চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Tuesday, July 21, 2020

লজ্জা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী

    আমার হৃদয় প্রাণ
            সকলই করেছি দান,
       কেবল শরমখানি রেখেছি।
            চাহিয়া নিজের পানে
            নিশিদিন সাবধানে
       সযতনে আপনারে ঢেকেছি।
            হে বঁধু, এ স্বচ্ছ বাস
            করে মোরে পরিহাস,
       সতত রাখিতে নারি ধরিয়া--
            চাহিয়া আঁখির কোণে
            তুমি হাস মনে মনে,
       আমি তাই লাজে যাই মরিয়া।
            দক্ষিণপবনভরে
            অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
       কখন্‌ যে নাহি পারি লখিতে।
            পুলকব্যাকুল হিয়া
            অঙ্গে উঠে বিকশিয়া,
       আবার চেতনা হয় চকিতে।
            বদ্ধ গৃহে করি বাস
            রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
       আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
            বসি গিয়া বাতায়নে,
            সুখসন্ধ্যাসমীরণে
       ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া।
পূর্ণচন্দ্রকররাশি
            মূর্ছাতুর পড়ে আসি
       এই নবযৌবনের মুকুলে,
            অঙ্গ মোর ভালোবেসে
            ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
       আপনার লাবণ্যের দুকূলে--
            মুখে বক্ষে কেশপাশে
            ফিরে বায়ু খেলা-আশে,
       কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে--
            হেনকালে তুমি এলে
            মনে হয় স্বপ্ন ব'লে,
       কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে।
            থাক্‌ বঁধু, দাও ছেড়ে,
            ওটুকু নিয়ো না কেড়ে,
       এ শরম দাও মোরে রাখিতে--
            সকলের অবশেষ
            এইটুকু লাজলেশ
       আপনারে আধখানি ঢাকিতে।
            ছলছল-দু'নয়ান
            করিয়ো না অভিমান,
       আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি;
            বুঝাতে পারি নে যেন
            সব দিয়ে তবু কেন
       সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি--
কেন যে তোমার কাছে
       একটু গোপন আছে,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে।
       এ নহে গো অবিশ্বাস--
       নহে সখা, পরিহাস,
নহে নহে ছলনার খেলা এ।
       বসন্তনিশীথে বঁধু,
       লহ গন্ধ, লহ মধু,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো।
       দিয়ো দোল আশে-পাশে,
       কোয়ো কথা মৃদু ভাষে--
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো।
       সেটুকুতে ভর করি
       এমন মাধুরী ধরি
তোমাপানে আছি আমি ফুটিয়া,
       এমন মোহনভঙ্গে
       আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া--
       এমন সকল বেলা
       পবনে চঞ্চল খেলা,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি।
       শুন বঁধু, শুন তবে,
       সকলই তোমার হবে,
কেবল শরম থাক্‌ আমারি।


  ২৮ আষাঢ়, ১৩০০
মুক্তি
  - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী

চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি',
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে?

নিরুদ্দেশ যাত্রা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
        হে সুন্দরী?
বলো  কোন্‌ পার ভিড়িবে তোমার
        সোনার তরী।
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাস শুধু, মধুরহাসিনী--
বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে
        তোমার মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
        গগনকোণে।
কী আছে হোথায়-- চলেছি কিসের
        অম্বেষণে?
বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায়
         অপরিচিতা--
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
         দিনের চিতা,
ঝলিতেছে জল তরল অনল,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,
দিক্‌বধূ যেন ছলছল-আঁখি
         অশ্রুজলে,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার,
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
         চরণতলে?
তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
         কথা না ব'লে।
হু হুক'রে বায়ু ফেলিছে সতত
         দীর্ঘশ্বাস।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন
         জলোচ্ছ্বাস।
সংশয়ময় ঘননীল নীর,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
         দুলিছে যেন।
তারি 'পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি 'পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
         হাসিছ কেন?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার
         বিলাস হেন।
যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
          "কে যাবে সাথে'
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
          নবীন প্রাতে।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিম-পানে অসীম সাগর,
চঞ্চল আলো আশার মতন
          কাঁপিছে জলে।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
          সোনার ফলে?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
          কথা না ব'লে।
তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
          কখনো রবি--
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর, কখনো
          শান্ত ছবি।
বেলা বহে যায়, পালে লাগে বায়--
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
          অস্তাচলে।
এখন বারেক শুধাই তোমায়,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
          তিমির-তলে?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
          কথা না ব'লে।
আঁধার রজনী আসিবে এখনি
          মেলিয়া পাখা,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-আলোক
          পড়িবে ঢাকা।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
          কেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর,
"কোথা আছ  ওগো  করহ পরশ
          নিকটে আসি।'
কহিবে না কথা, দেখিতে পাব না
          নীরব হাসি।

  ২৭ অগ্রহায়ণ  ১৩০০
কোন্‌ ক্ষণে

কোন্‌ ক্ষণে
          সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
              উঠেছিল দুই নারী
          অতলের শয্যাতল ছাড়ি।
          একজনা উর্বশী, সুন্দরী,
          বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,
              স্বর্গের অপ্সরী।
          অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
          বিশ্বের জননী তাঁরে জানি,
              স্বর্গের ঈশ্বরী।

          একজন তপোভঙ্গ করি
     উচ্চহাস্য-অগ্নিরসে ফাল্গুনের সুরাপাত্র ভরি
              নিয়ে যায় প্রাণমন হরি,
     দু-হাতে ছড়ায় তারে বসন্তের পুষ্পিত প্রলাপে,
              রাগরক্ত কিংশুকে গোলাপে,
                      নিদ্রাহীন যৌবনের গানে।

              আরজন ফিরাইয়া আনে
              অশ্রুর শিশির-স্নানে
                       স্নিগ্ধ বাসনায়;
          হেমন্তের হেমকান্ত সফল শান্তির পূর্ণতায়;
                    ফিরাইয়া আনে
              নিখিলের আশীর্বাদপানে
          অচঞ্চল লাবণ্যের স্মিতহাস্যসুধায় মধুর।
                ফিরাইয়া আনে ধীরে
                     জীবনমৃত্যুর
              পবিত্র সংগমতীর্থতীরে
              অনন্তের পূজার মন্দিরে।
  পদ্মাতীরে, ২০ মাঘ, ১৩২১    
যে-কথা বলিতে চাই
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---বলাকা

যে-কথা বলিতে চাই,
         বলা হয় নাই,
             সে কেবল এই--
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই
             দেখিনু সহস্রবার
             দুয়ারে আমার।
     অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
     সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
          আমি নাহি জানি।

শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
     নদীর এপারে ঢালু তটে
          চাষি করিতেছে চাষ;
     উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
          চলে কি না চলে
        ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
          আধো-জাগা নয়নের মতো।
          পথখানি বাঁকা
     বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
     নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।

ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
              ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
      নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
          যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি
              কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
     এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
     ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
     অকস্মাৎ নদীস্রোতে
          ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
          হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।


পদ্মা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২
পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
                                 - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---বলাকা

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল; ওরে যাত্রী।
     তোমার পথের 'পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান
              রুদ্রের ভৈরব গান।
                  দূর হতে দূরে
          বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে,
                  যেন পথহারা
              কোন্‌ বৈরাগীর একতারা।

              ওরে যাত্রী,
     ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী;
চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে আবরি
         ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি
              দিগন্তের পারে দিগন্তরে।
     ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,
          নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,
          নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ।
পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ,
          শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ।
     পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা,
     পথে পথে গুপ্তসর্প গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।
          নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।

     ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার।
          চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার--
     সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম,
          নহে শান্তি, নহে সে আরাম।
          মৃত্যু তোরে দিবে হানা,
          দ্বারে দ্বারে পাবি মানা,
     এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ,
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ
          ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী।
     ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষ্মী তোমার বরদাত্রী।

     পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী।
              এসেছে নিষ্ঠুর,
          হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর,
          হোক রে মদের পাত্র চুর।
     নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি,
          ধরো তার পাণি;
     ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী।
          ওরে যাত্রী
     গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি।


কলিকাতা, ৯ বৈশাখ, ১৩২৩




রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৮ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।

রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।

১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।[২৩] ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।

থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়

বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারি দিকে তার বাঁধন কেন!
ভাঙ রে হৃদয়, ভাঙ্রে বাঁধন,
সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পরে আঘাত কর।
মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!
উথলি যখন উঠেছে বাসনা
জগতে তখন কিসের ডর!

আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা।
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।
এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।।

কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে, চারি দিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর

ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।।

শেষের কবিতা
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দু'সাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় -
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত'ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।
মোর লাগি করিয় না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।
উ'কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপখক হতে আনি
রজনী গন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।


আবেদন

# বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ক্লাব গঠনের অনুমতি চেয়ে প্রধান শিক্ষকের নিকট আবেদনপত্র লেখ।

২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ খৃ:
প্রধান শিক্ষক,
আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়,
আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

বিষয়: বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ক্লাব গঠনের অনুমতি প্রদানের জন্য আবেদন।

জনাব,
বিনীত নিবেদন এই যে, আমরা আপনার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী। আসন্ন বিজ্ঞান সপ্তাহ উদ্যাপন নিয়ে আমাদের বিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ-উদ্বীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমরা বিদ্যালয়ে একটি বিজ্ঞান ক্লাব গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এতে বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা, তথ্যাদি আদান-প্রদান এবং বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ হবে। ছোট ছোট অনেক বিজ্ঞান প্রজেক্টও আমরা তৈরি করতে পারব।

অতএব, জনাবের নিকট বিনীত প্রার্থনা, আমাদের বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ক্লাব গঠনের অনুমতি দিয়ে আমাদেও উৎসাহিত করবেন।

নিবেদক-

বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের পক্ষে
মুমতারিন মালিহা-১০ম-খ-০১
শুপতা ইসলাম-১০ম-খ-০২