নিরুদ্দেশ
যাত্রা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী
আর
কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো
কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।
যখনি
শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি
হাস শুধু, মধুরহাসিনী--
বুঝিতে
না পারি, কী জানি কী আছে
তোমার মনে।
নীরবে
দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল
সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে
পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে।
কী
আছে হোথায়-- চলেছি কিসের
অম্বেষণে?
বলো
দেখি মোরে, শুধাই তোমায়
অপরিচিতা--
ওই
যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা,
ঝলিতেছে
জল তরল অনল,
গলিয়া
পড়িছে অম্বরতল,
দিক্বধূ
যেন ছলছল-আঁখি
অশ্রুজলে,
হোথায়
কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর
সাগরের পার,
মেঘচুম্বিত
অস্তগিরির
চরণতলে?
তুমি
হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না ব'লে।
হু
হুক'রে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস।
অন্ধ
আবেগে করে গর্জন
জলোচ্ছ্বাস।
সংশয়ময়
ঘননীল নীর,
কোনো
দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম
রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন।
তারি
'পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি
'পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ,
তারি
মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন?
আমি
তো বুঝি না কী লাগি তোমার
বিলাস হেন।
যখন
প্রথম ডেকেছিলে তুমি
"কে যাবে সাথে'
চাহিনু
বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে।
দেখালে
সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিম-পানে
অসীম সাগর,
চঞ্চল
আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে।
তরীতে
উঠিয়া শুধানু তখন
আছে
কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার
স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে?
মুখপানে
চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না ব'লে।
তার
পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি--
কখনো
ক্ষুব্ধ সাগর, কখনো
শান্ত ছবি।
বেলা
বহে যায়, পালে লাগে বায়--
সোনার
তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে
হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে।
এখন
বারেক শুধাই তোমায়,
স্নিগ্ধ
মরণ আছে কি হোথায়,
আছে
কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
তিমির-তলে?
হাসিতেছ
তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না ব'লে।
আঁধার
রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা,
সন্ধ্যা-আকাশে
স্বর্ণ-আলোক
পড়িবে ঢাকা।
শুধু
ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু
কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে
উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি।
বিকল
হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া
তোমারে কহিব অধীর,
"কোথা
আছ ওগো করহ পরশ
নিকটে আসি।'
কহিবে
না কথা, দেখিতে পাব না
নীরব হাসি।
২৭ অগ্রহায়ণ ১৩০০
No comments:
Post a Comment