগে তবে তাকে স্মরণোপমা বলা যায়। াবশ্য এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, যে বস্তুর স্মৃতি অন্য বস্তুকে স্মরণে আনছে সে দুটোকে ভিন্ন জাতীয় হতে হবে।

১. কালো জল দেখিয়া কালারে মনে পড়ে।–চণ্ডীদাস।
এখানে উপমেয়-জল আর কালা (কৃষ্ণকে) রাধার মনে পড়ে।

খ. উৎপ্রেক্ষা: উৎপ্রক্ষা কথাটি এসেছে উৎকট থেকে ; যার অর্থ দাঁড়ায় উদ্ভট,মিথ্যা বা সংশয় বা কল্পনা। কবি তার কবি
শক্তির নৈপুণ্যে মিথ্যা বা সংশয় বা কল্পনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, পাঠক সহজেই তার আবেদনকে
গ্রহণ করেন।
মোটকথা; ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যের কারণে উপমেয়কে উপমান বলে সংশয় হলে উৎপ্রেক্ষা অলঙ্কার বলে।
উৎপ্রক্ষা দুই প্রকার:

১. বাচ্যোৎপ্রেক্ষা: যে উৎপ্রক্ষায় সম্ভাবনাবাচক শব্দ (যেন, মনে হয়, বুঝি, মনে ইত্যাদি) উল্লিখিত, তাকে বাচ্যোৎপ্রেক্ষা বলে। যেমন:

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

পূর্ণিমা চাঁদ(উপমেয়) যেন ঝলসানো রুটি(উপমান)।–সুকান্ত ভট্টাচায।

২. প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা: যে উৎপ্রেক্ষায় সম্ভাবনাবাচক শব্দ (যেন, মনে হয় ইত্যাদি) অনুপস্থিত অথচ অর্থ থেকে সম্ভাবনার ভাবটি

প্রতীয়মান হয়ে উঠে, তাকে বলে প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা। যেমন:
আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে - পাঁচটি রঙের ফুল ; --জসীম উদদীন।
পাঁচটি মেয়ে তো আর প্রকৃত ফুল নয়,যেন পাঁচটি রঙের ফুল; 'যেন'- অনুক্ত, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না।

গ. রূপক: উপমেয়কে সম্পূর্ণ অস্বীকার না করে যদি তার উপর উপমানের অভেদারোপ করা হয়-তবে তাকে রূপক বলে। যেমন:

আসল কথাটি চাপা ‍দিতে ভাই, কাব্যের জাল বুনি-   --যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
এখানে উপমেয়-কাব্য, উপমান-জাল অর্থাৎ কাব্যের জাল বুনি।
রূপক দুই প্রকার। যথা: ১. কেবল ও ২. মালা।

১. কেবল: যেখানে একটি উপমেয় বা বিষয়ের ওপর একটি মাত্র উপমান বা বিষয়ী আরোপ করা হয়, সেখানে কেবল রূপক হবে। যেমন:
আসল কথাটি চাপা ‍দিতে ভাই, কাব্যের জাল বুনি-   --যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
এখানে উপমেয়-কাব্য, উপমান-জাল অর্থাৎ কাব্যের জাল বুনি।

২. মালা: যেখানে একটি উপমেয় বা বিষয়ের ওপর বহু উপমান বা বিষয়ী আরোপ করা হয়, সেখানে মালা রূপক হবে। যেমন:
আমি কি তোমার উপদ্রব, অভিশাপ,
দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন, করলগ্ন কাঁটা?-রবীন্দ্রনাথ।
এখানে একটি মাত্র উপমেয়-আমি; উপমান-উপদ্রব, অভিশাপ, দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন এবং করলগ্ন কাঁটা।
আমি পিনাক পানির ডমরু, ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি চক্র মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড।–নজরুল ইসলাম।
এখানে একটি মাত্র উপমেয়-আমি; উপমান-ডমরু, ত্রিশূল, দণ্ড, চক্র, মহাশঙ্খ এবং প্রবণনাথ।

ঘ. অতিশয়োক্তি: আতিশয্যপূর্ণ বা সীমাতিরিক্ত কথা থেকে অতিশয়োক্তি কথাটি প্রচলন।তার অর্থ এখানে আতিশয্যপূর্ণ বা সীমাতিরিক্ত কিছু থাকবে। মোটকথা, কবি কল্পনায় যখন উপমান উপমেয়কে সম্পূর্ণরুপে গ্রাস করে উপমানের চরম প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয় এবং সাধারণ উপমেয় উল্লিখিত হয় না, তখন অতিশয়োক্তি অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়।যেমন:

বন থেকে এল এক টিয়ে মনোহর।

সোনার টোপর শোভে মাথার উপর।
এখানে উপমেয় ' আনারস'- অবিদ্যমান, 'সোনার টোপর-পরা টিয়ে'- উপমানের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
উৎপ্রক্ষায় উপমেয়কে উপমান বলে মনে হয়। আর অতিশয়োক্তিতে উপমানই উপমেয়কে সম্পূর্ণরুপে গ্রাস করে।
অপহ্নূতি: অপহ্নুতি [অপহ্নু (গোপন করা) + তি ভাববাচ্যে] বিশেষ্য, গোপন; অপলাপ; অস্বীকার। ২ বিশেষ্য, কাব্যের অর্থালঙ্কার বিশেষ denial. উপমেয়ের অপলাপ বা গোপন করিয়া উপমানের বিধান বা স্থাপন বা কোন গোপনীয় বিষয় স্বয়ং কোন প্রকারে প্রকাশ করিয়া পুনরায় প্রকারান্তরে তার গোপন করায় অপহ্নুতি অলঙ্কার হয়। যেমন:
চোখে চোখে কথা নয় গো বন্ধু, আগুনে আগুনে কথা।–অন্নদাশঙ্কর রায়।

এখানে উপমেয় চোখ-চোখ, উপমান-আগুন। চোখকে অস্বীকার করে আগুন প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই আগুনে আগুনে কথা।
প্রতিবস্তুপমা: প্রতিবস্তু+উপমা। বস্তুতে বস্তুতে একই সাধারণ ধর্ম যদি ভিন্ন ভাষায় (শব্দে) প্রকাশিত হয়ে বস্তুদ্বয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের বা সাম্যের ভাব সুষ্টি করে, তবে তাকে প্রতিবস্তুপমা বলে। যেমন:
         নানান দেশে নানান ভাষা,
বিনা স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?
কত নদী সরোবরে কিবা ফল চাতকীর?
ধারাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?

এখানে ‘নানান দেশে নানান ভাষা’ এবং ‘কত নদী সরোবরে’ আর ‘স্বদেশী ভাষা’ (মাতৃভাষা) ‘ধারাজল (বৃষ্টির জল) যথাক্রমে উপমেয়-উপমান। ‘আশা’ এবং‘তৃষা’-ভিন্ ভাষায়, স্বতন্ত্র বাক্যে কিন্তু তাৎপর্যে এক,-এজন্যে বস্তুপ্রতি-বস্তুভাবের সাধারণ ধর্ম। তুলনাবাচক শব্দ নেই।–অতএব প্রতিবস্তুপমা।

ঙ. ব্যতিরেক: যদি উপমানের চেয়ে উপমেয়কে উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট করে দেখানো হয়, তবে তাকে ব্যতিরেক অলঙ্কার বলে। যেমান:
কিমতে বোলিব ভাল মৃগাঙ্ক!
সকলঙ্ক চনিদ্রমা ললাট নিষ্কলঙ্ক।। --আলাওল।
এখানে উপমেয়-ললাট এবং উপমান-চন্দ্রিমা। চন্দ্র কলঙ্কযুক্ত কিন্তু ললাট কলঙ্ক চিহ্নহীন।

চ. নিদর্শনা: যে অলঙ্কারে দুটো বস্তুর যে ধরনের সম্পর্ক বোঝায় যা সাধারণ মানুষের পরিচিত নয় বলে বুঝতে অসুবিধা হয়; উপমেয়-উপমানভাব পরিস্ফুট করে, তাকে নিদর্শন বলে। যেমন:
মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবাল; ভুলি কমল কানন!-মধুসূদন।
এখানে কবি প্রথম জীবনে মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা করে বিদেশী ভাষাকে বরণ করলেও তিনি কমলকাননকে ভুলে শৈবালে খেলা করেন নি।

ছ. ভ্রান্তিমান: প্রবল সাদৃশ্যহেতু যখন এক বস্তুকে অন্য বস্তু বরে ভ্রম বা ভুল হয় এবং সে ভ্রান্তি নিতান্ত সাধারণ ভুল না হয়ে যদি কবি কল্পনায় মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে, তবে তাকে ভ্রান্তিমান অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. পদ পরশনে রেণু রক্তবর্ণ হয়।
    সিন্দুর বলিয়া কুল-রমণী পরয়।।--আলাওল।
এখানে নায়িকা পদ্মাবতী রাতুল চরণ-স্পর্শে পথের ধুলি রক্তবর্ণ হয়, এবং সে ধুলিকে সিন্দুর ভ্রমে কুল রমণীরা যখন সিঁথিতে ধারণ করেন, তখনই ভ্রান্তিমান অলঙ্কার। রক্তবর্ণ রেণুকে প্রবল সাদৃশ্যহেতু তাঁরা সিন্দুর বলে ভুল করেছেন।
২. রাই রাই কবি সঘনে জপয়ে হরি তুয়া ভাবে তরু দেই কোর।–গোবিন্দ দাস।
কৃষ্ণ রাধা ভেবে (ভ্রমে) তরুকে আলিঙ্গন করে।

জ. সমাসোক্তি: উপমেয়ের ওপর উপমানের সমানভাবে রূপ আরোপিত হলে তাকে সমাসোক্তি অরঙ্কার বলে। যেমন:

১. মৃদুপদে নিদ্রাদেবী আইলা কৈলাসে;
লভিল কৈলাস-বাসী কুসুম-শয়নে
বিরাম;                                    --মধুসূদন।
নিদ্রা বা ঘুমরে ওপর নারীর ব্যবহার আরোপ করা হয়েছে।
২. পবর্ত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ; --রবীন্দ্রনাথ।
এখানে নিশ্চল পবর্তে চলিষ্ণু মেঘের গতিময়তা আরোপিত।
৩. আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
  ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই, কিছু নাই!কাজী নজরুল ইসলাম।
নিষ্প্রাণ সানাই ব্যথাতুর প্রাণের আরোপ। 

ঝ. প্রতীপ: যদি উপমানই উপমেয় রূপে কল্পিত হয় কিংবা উপমেয় তার নিজের উৎকর্ষ বা শ্রেষ্ঠত্ব হেতু উপমানকে নিষ্প্রয়োজন বিধায় প্রত্যাখ্যান করে-তবে তাকে প্রতীপ অলঙ্কার বলে। যেমন:
মায়ের মুখের হাসির মত কমল-কলি উঠল ফুটে।–গোলাম মোস্তাফা।
এখানে উপমেয়-মায়ের মুখের হাসি; উপমান-কমল-কলি উঠল ফুটে। কমল-কলির হাসি না হয়ে হাসির মত কমল-কলি ফুটে উঠেছে।
সন্দেহ: কবি বর্ণনায় যদি উপমেয় এবং উপমান দুটোতেই সংশয় আরোপিত হয়-তবে তাকে সন্দেহ অলঙ্কার বলে। যেমন:
ও কি গান? ও কি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল
ও কি হুহুঙ্কার?         --নজরুল ইসলাম।

ঞ. দৃষ্টান্ত: উপমেয়ের যে ধর্ম, তার থেকে যদি উপমানের ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক হয় এবং এ দুয়ের মধ্যে থাকে কেবল ভাবগত সাদৃশ্য-তাও আবিষ্কার সাপেক্ষ তবে তাকে দৃষ্টন্ত অলঙ্কার বলে। যেমন:

স্রভাজন দুঃখী রাজদুঃখে।
আঁধার জগৎ, মরি ঘন আবরিলে
দিননাথ-   -- মধুসূদন।
এখানে উপমেয়-সভাজন, রাজা; উপমান-জগৎ, দিননাথ; সাধারন ধর্ম-দুঃখ এবং ঘন।
 নিশ্চয়: উপমানকে অস্বীকার করে যদি উপমেয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়-তবে তাকে নিশ্চয় অলঙ্কার বলে। যেমন:
কাঁপিছে এ পুরী
রক্ষোবীরপদভরে;-নহে ভূকম্পনে!মধুসূদন।
এখানে উপমান-নহে ভূকম্পনে অস্বীকার করে উপমেয়-রক্ষোবীরপদভরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
 তুল্যযোগিতা: যদি উপমেয় বা উপমান একই ধর্মের দ্বারা গ্রথিত হয়, তবে তাকে তুল্যযোগিতা অলঙ্কার বলে। যেমন:
সানে বান্ধা হিয়া মোর পাষানে বান্ধা প্রাণ।
এখানে উপমেয়-হিয়া ও প্রাণ বান্ধা পড়েছে এক ধর্ম দ্বারা।

ট. দীপক: যদি উপমেয় এবং উপমান দুটোকেই একই পদ বা ধর্মের দ্বারা যুক্ত করা হয়, তাহলে তাকে দীপক অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. তীরে উত্তরিল তরী, তারা উত্তরিলা।–ভারতচন্দ্র।
২. যুগে যুগে পূণ্য খোঁজ; পূণ্য আজি তোময় চায়।–সত্যেন্দ্রনাথ।
 উল্লেখ: একই বস্তুর নানাবিধ গুণ থাকার জন্যে যদি ব্যক্তিভেদে বিভিন্নবাবে বর্ণিত বা গৃহীত হয়, কিংবা একই ব্যক্তি তাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ভাবে গ্রহণ করেন-তবে তাকে উল্লেখ অলঙ্কার বলে। যেমন:
হে তন্বী, ভোগীর তুমি কামনার ধন,
তপস্বীর বিভীষিকা কবির স্বপন।–শ্যামাপদ চক্রবর্তী।
এখানে একই ‘তন্বী’ ব্যক্তিভেদে ভোগীর কামনার ধন, তপস্বীর বিভীষিকা এবং কবির স্বপন।

ঠ. সহোক্তি: উপমেয় কিংবা উপমানের যে কোনো একটিকে প্রাধান্য দিয়ে যদি সহার্থক শব্দের (সহ, সাথে, সনে, সহিত) বন্ধনে দুটোকে (উপমেয়-উপমান) বাঁধা হয়, তবে তাকে সহোক্তি অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. চলে নীলশাড়ী নিঙাড়ি নিঙাড়ি
পরাণ সহিতে মোর।–চণ্ডীদাস।
এখানে রাধা স্নান শেষ করে নীলশাড়ী নিঙড়াতে নিঙড়াতে যাচ্ছে তার প্রতিক্রিয়ায় কৃষ্ণের প্রানে মোচড় মারে।
২. বন্ধীরা গাহে না গান,
যমুনাকল্লোল-সাথে নববত মিলায় না তান।–রবীন্দ্রানাথ।
ড. অনন্বয়: উপমেয় এবং উপমান দুই বস্তু না হয়ে এক বস্তু হয় তখন যে অলঙ্কার হয়, তাকে অনন্বয় অলঙ্কার বলে। যেমন:

১. অকিখল অতিছল অতীব কুটিল-
তুমিই তোমার মাত্র উপমা কেবল।
এখানে উপমেয় এবং উপমান একই বস্তু তুমি।
২. তার যাহা কিছু তাহারি মতন-একবার হলে গত,
এ ছায়া আরোকে আর পড়িবে না কায়াখানি তার মত।– মোহিতলাল মজুমদার।
এখানে উপমেয় এবং উপমান একই বস্তু তার। 

সামান্য: কোনো বৈশিষ্টের কিংবা গুণের সাদৃশ্য হেতু উপমেয় যদি উপমানের সাথে অভিন্নভাবে মিশে যায়, তবে তাকে সামান্য অলঙ্কার বলে। যেমন:

কালো জলে কালো তনু লখিতে না পারিগো,
ছুঁইয়া করিল জাতিনাশ। --কানুদাস।
এখানে উপমেয়- কালো তনু (কৃষ্ণের), উপমান-কালো জলে (যমুনার জলে) অভেদ মিশে গেছে বলে সামান্য অলঙ্কার।

তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

No comments: