চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Tuesday, July 28, 2020

 দেশ বা জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

(সংকেত: ভূমিকা; ছাত্র সমাজ ও জাতীয় দায়িত্ব; অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়; ছাত্রসমাজ ও সমাজসেবা; ছাত্রসমাজ ও রাজনীতি; ছাত্রসমাজের সাংস্কৃতিক অবদান; সামাজিক সমস্যা নিরসনে ছাত্রসমাজ; শিক্ষা বিস্তারে ছাত্রসমাজ; অর্থনৈতিক উন্নয়নে ছাত্র সমাজের ভূমিকা; উপসংহার।)

ভূমিকা: ছাত্রজীবন হলো মানবজীবন গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে "Student life is seedtime of life" অর্থাৎ জীবনের বীজ বপনের সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন। প্রকৃতপক্ষে, মানব চরিত্রের মহৎ গুণাবলীগুলো আয়ত্ত করার উপযুক্ত সময় এই ছাত্রজীবন। কেবলমাত্র অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের একমাত্র কর্তব্য হতে পারে না বরং একজন ছাত্রের অধ্যয়নের পাশাপাশি নিজেকে মহৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আরো অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়। দেশ ও জাতির উন্নতির লক্ষ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্রদের সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন অপরিহার্য।

ছাত্রসমাজ ও জাতীয় দায়িত্ব: ছাত্রজীবনে অবশ্য পালনীয় দায়িত্বের প্রধান দুটি অংশ। প্রথমত, নিজেকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা; দ্বিতীয়ত, দেশ ও জাতির অগ্রগতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে যাওয়া। ছাত্ররাই হলো জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতীক, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক। ছাত্ররাই জাতির আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জাতিকে বিশ্ব দরবারে সর্বোচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে পারে। ফলে স্বভাবতই, জাতির প্রতি ছাত্রদের দায়িত্ব-কর্তব্য, অন্যান্য সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় অনেক বেশি। যুগে যুগে ছাত্ররাই দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এমনকি জাতির ভবিষ্যৎ সংকটকালেও একমাত্র আশা-ভরসা এই তরুণ প্রাণোচ্ছ্বল, নিঃস্বার্থপরায়ণ ছাত্রসমাজ।

অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়: বলা হয়- “ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ” অর্থাৎ অধ্যয়নই হচ্ছে ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। দেশ ও জাতি গঠনে অংশ নিতে হলে ছাত্রদের উচিত কঠোর অধ্যবসায়ে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা। দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে গোটা ছাত্রসমাজকে উপযুক্ত এবং সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিরক্ষর, শ্রমবিমুখ, অলস জনগোষ্ঠী কখনোই জাতিগঠনে সহায়ক শক্তি হতে পারে না বরং জাতির জন্য তারা বোঝা স্বরূপ। একটি দেশের সাফল্যের প্রথম শর্ত, সেই জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং পরবর্তী শর্ত, কঠোর ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী করে গড়ে তোলা। আর তাই ছাত্রদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব নিজেকে পরবর্তী কর্মজীবনের জন্য যোগ্য করে তৈরি করা এবং নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে দেশগঠনে অংশ নেয়া।

ছাত্রসমাজ ও সমাজসেবা: একথা সর্বজনবিদিত যে, ছাত্ররাই যাবতীয় সমাজসেবামূলক কাজে একান্ত নিঃস্বার্থভাবে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। বস্তুত সেবাধর্মের মাধ্যমে জীবনকে মহত্তর করে তুলতে ছাত্ররা সদা সচেষ্ট। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ-মহামারী, দুর্ঘটনা, যুদ্ধ-বিগ্রহে পীড়িত অসহায় মানুষের পাশে ছাত্ররাই সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কোনো প্রকার যশ বা খ্যাতি পাওয়ার আশা না করেই তারা বিপন্ন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বিশুদ্ধ পানীয়, রক্তদান, চিকিৎসাসেবা এবং ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, ছাত্রজীবনই হলো সমাজসেবা চর্চার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।

ছাত্রসমাজ ও রাজনীতি: মহাত্মা গান্ধী বলেছেন- "The Students are the future leaders of the country who could fulfill country's hopes being capable." উপমহাদেশীয় রাজনীতির অঙ্গনের একটা বড় জায়গা দখল করে আছে ছাত্ররা। এ অঞ্চলের বড় বড় আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রামগুলোর পরিচালনা করেছে মূলত ছাত্ররাই। যখনই কোনো অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে তখনই দেশ ও জাতির স্বার্থে ছাত্ররাই প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ গঠনের পেছনে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে এ দেশের ছাত্ররাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, সর্বোপরি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রসমাজ। যদিও বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে তবু ইতিহাসে এর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

ছাত্র সমাজের সাংস্কৃতিক অবদান: জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে ছাত্রসমাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের কাছে নিজেদের সৃষ্টিশীলতা দ্বারা একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতে পারে ছাত্রসমাজ। একই সঙ্গে তারা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা, শিল্প, ইতিহাস এবং ভাষাবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আর এর ফলে দেশ ও জাতির উন্নতি ত্বরান্বিত হয়।

সামাজিক সমস্যা নিরসনে ছাত্রসমাজ: দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ছাত্রসমাজ। আর তাই ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জাতীয় ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা অতি দ্রুত লাঘব করা সম্ভব। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অত্যধিক জনসংখ্যা এসব দেশের উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। দেশের ও সমাজের প্রয়োজনে ছাত্ররা জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ছোট পরিবারের সুবিধা এবং বড় পরিবারের অসুবিধাসহ জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধিতে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে নিজ নিজ এলাকায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করার মাধ্যমে ছাত্রসমাজ দেশের অজ্ঞ মানুষদেরকে সচেতন করে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো মারাত্মক সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বর্তমানে সমাজ, দেশ সর্বোপরি রাষ্ট্রের জন্যই হুমকি স্বরূপ। এর ফলে ছাত্রদের স্বাভাবিক লেখাপড়ার পরিবেশ এবং জীবনযাত্রা ব্যাহত তো হচ্ছেই জাতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যা নিরসনে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের পাশাপাশি ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অপরিহার্য। বর্তমান বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্নীতি-সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং ক্ষমতা ও আইনের অপব্যবহার। এর ফলে জাতির অস্তিত্বে সংকট দেখা দিয়েছে। ছাত্রসমাজের সম্মিলিত, কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ এসব আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশক। অতএব, ছাত্ররা ন্যায়-নীতি ও সততার দীক্ষায় দিক্ষিত হয়ে ঘুষ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহীতা, সাম্প্রদায়িকতাসহ সকল প্রকার অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জাতিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

শিক্ষা বিস্তারে ছাত্রসমাজ: শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে- “শিক্ষাই জাতীর মেরুদন্ড।” কিন্তু সচেতনতা ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে জাতি শিক্ষার আলো থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিকে নিরক্ষরতার কালো ছোবল থেকে মুক্ত করতে ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। একজন ছাত্র তার শিক্ষার আলো দিয়ে চারপাশের নিরক্ষর মানুষগুলোর জীবন আলোকিত করতে পারে। যদিও পথশিশুদের শিক্ষাদান, নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা, বয়স্কদের সাক্ষরতা প্রদান প্রভৃতি কর্মসূচিতে অনেক আগে থেকে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে আরো ব্যাপকভাবে ও বিস্তৃত পরিসরে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ছাত্ররা ছুটির সময় এবং অবসরে বয়স্কশিক্ষা কেন্দ্র, গণশিক্ষা কেন্দ্র, নৈশ বিদ্যালয় এবং অস্থায়ী বিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নিরক্ষরতা দূরীকরণে অংশ নিতে পারে। কেবল সাক্ষরতা দান করলেই চলবে না, একই সঙ্গে কৃষিবিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কুসংস্কার, স্যানিটেশন পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কেও মানুষকে সচেতন করতে হবে। এভাবে নিজ নিজ এলাকায় ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পাবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে ছাত্রসমাজের ভূমিকা: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ছাত্রসমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষি ও শিল্পে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে ছাত্ররা অংশ নিতে পারে। নিজেদের উদ্যোগে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি, মৎস্য চাষ, পশু ও হাঁস-মুরগীর খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব নিরসনেও অংশ নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ছাত্রসমাজের বিকল্প নেই।

উপসংহার: ছাত্রদের সফলতা ব্যর্থতার উপর নির্ভর করে জাতির সুখ-সমৃদ্ধি, উন্নয়ন অগ্রগতি। আমাদের দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছাত্রসমাজই অন্যতম প্রধান ভরসাস্থল। ছাত্ররা যদি সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতি গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় তবেই জাতি মুক্তি লাভ করবে এবং বীরদর্পে এগিয়ে যেতে পারবে উন্নতির পথে।
যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ ও প্রতিকার

ভূমিকা:

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।
                                                                                       (আঠারো বছর বয়স- সুকান্ত ভট্টাচার্য)

একটি দেশের যুবকদের নিয়েই যুবসমাজ। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনসমষ্টি এই যুবসমাজ। কারণ শিশু, কিশোর বা প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের ‍দিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয় না। দেশের মুক্তি ও ‍উন্নতির জন্য যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হয়। যৌবন-দূত যুবরাই জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে নবজীবনের কুসুম ফুটিয়েছে, নতুন দিনের গানে মুখর করেছে, স্বপ্নহীনদের স্বপ্ন দেখিয়েছে, আশাহতদের নতুন দিনের প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত করেছে। যৌবনদীপ্ত যুবসমাজ অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। সেই শক্তি মানুষের জীবনকে করে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। রুগ্ন, ক্লান্ত, জীর্ণ সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন উদ্যম, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্য ও অটল সাধনার প্রতীক হয়ে এগিয়ে আসে যুবসমাজ। তারা বিপন্ন মানবতার পাশে এসে দাঁড়ায় সেবাব্রতী ভূমিকা নিয়ে। যুগে যুগে দেশমাতৃকার মুক্তি ও আন্দোলন-সংগ্রামে যুবসমাজের অবদান ও মহান আত্মত্যাগ চির উন্নত, শাশ্বত ও কল্যাণকর। তাই যুবসমাজকে হতে হয় সুশিক্ষিত, কর্মনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল, সৎ, সাহসী ও মানবিক।

যুবসমাজের অবক্ষয়: ’অবক্ষয়’ শব্দের আভধানিক অর্থ বিনাশ, হানি, ক্ষতি বা ক্ষয়প্রাপ্তি। যুবসমাজের অবক্ষয় মানে যুবসমাজের ক্ষতি বা ধ্বংস। জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মানবজীবনে যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, তা যখন লোপ পায় বা নষ্ট হয়ে যায় তখনই জীবনের অবক্ষয় নেমে আসে। Youth & Development গ্রন্থে বলা হয়েছে- The decendence of the youth is due to the environmental reflection bad effects of science & technology, state’s apathy & above all, family’s indiffenence. আমাদের যুবসমাজ আজ বিপথগামী হয়ে দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যুবসমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত কর্তব্য-কর্মে, চেতনায়, মননে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে। তারা নেশার ঘোরে মানবীয় মূল্যবোধ, ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে ফেলছে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন-ভাবনা, জীবন গঠন এবং সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের অনীহা শুরু হয়েছে। যুবসমাজের এহেন অবস্থায় জাতি আজ শঙ্কিত ও চিন্তিত।
যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ: যুবসমাজের অবক্ষয় যেমন এক দিনে হয়নি, তেমনি একটি-দুটি কারণেও তা হয়নি। বহুবিধ কারণে যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়িয়ে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নিচে এর কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করা হলো-

১. নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের নীতিগত আদর্শ, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতিকে সুন্দর ও নির্মল করে, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। নৈতিক মূল্যবোধের সাথে জড়িয়ে আছে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্যধারণ, অধ্যবসায় ইত্যদি বিশেষ কতগুলো গুণ। এই গুণগুলোর চর্চার মাধ্যমেই মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটে। আর নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মানবিকবোধ জাগিয়ে তুলে মানব চরিত্রকে করে সুষমামণ্ডিত। মানুষের আত্মিক, সামাজিক উৎকর্ষ সাধনে নৈতিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। ফলে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ ও তার মাধ্যমে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা। বর্তমান যুবসমাজে এই নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টি অবহেলার বস্তু। কেউ এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের খেয়ালে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে নেমে আসছে চরম অবক্ষয়। এ দোষ শুধু তাদের নয়, যুবসমাজের নিয়ন্ত্রণ শক্তিরও। যারা তাদের পরামর্শ দিচ্ছে তারা অনেকেই নৈতিকতাসম্পন্ন, সৎ, নিষ্ঠাবান নয়। ফলে তরুণ সমাজ তাদের কথা শুনে বিভ্রান্ত হচ্ছে। পরীক্ষায় পাস আর ডিগ্রি অর্জনের শিক্ষাতেও যুবসমাজ খুঁজে পাচ্ছে না নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের সুশিক্ষ।

২. অর্থনৈতিক বিপর্যয়: নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, হিংসা, দ্বেষ বাড়ছে। আত্মবুদ্ধি, স্বার্থবুদ্ধিতে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে আমাদের নতুন সমাজ নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতার ভূমিকা রয়েছে।

৩. রজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফলে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধিতে, শিক্ষাক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়, মানুষের মৌল-মানবিক চাহিদার টানাপড়েনে ঐ দেশের যুবসমাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের চিন্তায় ও চেতনায় অস্থিরতা দেখা দেয়। তারা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারে না। এভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের যুবসমাজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তারা মাতৃভাষাকে রক্ষা ও মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু তাদের এই শক্তি এখনও দেশ গঠনের কাজে ব্যবহৃত হয়নি। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অস্থিরতা। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি, পরমসহিষ্ণুতার অভাব, কালো টাকার দাপট, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার জাতীয় দাবির প্রতি অনীহা প্রভৃতি আজকের যুবসমাজকে হতাশ ও বিপথগামী করে তুলছে। ফলে তারা আত্মবিকৃত হয়ে নৈতিক অধঃপতনের মধ্য দিয়ে অনৈতিক, অসৎ, সন্ত্রাসের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

সমাজে সৎ মানুষের অবমূল্যায়ন: বর্তমানে সৎ ও ভালো মানুষের মূল্য নেই। সমাজে তার সম্মান নেই। কেউ তাকে সমীহ করে না। অফিস-আদালতে তাকে মস্ত বোকা, বদ্ধ উন্মাদ ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করা হয়। ফলে সমাজের ভালো মানুষগুলো তাদের নীতি, আদর্শ প্রচার করতে পারে না। সমাজের কল্যাণকর কাজ নিয়েও তারা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না। আর একদল লোক সমাজ সেবার নামে নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েও সমাজের সর্বোচ্চ আসন লাভ করে, লোকের কাছে থেকে সম্মানের মুকুট পায়। তরুণ সমাজ অবাক বিস্ময়ে তা প্রত্যক্ষ করে। সমাজবিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি তারা প্রত্যক্ষ করে সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মুল্য অতি চুচ্ছ হয়ে ওঠে। সততা সেখানে লাঞ্ছিত ও অসহায় বিবেক সেখানে বর্জিত। এসব কারণে তরুণরা সত্য, ন্যায়, কল্যাণের পথ ছেড়ে অন্ধকার পথে এগিয়ে যায়। আত্মস্বীকৃতি, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে তারা অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়ায়।

অবক্ষয়ের উপাদানের প্রভাব: পরিবেশ মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। চারদিকে অস্থির পরিবেশ যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। যুবসমাজকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে একশ্রেণির ক্ষমতা ও অর্থলোভী লোক। তাদের কূটবুদ্ধির চালে পড়ে তরুণরা তাদের সম্ভাবনাময় জীবন নষ্ট করছে। স্বার্থবাদীরা যুবাদের নিয়ে নানা রকম অবৈধ কাজ করাচ্ছে, অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তরুণরা না চাইতে পেয়ে যাচ্ছে কার্যক্রম পরিচালনার অভয়, অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, আশ্রয়, প্রশ্রয় এসব উপাদান যুবসমাজকে ক্রমশ অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

৬. বেকারত্বের প্রভাব: বেকারত্ব একটি দেশের জন্য মারাত্মক অভিশাপ। লেখাপড়া শেষ করে কর্মক্ষম হয়ে যারা কাজের অভাবে বসে থাকে তারাই বেকার। বেকার জীবন নানা রকম হতাশা আর যন্ত্রণায় ভরা। এদেশের প্রায় দুই কোটি শিক্ষিত বেকার রয়েছে। যাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। উপার্জনের জন্য সামান্য কাজ ও অবলম্বন না পেয়ে তারা অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। দীর্ঘসময় এ অবস্থা চলতে থাকলে বেকারত্বের ক্ষোভ থেকে তারা অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয়। তারা খুন, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি নানা অপরাধমূলক জঘন্যতম কাজে লিপ্ত হয়। সুতরাং যুবসমাজের অবক্ষয়ের পেছনে বেকারত্বও বিশেষভাবে দায়ী।

৭. বিভিন্ন বিনোদন মাধ্যমের প্রভাব: সুস্থ বিনোদন মানুষের কল্যাণ করে। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংলগ্ন করে। মানুষের মনবীয় নৈতিকতাবোধ উন্নীত করার ক্ষেত্রেও সুস্থ বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সিনেমার চটুল কাহিনিতে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অস্লীল নৃত্য-গীত, নায়ক-নায়িকার উদ্দাম প্রণয়চিত্র, খুন-জখম, রাহাজানি-ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। তরুণ-তরুণীর ঐসব উদ্ভট ও অবাস্তক জীবনকেই অনেক সময় বাস্তব জীবন বলে ভুল করে এবং সিনেমা জগতের কায়দাকানুন ও পোশাক-আশাক অন্ধভাবে অনুসরণ করতে দিয়ে অপসংস্কৃতির শিকার হয়। টেলিভিশনে কথা ভাষায় নাটক পরিবেশনায়, প্রেমিক-প্রেমিকার সংলাপ ইত্যাদিতে যৌ-নাবেদনকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। খুন, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি তথ্যচিত্র এবং সেগুলোর সাথে জড়িতদের যথার্থ শান্তি না হওয়া যুবসমাজকে অপরাধের দিকে টানছে। ফ্যাশন, আধুনিকতা, বিজ্ঞাপনের নামে সর্বত্র চলছে পর্নোগ্রাফি। ফলে যুবসমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবমান। ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পর্নোচিত্র, মুভি দেখছে। সাইবার ক্যাফে বসে সঙ্গী/সঙ্গিনকে নিয়ে পর্নোগ্রফি উপভোগ করছে। অন্যদিকে অশ্লীল পত্রপত্রিকা ও ছবি খুব সহজপ্রাপ্য হওয়ায় তা সহজেই ব্যবহার করছে। ফলে আমাদের যুবসমাজ নৈতিক চরিত্র হারিয়ে অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

৮. পারিবারিক ভাঙন ও নিঃসঙ্গতা: যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম একটি কারণ পারিবারিক ভাঙন ও নিঃসঙ্গতা। পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ করে বাবা-মার সহনশীল আচরণ, প্রেম, ভাব, ভালোবাসার পরিবর্তে অবিশ্বাস ও হিংসাত্মক মনোভাব থাকলে তা সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। বাবা-মার ঝগড়া-বিবাদে সন্তানের মনে কষ্ট জমা হতে হতে সে বিপথে পা বাড়ায়। পারিবারিক অশান্তি ভুলতে নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার নিঃসঙ্গতায় যুবসমাজ হতাশা-যন্ত্রণা ভুলতে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। কেউ জীবনের মূল্য ও মর্যাদা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে অন্যায় পথে এগিয়ে যায়। বিবাহবিচ্ছেদ, প্রেম প্রত্যাখ্যান, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট মানসিক সমস্যার কারণে যুবসমাজ অনেক সময় তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে না। ফলে তারা নানা রকম অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। এছাড়া যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে আমরা দেখি-ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অসৎ সঙ্গ, নগরজীবনের একঘেয়েমি, নির্মল আনন্দ-বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, মানবিক মূল্যবোধ তৈরির নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদিকে।

যুবসমাজের অবক্ষয় প্রতিকারে উপায়: যুবসমাজকে সুসংগঠিত করে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে হলে তাদের মধ্যে নীতিজ্ঞান সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। কারণ যুবরাই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং জাতির কর্ণধার। কাজেই তাদের অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সচেতন মহলকে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ ও প্রতিকারের জন্য আমরা নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। যথা-

১. মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ: যুবসমাজকে অবক্ষয়ের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। মূল্যবোধ জাগ্রত হলে তারা ভালো-মন্দ বুঝতে পারবে। তাহলে তারা আর অসহিষ্ণু, অমানবিক হয়ে উঠবে না। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে শিখবে। মূল্যবোধের জাগরণ ঘটলে অবক্ষয় রোধ হবে এবং যুবসমাজ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

২. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন: একটি দেশের যুবসমাজের অবক্ষয় রোধকল্পে রাজনৈতিক স্থিতিশীরতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেশিরভাগ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় না। ফলে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে যুবসমাজ দারুণভাবে প্রবাবিত হয়। তারা নানা অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীরতা অর্জিত হলে অবক্ষয় অনেকাংশে রোধ হবে; তরুণ সমাজ সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পাবে।

৩. আদর্শবান ব্যক্তির মূল্য-মর্যাদা বৃদ্ধি: সমাজে আদর্শবান সৎলোকের মূল্য ও মর্যাদার দিকটি যুবসমাজের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই তাদের সামাজিক মূল্য বাড়াতে হবে। অসৎ ও অন্যায়কারীকে বয়কট করতে হবে। নৈতিকতা, কল্যাণকর জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। অন্যায়কারী সুচতুর ব্যক্তির মুখোশ খুলে দিতে হবে। তাহলে যুবসমাজ পেশিশক্তি, মিথ্যা ও অন্যায়ের পথ পরিহার করে নৈতিকতাবোধে উন্নীতি হবে।

৪. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা: বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে যুবসমাজ নৈতিকতা পরিহার করে অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। তাই তাদের যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে প্রায় দুই কোটি বেকার রয়েছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে অবক্ষয় রোধ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ বেকারত্ব তাদের সমস্ত শুভ চিন্তার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বেকারত্বের হতাশা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলে তারা অন্যায় পথ থেকে সরে আসবে। কাজেই বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

৫. অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ: যুবসমাজকে সংস্কৃতিবান করে গড়ে তুলতে পারলে তারা নির্মল আনন্দ-বিনোদনের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং অশ্লীল নাচ, গান, প্রণয়কাহিনি কিংবা পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ হারাবে। এগুলোর জন্য বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সজাগ ও সচেতন হবে হবে। যুবসমাজকে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংলগ্ন করতে হবে। হাজার বছরের পুরনো বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাদের অনুরাগী করতে পারলে তারা বিজাতীয় অপসংস্কৃতি পরিহার করবে। তাতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ হবে।

৬. সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা: শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি মনের জন্য প্রয়োজন বিনোদন। সুস্থ বিনোদন মনকে সুন্দর করে ও আনন্দে ভরিয়ে দেয়। সুন্দর মনের আনন্দ উচ্ছলতায় কোনো ব্যক্তি অন্যায়ের পথে পা বাড়ায় না। কাজেই সুস্থ বিনোদন হিসেবে টেলিভিশনে অশ্লীলতাবর্জিত অনুষ্ঠান, সিনেমা, নাটক ইত্যাদি প্রচার করতে হবে। প্রেক্ষাগৃহে অশ্লীল নৃত্য, সংলাপ এবং বাস্তবতাবর্জিত কাহিনিহীন ছবির পরিবর্তে সুস্থ ধারার ছবি প্রদর্শন করতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানে এমন সব বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে। কুরুচিপূর্ণ আপত্তিকর পোশাক পরিহার করার জন্য যুবসমাজকে সচেতন ও অনুপ্রাণিত করতে হবে।

৭. সমাজকল্যাণমূলক কাজের প্রসার: যুবসমাজকে সমাজকল্যাণমূলক কাজে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার সময় ও সুযোগ কম পাবে। যুবকদের দ্বারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নানা রকম সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগানো যায়। যেমন- বৃক্ষরোপ অভিযান, অধিক খাদ্য ফলাও কর্মসূচি, শিশু ও নারী শিক্ষার প্রসার, প্রাথমিক চিকিৎসা সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এই বিষয়ে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে যুবসমাজ অবক্ষয়ের হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে।

৮. পারিবারিক ভাঙন রোধ: পারিবারিক কারণে যেন একজন যুকব বা যুবতি অপরাধপ্রবণ বা আত্মবিকৃতির পথে অগ্রসর না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিবারের দায়িত্ব হবে তার সন্তানটির বা পরিবারের তরুণটির কোনো ক্ষতি না হয় বা তারা ক্ষতির কারণ হয় এমন কাজ থেকে বিরত রাখা। একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে ডুবে না থেকে বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে তার সন্তানটি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছে কি না। সন্তানটির জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রতি বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে।

উপসংহার: যুবসমাজ একটি দেশের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। এ শক্তির অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে দেশ অচল হয়ে পড়বে। বর্তমানে বেকারত্ব বিজাতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, রাজনৈতিক অস্থিরিতা প্রভৃতি কারণে এদেশের যুবসমাজ দিশেহারা। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের এহেন অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে হবে। না-হলে জাতির ভবিষ্যৎ অচিরেই তলিয়ে যাবে অন্ধকারের অতল গভীরে। তাই যেকোনো মূল্যে এদেশের যুবসমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আর তা করতে পারলে আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান

ভূমিকা: এখন বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে বহুদূর পর্যন্ত। বিজ্ঞানের অব্যাহত অভিযাত্রা দুনিয়ার মানুষকে দিয়েছে অনেক বিস্ময়কর উপহার, আবার অভাবনীয় মৃত্যুর যন্ত্র বা মারণাস্ত্র। বিজ্ঞান শুধু দানই করে নি, কেড়েও নিয়েছে। আবার সুসাহিত্যিক যাযাবর বলেছেন, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। আবেগ কিন্তু কবি সাহিত্যিকদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। মানবসভ্যতার শুরু থেকে যে দিন মানুষ গুহা ছেড়ে সমতলে এল, গাছের ডাল বেয়ে মর্তে নেমে এল, তখন থেকে বিজ্ঞান পর্যায়ক্রমে দিয়েই যাচ্ছে। প্রথমে দিল আগুন, এর পর চাকা এবং এমনি করে আজকের সবচেয়ে বিস্ময়কর কম্পিউটার পর্যন্ত। মানবসভ্যতার অগ্রসরতা এগিয়েছে বিজ্ঞানের হাত ধরে। আর বিজ্ঞানের অগ্রসরতার চাকা বহুদূর বহুবার ঘুরেছে, পৃথিবীকে দিয়েছে অভাবনীয় পরিবর্তনের বিস্ময়কর স্বাদ। মানবসভ্যতার বিভিন্ন শাখা প্রশাখার সমোজ্জ্বলতার সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা চিকিৎসাশাস্ত্রকেও বিজ্ঞান নব নব দানে সমৃদ্ধ করেছে। আমরা জানি “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল” অথাৎ, অতিবড় ধনবানেরও শরীর স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে তার অতুল ঐশ্বর্য কোন কাজে আসে না। আর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চাই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা বা উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। বিজ্ঞান এক্ষেত্রে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পরম বন্ধুর মতো। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ মুক্তি পেয়েছে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে। মানুষের যে কয়টি মৌলিক অধিকার, তার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। পূর্বে মানুষের চিকিৎসা ছিল প্রকৃতিনির্ভর। সে সময় বিজ্ঞানভিত্তিক বা বিজ্ঞানসম্মত কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। মানুষ তখন কবিরাজ, ওঝা, পীর, ফকির ও তাদের দেয়া গাছগাছড়া, দোয়া-তাবিজ, পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক প্রভৃতির ওপর একান্ত নির্ভরশীল ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে তাদের সফলতা ছিল না, তা নয়। তবে তা অকিঞ্চিৎকর।

প্রাচীনকালের চিকিৎসা ব্যবস্থা: মানুষ প্রাচীনকালে প্রকৃতির কাছে একেবারেই অসহায় ছিল। তখনকার দিনে চিকিৎসাও ছিল প্রকৃতিনির্ভর। মানুষ তখন প্রকৃতির গাছগাছড়া, লতাপাতা, দোয়া-কালাম, তাগাতুগা, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া প্রভৃতির ওপর আস্থাশীল ছিল এবং অনেক জটিল রোগেও তারা এসব জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করাত। বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে মানুষ তখন জটিল রোগে মারা তো যেতই, এমনকি সাধারণ রোগেবালাইতেও মারা যেত। শুধু মানুষই নয়, গৃহপালিত পশুপাখি জীবজানোয়ারও মারা যেত। সেদিনের প্রেক্ষিতে এসমস্ত রোগবালাইকে ’মড়ক’ বলা হতো। তখন কলেরা বসন্ত প্রভৃতির মতো রোগেও শত শত এমনকি হাজার হাজার মারা গিয়ে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, সেজন্যই মানুষ তখন এসব অবস্থাকে ’মড়ক’ বলতো।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার শুরু: বিজ্ঞান যখন মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ক্রমে তাকে কিছু কিছু করে উপহার দানে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ করেছে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সে দান ছিল অবারিত। পুরাতন সব চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তে এসেছে নতুন নতুন সব চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সামগ্রী, ওষুধপত্র প্রভৃতি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রাচীন ও ধ্যানধারণাকে পেছনে ফেলে নতুন সব ধ্যানধারণা ও প্রযুক্তি চিকিৎসা জগতকে দান করে সেক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছে।

চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান আজ যুগান্তর ঘটিয়েছে। দুরারোগ্য সব রোগব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা আজ বেশ কমে গেছে। আবিষ্কৃত হয়েছে যুগান্তকারী সব ওষুধপত্র যেমন- স্ট্রেপটোমাইসিন, ক্লোরোমাইসিন, পেনিসিলিন, স্কেলোমাইসিন, প্যারাসিটামল প্রভৃতি ওষুধ এক্সরে, ইসিজি, এন.জিও গ্রাম প্রভৃতি সব আবিষ্কার আজকে মৃত্যুপথযাত্রী সব রোগীকে নতুন জীবনে আশ্বাসে বলীয়ান করেছে। কর্নিয়া সংযোজন, বৃক্ক, অস্থিমজ্জা, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও যকৃতের মতো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে চিকিৎসাশাস্ত্র আজ বিজ্ঞানের অবদানে সমৃদ্ধ। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন পূর্বের তুলনায় হাজার গুণে উন্নত। অতিকম্পনশীল শব্দ এবং লেসার রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে, রেডিয়াম আবিষ্কার করে তাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান এমন এক বিপ্লব, এনেছে যার দ্বারা শরীরের অভ্যন্তরে কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কী অবস্থা তা দেখা যাচ্ছে, রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অপটিক ফাইবার ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগ নির্ণয় করা যায়। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান চিকিৎসা জগতে কী যে এক বিপ্লব সাধন করেছে, তা বলে শেষ করার নয়, এতে যেমন করে মূত্রথলি ও পিত্তথলির পাথর চূর্ণ করার কাজে সফলতা এসেছে, তেমনই সফলতা পেয়েছে বহুমূত্র রোগীর অন্ধত্ব প্রতিরোধের। সবশেষে কম্পিউটার প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তাতে চিকিৎসা শাস্ত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করা সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞান আজ শুধু রোগীর রোগ নির্ণয়েই শেষ করে নি, সে মানুষের জন্মপূর্ব রোগ নির্ণয়েও অবদান রাখছে।

রোগ প্রতিরোধে বিজ্ঞান: Prevention is better than cure. অর্থাৎ, রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা শ্রেয়- এ প্রবাদটি বেশ পুরাতনই। রোগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই যদি তাকে প্রতিহত করা যায় তাহলে মানুষ অতিরিক্ত ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। এমন চিন্তাধারা থেকেই রোগ প্রতিরোধে এগিয়ে আসে বিজ্ঞান আর যক্ষ্মা, হুপিং, কাশি, ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়া, হাম, বসন্ত, কলেরা প্রভৃতি মারাত্মক রোগের প্রতিরোধ করতে বিজ্ঞান সফলতা দেখিয়ে মানবজগতকে বিস্মিত করেছে। একটু সচেতন হলে আজকের যে ভয়াবহ রোগ AIDS থেকেও মানুষ রক্ষা পেতে পারে।

রোগ নিরাময় করতে বিজ্ঞান যেসব আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে উপহার দিয়েছে তা অতুলনীয়। যুগান্তকারী সব ওষুধ আবিষ্কারের ফলে জটিল সব রোগের চিকিৎসা তো সহজতর হয়েছেই, সাধারণ রোগ যেমন- জ্বর, সর্দি, কাশি, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার ইত্যাদি সব সাধারণ রোগবালাই থেকেও বিজ্ঞানের অবদানে মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। এজন্য হেনরি ডেভিড বলেছেন, ”বিজ্ঞান বিশ্বসভ্যতায় অনেক বিস্ময়কর উপহার দিয়েছে।” আর এই বিস্ময়ের অন্যতম হলো আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।

জটিল রোগের ক্ষেত্রে: এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানুষ আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে তথা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে অনেক অনেক জটিল ও দুরারোগ্য রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছে। অনেক মুমূর্ষু রোগীও কঠিনতর রোগ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন আশায় নবতর সঞ্জীবনী মন্ত্রে উজ্জীবিত হচ্ছে। কুরি দম্পতি আবিষ্কৃত রেডিয়াম ক্যান্সারের মতো No Answer এর ন্যায় মারাত্মক রোগেরও চিকিৎসা সম্ভব করেছে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণেই আজ মানুষ একজনের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অন্যজনের দেহে প্রতিস্থাপন করছে। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে মানুষ তার চেহারা বা আকৃতির পরিবর্তন করছে। এসবই সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে।

বিজ্ঞান আজ চিকিৎসা ক্ষেত্রের বড় আশীর্বাদ: বিজ্ঞান সৃষ্টির আদিকালে যখন মানুষ ঘোর তমসার তিমির কেটে কেটে অরুণোদয়ের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে আসছিল তখন থেকে শুরু করে অদ্যবধি মানুষকে শুধু একটি বিস্ময় উপহার দিয়েই চলেছে। অনেক অনেক অসাধ্যকে, অনেক অনেক দুঃসাধ্যকে আজ হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। তবে বিজ্ঞান শুধু মানবসভ্যতাকে তথা বিশ্বসভ্যতাকে আশীর্বাদই উপহার দেয় নি, সে অভিশাপও বয়ে এনেছে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে শুধু আশীর্বাদই দান করেছে। তবু মানুষ তার উল্টো ব্যবহার করে নিজেকে ধ্বংস করছে, নেশায় বুদ হয়ে তিলে তিলে নিজেকে ক্ষতির শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রুডিয়াড কিপলিং বলেন, ”বিজ্ঞানের আশীর্বাদ বিশ্বমানবতা কখনো উল্লসিত হয়েছে, আবার অনেক সময় তার ভয়ঙ্কর রূপে থমকে গিয়েছে। কিন্তু তুলনামূলক চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান দিয়েছে শুধু আশীর্বাদ।”

উপসংহার: যুগ ও কালের চাকা ঘূণনের আবর্তে বিশ্বসভ্যতা বিকশিত হচ্ছে শিমুল ও পলাশ ধারায়, মানবসভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে চিকিৎসা ক্ষেত্রে পেয়েছে বিস্ময়কর উন্নতি। বলা চলে মানুষ প্রায় মৃত্যুকে জয় করেছে, করেছে করায়ত্ত।
 বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য

‘এমনি স্নিগ্ধ নদী কাহার? কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়?
কোথায় এমন তরিৎক্ষেত্র আকাশতলে মেশে?
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে?’

সে আমারই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা, সাগর-মেখলা, বন-কুন্তলা সোনার দেশ- বাংলাদেশ। প্রকৃতি তার উদার অকৃপণ হাতে অপরূপ সৌন্দর্য আর মাধুর্য ছড়িয়ে সমৃদ্ধ হরেছে এ দেশকে।

বাংলাদেশ এক লাখ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশ সত্তর বর্গ কিলোমিটারের ছোট একটি দেশ। গাঙ্গেয় অববাহিকায় সাগর থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এ দেশ উর্বর পলিমাটি-সমৃদ্ধ। উত্তরে ভাওয়াল ও মধুপুর গড়। গেরুয়া রঙের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গজারি গাছ। দক্ষিণে ৪৪৫ মাইলব্যাপী বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবন। পুবে আসামের শ্রেণীবদ্ধ পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে ঠিক যেন দেহরক্ষীর মতো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাজানো চা বাগান। এরই মাঝে মাঝে বিশাল সব ছায়াবৃক্ষ। পাশ দিয়ে বয়ে চলে পাহাড়ি নদী। রুপালি মাছেরা আনমনে খেলা করে সেই নদীতে। পশ্চিমে ধু-ধু প্রান্তর। প্রকৃতির রুক্ষতার মধ্যেও এখানে দেখা যায় সারি সারি আম্রকানন, আখের ক্ষেত কিংবা পানের বরজ।

সমতল বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত হলেও দক্ষিণের পার্বত্য জেলাগুলোতে এবং সিলেট আর ময়মনসিংহের সীমান্ত আছে পাহাড়ি এলাকা। তাই সাগরের গর্জন মুখরতা, পাহাড় আর বনাঞ্চলের সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধতা নদীমাতৃক এ দেশকে করেছে বৈচিত্র্যময়, রূপসী। তাই মনের অজান্তেই মন গেয়ে ওঠে-

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবন। এর রয়েছে বিশ্ব পরিচিতি। সুন্দরবনকে ঘিরে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র জীবনধারা। বিশ্বের সেরা প্রজাতির গাছপালা-সমৃদ্ধ সুন্দরবন মূলত ‘সুন্দরী’ গাছের জন্যে বিখ্যাত। সুন্দরবনের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ আর চিত্রল হরিণ বিশ্বে অনন্য। নদীতে আছে কুমির। এ ছাড়াও আছে নানা জাতের পাখি আর অজগর সাপ। সব মিলিয়ে সুন্দরবনে ঘটেছে ভয়ংকর আর সুন্দরের বিচিত্র সমাবেশ।

দক্ষিণে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈকত। ফেনিল সাগরের মাঝখানে জেগে ওঠা দ্বীপগুলোয় সারি সারি নারকেল আর সুপারি বাগান। সাগরের সাথে দ্বীপাঞ্চলবাসীর অপূর্ব মিতালি। মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ সাগর ভুলে যায় সে কথা। প্রবল আক্রোশে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব। তবুও নতুন আশায় বুক বাঁধে এখানকার অকুতোভয় মানুষ। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে আবার দুলে ওঠে জেলে নৌকা। রাতে এসব নৌকায় জ্বলে লণ্ঠনের আলো। আকাশ ভেঙে জ্যোৎস্না নামে।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে সীমাহীন সৌন্দর্যের সমাবেশ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আদিবাসীদের বসবাস। এরাও প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার।

হাতে গোনা শহরগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশ বলতেই গ্রাম বাংলা। এই গ্রাম বাংলার অপরূপ রূপবৈচিত্র্যে এ দেশ গর্বিত। গ্রামের সৌন্দর্য নিটোল, এতটুকু কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই তাতে। যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ মাঠ, কোথাও কোথাও সবুজের অবগুণ্ঠন ভেদ করে সোনালি শস্যের উঁকিঝুঁকি। মেঠো পথের ধারে হয়তো বা মৌনী তাপসের মতো দাঁড়িয়ে ছায়া দিচ্ছে বিশাল বট কিংবা অশ্বত্থ গাছ। গাছপালায় ঘেরা ছোট ছোট ঘরগুলো ‘ছায়া সুনিবিড়’ শান্তির নীড়। পুকুর, নদী, বিল কিংবা ঝিলে কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ কালো জল। ফুটে আছে শাপলা- সাদা, লাল কিংবা গোলাপি। এরই পাশে হয়তো একাঝাঁক রাজহাঁস আপন মনে খেলছে জলের খেলা। ঠিক দুপুরে কাছেই কোথাও একটানা ডেকে চলেছে আসল বিরহী ঘুঘু। ক্লান্ত রাখাল গরু চরানোর ফাঁকে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বাঁশিতে তুলছে অপূর্ব সুর। গ্রাম বাংলার এই অকৃত্রিম সৌন্দর্যে রূপমুদ্ধ কবি গেয়েছেন-

’অবারিত মাঠ, গগন ললাট, ‍চুমে তব পদধূলি
ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ
স্তব্ধ অতল দীঘি কালো-জল নিশীথ শীতল স্নেহ।’

গ্রাম বাংলার সন্ধ্যার রূপটি আরোও মধুময়। গোধূলি বেলায় রাখাল মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফেরে। দিনান্তে কাজ শেষে গাঁয়ের চাষি ঘরে ফেরে, পাখিরা ফেরে নীড়ে। সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায়। চারিদিকে এক অপার্থিব আলো। দুরে নীল আকাশের বুক চিরে দল বেঁধে উড়ে যায় বলাকারা। রাতে বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ ওঠে। ঢেলে দেয় জ্যোৎস্নার আলো। নিকোনো উঠোনে গাছের ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্নার আলো নানা আকৃতি নেয়, চলে আলো-আঁধারির অপূর্ব খেলা।

নদীমাতৃক বাংলার মাটিকে উর্বর করেছে অসংখ্য নদী-উপনদী। শীতে নদীগুলো খানিকটা শুকিয়ে এলেও বর্ষায় যেন নতুন প্রাণ পেয়ে দুকূল ছাপিয়ে যায়। নদীপথে তখন সাদা পাল উড়িয়ে সারি সারি নৌকো চলে। সে এক- অভাবনীয় সৌন্দর্য। যেন একপাল রাজহাঁস ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে।

বিভিন্ন ঋতুর রূপবৈচিত্র্যে বাংলাদেশের নৈসর্গিক দৃশ্যের বিরাট পরিবর্তন ঘটে। পালাবদলের খেলায় বৈচিত্র্যময় রূপের পসরা নিয়ে আসে ছয় ঋতু।

গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ ও বিশুষ্ক হয়ে ওঠে। চিড় ধরে মাটিতে, হারিয়ে যায় অপরূপ সবুজ প্রকৃতির শ্যামল শোভা। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে, ধুলোর ঝড় তুলে আসে কালবৈশাখী। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে হার মানে গাছপালা। ভেঙে মুচড়ে যায়। রুক্ষতা আর কঠোরতার মধ্যেও প্রকৃতি এ সময় ডালি ভরে সাজিয়ে দেয় বিচিত্র সব ফল।

প্রচণ্ড রুক্ষতার পর সজল কালো মেঘময় দিনের ছায়া নামে বাংলাদেশে। পালটে যায় প্রকৃতির চেনা রূপ। বৃষ্টির অঝোর ধারায় গাছে গাছে পাতায় পাতায় লাগে শিহরণ, জাগে সজীবতা। কেয়া, কদম আর যূথীফুল পাপড়ি মেলবার প্রতিযোগিতায় মাতে। কালো মেঘের দল পলকে হানে বিদ্যুৎ-বাণ। বৃষ্টিস্নাত গ্রামগুলোকে মনে হয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপ। জলের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ধান আর পাটের সবুজ চারা। প্রবল বর্ষণে কখনো কখনো নেমে আসে বন্যা। তখন গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়- হয় ফসলহানি।

শরতের প্রথম দিকে সারাদিন চলে মেঘ বৃষ্টি আর আলোর লুকোচুরি খেলা। এই খেলা খেলতে খেলতেই বর্ষার কালো মেষের দল কোথায় যেন একেবারে লুকিয়ে যায়। ঝকঝকে নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেষ পাল তুলে ভেসে বেড়ায়। সারারাত ফুটে ফুটে ভারবেলায় ঝরে পড়ে শিউলি। নদীতীরে কাশফুল শুভ্র হাসি ছড়িয়ে দেয় দিগন্ত।

হেমন্তে ঘরে ঘরে ফসল ওঠে। ঢিঁকির তালে তালে ধান ভানার গানে গানে গ্রামগুলো মুখরিত হয় নবান্ন উৎসবে। সকালের সোনালি রোধে যখন সোনালি ধানের ডগা বাতাসে দোল খায় তখন মনে হয় চারদিকে সোনা ছড়ানো। পিঠে-পুলির উৎসবে মুখরিত হলেও হেমন্তে প্রকৃতি থাকে শান্ত, সৌম্য।

উৎসব প্রমত্ত বাংলার বুকে শীত বুলিয়ে দেয় হিমেল হাওয়া। ভোরের ঘন কুয়াশার আবরণের অন্তরালে প্রকৃতি তার সমস্ত রূপসজ্জার অলংকার ছুঁড়ে ফেলে রিক্ত বৈরাগীর রূপ নেয়। গাছপালা হারায় সজীবতা। শুরু হয় পাতা ঝরার পালা। অন্যদিকে নানারকম শাকসবজি আর রঙ-বেরঙের ফুলের শোভায় প্রকৃতির মালঞ্চ ভরে ওঠে।

শিশিরসিক্ত যেসব পাতা পড়ি পড়ি করেও পড়ে নি হঠাৎ একদিন দখিনা পবনে সেগুলো ঝরে যায়। প্রকৃতিতে দারুণ চাঞ্চল্য জাগে। গাছে গাছে কোথা থেকে আবার ফিরে আসে পাখিরা। গাছের শূন্য শাখা-প্রশাখা নতুন সবুজ কিশলয়ে বিকশিত হয়। অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের গাছে যেন লাল ফুলের আগুন লাগে। শেষ বিকেলের ‘কনে দেখা আলো’ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখা যায়। রাত একটু গভীর হতেই লাখো তারায় ছেয়ে যায় আকাশ। একসময় চৈতালি ঝড় ওঠে। উড়িয়ে নেয় পাতা ফুল- সব। বোঝা যায়, আবার আসছে গ্রীষ্ম।

বিচিত্র আর অফুরন্ত সৌন্দর্যের ডালি সাজানো এই বাংলাদেশ। দুচোখ ভরে যায় তার স্নিগ্ধতায়, মনকে ভাবুক করে তোলে তার অফুরন্ত সৌন্দর্য। তাই দৈনন্দিন প্রাত্যহিকতা ছাপিয়ে মানুষ হয়ে ওঠে ভাবুক। প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়ানো আল্পনা আমাদের মনেও ক্যানভাসে বুলিয়ে দেয় নানা রঙের তুলির ছোঁয়া। তাই হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে উঠে আসে গভীর এক বোধ-

‘তোমার যেখানে সাধ চলে যাও
আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব।’
দেশভ্রমণ

ভূমিকা:
‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে।’
                                 -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দেশভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহতের আহ্বান। আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ। অচেনার সান্নিধ্যে তার মনে লাগে বিস্ময়ের শিহরণ। ভুলে যায় প্রতিদিনের তুচ্ছতা। প্রয়োজনের পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারে না। দেশভ্রমণের নেশা তাকে টেনে নিয়ে যায় প্রকৃতির অবারিত মুক্তাঙ্গনে। অজানাকে জানার জন্যে, অদেখাকে দেখার জন্যে; আমাদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে অপরিচিত জগৎকে দেখার জন্যে- অন্তরের আকুল আগ্রহে আনন্দ অনুভব করি। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন-
 ‘Travelling makes one know the mystery of Lord’s creation. Travelling gets us self-confident.’

ভ্রমণের আনন্দ: ভ্রমণের আনন্দের আকর্ষণই ভাইকিংদের ভেলায় ভাসিয়ে শ্বেত ভালুকের দেশ নোভাস্কাশিয়ায় নিয়ে গেছে, মার্কো-পোলো ভাসতে ভাসতে এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্তূপ পেরিয়ে চীনে, ইবনে বতুতাকে ঘরছাড়া করেছে এশিয়া-আফ্রিকার দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁদের মনের গতির নেশায় বেজে উঠেছিল বিপুল সুদূরের ব্যাকুল বাঁশরীর মধুর ধ্বনি এবং সেই ধ্বনির কুহক হাতছানিতে দিগ্-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মায়াময় গৃহকোণ ত্যাগ করে অজানা পথে যাত্রা করেছিলেন। তাঁদের এই দুঃসাহসিক অভিযান মানবকুলকে ভ্রমণের নেশায় অনাদিকাল ধরে উদ্দীপ্ত করে যাবে।

বৈচিত্র্যের নেশা: দিনের পর দিন একই পরিবেশে জীবন-যাপন করে আমাদের মন বিষিয়ে ওঠে। আমরা তখন একটু বৈচিত্র্যের আস্বাদ পেতে চাই। দেশভ্রমণ সেই বৈচিত্র্য এনে দিয়ে আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ। দেশান্তরিত পথিক যখন নতুন দেশের কোনো নতুন শহরে পদার্পণ করে তখন তাঁর কাচে মনে হয়- ‘আহা! কি সুন্দর।’ সুন্দর মনে যে সর্বদাই সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে তা নয়, নতুনত্বও হতে পারে একটা বিশেষ সৌন্দর্য, আনন্দ দেওয়ার একটা বিরাট কারণ। মার্কিন পরিব্রাজক যখন ইতালির কোনো ঘিঞ্জি শহরে পদার্পণ করে তখন তিনি এই নতুনত্বের আনন্দেই হন উদ্বেলিত।

যেসব ব্যস্ত মানুষ সমুদ্রতীরে কোনো অচেনা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পানীয়ের ফরমাশ দেন, তখন তাঁর মনে যে দৃষ্টির উদয় হয় সম্ভবত সেটা সাগরতলার কোনো রূপকথার রেস্তোরাঁ যেখানে পানীয় পরিবেশন করছে মৎস্যকন্যা। মরুভূমির শুষ্ক-শূন্যতা থেকে যখন কোনো আরব স্নিগ্ধ-শ্যামলিমার দেশ বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, তখন তিনি অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করেন প্রকৃতির এই পূর্ণতা-এই বিস্ময়ই তাঁর আনন্দ। আবার তপ্ত মরুতে চোখ-ধাঁধানো মরীচিকা, বহু যোজন পরে আকস্মাৎ এক ঝরনাবিধৌত মরুদ্যান যে আনন্দ বয়ে আনতে পারে, ভ্রমণ-নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া পথিকই তাঁর রস আহরণ করতে পারেন। তাই মনকে উৎসাহিত করার জন্যে দেশে দেশে চিত্তাকর্ষক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে।

শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেশভ্রমণ বা দেশভ্রমণের উপকারিতা: দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ। নানা দেশ ও সেখানকার মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে আমরা নানাবিধ অভিজ্ঞতা লাভ করি এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করি। পৃথিবীর কত যে বিচিত্র স্থান আছে, তার বৈচিত্র্যের কথা বই পড়ে সবটুকু জানতে পারি না, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার দ্বারা তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কত বিচিত্র দেশ, বিচিত্র তার অধিবাসী- আরো বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও সামাজিক রীতিনীতি। দিকে দিকে কত অরণ্য-সমুদ্র-মরু-পর্বত। নিসর্গ প্রকৃতির কত অফুরান বৈভব, কত পশু-পাখি, জীবজন্তু। আমরা দেশভ্রমণের দ্বারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেগুলোকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারি। ফলে দেশভ্রমণ শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুঁথির ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। অধীত-বিদ্যা তাই আমাদের মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে না। মহৎ উপলব্ধিতে সেই শিক্ষা পূর্ণ ও সার্থক হয় না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন,

‘প্রত্যক্ষ বস্তুর সহিত সংস্রব ব্যতীত জ্ঞানই বলো, চরিত্রই বলো, নির্জীব ও নিষ্ফল হতে থাকে।’

তাই পুঁথির বিদ্যার সঙ্গে চাই বাস্তবের রাখীবন্ধন। আমাদের পঠিত ইতিহাস-ভূগোলই দেশভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জাদুস্পর্শে হয়ে ওঠে প্রাণময়। মানুষে মানুষে তখন অনুভত হয় প্রাণের মিতালি। ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ইতিহাসের কত অতীত কীর্তি, কত কাহিনী আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা যেন সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও শুনতে পাই তার শাশ্বত বাণী। তাই দেশভ্রমণ না করলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষার সঙ্গে তার নিক-সম্পর্ক। পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষার সঙ্গে দেশভ্রমণের আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে দেশভ্রমণকে শিক্ষার একটি অঙ্গরূপে প্রতিভাত করা হয় না। গ্রন্থপাঠের মাধ্যমে যে শিক্ষা গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা আছে; কিন্তু গ্রন্থের বাইরে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারা যে শিক্ষালাভ হয়, তা সীমাবদ্ধ নয়। এই শিক্ষার জন্যেই দেশভ্রমণের আবশ্যকতা অপরিহার্য।

উন্নত দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষ: একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উন্নত বিশ্বের মানুষেরা অধিক ভ্রমণপ্রিয়। সাধারণত তাঁরা শীতকালে দশ বেঁধে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রেরিয়ে পড়ে নিরক্ষরেখার অবস্থিত চিরসবুজের দ্বীপ জ্যামাইকা, বারমুদায়, হাওয়াই দ্বীপে কিংবা আল্পসের বরফ-ঢাকা ঢালে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডে। এসব দেশের ছাত্ররাও আনন্দ থেকে পিছিয়ে নেই। তাঁরা শিক্ষাজীবনের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ছুটিতে বেরিয়ে পড়ে দেশভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এ ভ্রমণগুলো তাদের মনকে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি আনন্দ-রসে সিঞ্চিত করে। ঐ সব দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ও ব্যবসায়ীরাও কিছু সময়ের জন্যে ভ্রমণের আশ্রয় নিয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়।

দেশভ্রমণ – অতীত ও বর্তমান ‍যুগে: যুগপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মনে ভ্রমণের নেশা। সুদূর অতীতে দেশভ্রমণ ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেদিন কোনো সুলভ যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না। যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত। অনেক দেশ তখনো ছিল অনাবিষ্কৃত। তবু সেদিনের পথের অনিশ্চয়তা, অশেষ দুর্গতি, জীবন-সংশয়ের আশঙ্কা, কিছুই মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখতে পারে নি। সে বেরিয়ে পড়েছে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু লঙ্ঘন করার নেশায়। আধুনিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। উন্নতি হয়েছে পথ ও পরিবহন-ব্যবস্থার। রেল, মোটর, জাহাজ, এরোপ্লেন ইত্যাদির প্রচলনে পথের বাধা-বিপত্তি দূর হয়েছে। তৈরি হয়েছে পর্যটন কর্পোরেশন, ট্যুরিস্ট ব্যুরো, ট্রাভেল এজিন্সির মতো বিভিন্ন সংস্থা। এরা ভ্রমণ-বিলাসীদের সামনে তুলে ধরে বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানের বিবরণ, পথের বর্ণনা, যাতায়াত, থাকার সুবিধা, মানচিত্র ইত্যাদির বিচিত্র সংবাদ। ফলে দিনে দিনে ভ্রমণপিপাসুদের সংখ্যা বেড়েছে।

দেশভ্রমণ ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশ একটি সুপ্রাচীন দেশ। প্রাচীনত্বের গরিমায় বাংলা সারা বিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ-দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দারুণভাবে উন্নতি লাভ করেছে। দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে দেশের জন্যে আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে। বর্তমানে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের পর্যটন স্থান: বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি প্রমোদভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে প্রকৃতি নিজের হাতে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর এক রহস্যময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার- যা পর্যটকদের কাছে খুবই লোভনীয় একটি স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। অপরদিকে খুলনা জেলার সুন্দরবনও একইভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী জনপদ রাঙামাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সিলেটের চা বাগান, তামাবিল, জাফলং, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, চট্টগ্রামে ফয়েস লেক, যমুনা সেতু ইত্যাদি পর্যটনের স্থান হিসেবে বেশ সমাদৃত।

বাংলাদেশের পুরাকীর্তি: বৌদ্ধযুগে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ সত্যিই দেখার মতো এবং এর থেকে অনেক কিছু জানার আছে। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ-আশ্রম, আশ্রমের কিছু দূরে সত্যপীরের-ভিটা, প্লেটের উপর তাম্রলিপি ও ব্রোঞ্জ-নির্মিত মূর্তি- এসব পুরাকীর্তির নিদর্শন এখানে রয়েছে। এরকম আরো কয়েকটি স্থানের নাম হল- বগুড়া জেলার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ করতোয়া নদীর তীরে এবং ঢাকা-দিনাজপুর বিশ্বরোডের পাশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মহাস্থানগড়। প্রাচীন বৌদ্ধযুগের বহু ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান। এছাড়া নওগাঁ, জয়পুরহাট, কুমিল্লা-ময়নামতিতেও রয়েছে প্রভু-বুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ। এসব দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ঢাকার আহসান মঞ্জিল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল, লালবাগের কেল্লা, হোসনী-দালাল, সোনার গাঁ লোকশিল্প-যাদুঘর; দিনাজপুরের কান্তজীর-মন্দির, নাটোরের দিঘাপাতিয়া-রাজবাড়ি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, নোয়াখালীর বজরা মসজিদ- এ সবই সভ্যতার নিদর্শন এবং ইতিহাস-প্রসিদ্ধস্থান হিসেবে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সভ্যতায় অনেককিছু ধারণ করে আছে।

উপসংহার: দেশভ্রমণ পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর লোকের মধ্যেই দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। জীবনের জটিলতা যত বাড়বে, বিচিত্র কর্তব্য ও দায়িত্বের বোঝা আমাদের ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন করে তুলবে, একটানা ও একঘেয়ে জীবনের গ্লানির আবর্তের মধ্যে পড়ে আমাদের নিঃশ্বাস যত বদ্ধ হয়ে আসবে, ততই ভ্রমণ সম্পর্কে আমরা উৎসাহী হব; দেশভ্রমণের উপযোগিতা ততই বেড়ে চলবে।
  বাংলাদেশের কৃষক

ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার শতকরা পঁচাশিজন লোক নির্ভর করে কৃষির ওপর। বাকি পনেরো জন মাত্র শিল্প, ব্যবসায়, চাকরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত। সুতরাং বাংলাদেশ কৃষকের দেশ একথা বললে হয়তো কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। কারণ, তারাই বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ, ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, এদেশে কৃষকরাই সর্বাধিক অবহেলিত এবং তাদের অবস্থাই সবচেয়ে বেশি শোচনীয়।

কৃষিনির্ভরতা: অন্যদিকে এদেশের যাবতীয় সম্পদ অর্জিত হয় কৃষির মাধ্যমে। কৃষির সাহায্যেই আমরা আমাদের খাদ্যশস্য, শাকসবজি, ফলমূল ও তরিতরকারি উৎপাদন করি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান উৎপাদিত দ্রব্য হল শাকসবজি, ফলমূল ও তরিতরকারি উৎপাদন করি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান উৎপাদিত দ্রব্য হল পাট। পাট কৃষিজাত দ্রব্য; শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালও পাওয়া যায় এ কৃষিজাত দ্রব্য থেকে। যে-বছর দেশে ভালো ফসল হয় সে-বছর দেশে অবস্থাও হয় সচ্ছল এবং যে-বছর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, অনাহারে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে এদেশের সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে কৃষির ওপর। অথচ আমাদের দেশে কৃষকেরা সবচাইতে বেশি বঞ্চিত, অবহেলিত ও অভাবগ্রস্ত। তাই কৃষকের উন্নতি না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি কোনোদিন সম্ভব নয়।

কৃষকদের দুরবস্থা: একদিন বাংলাদেশ ছিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা চির-আনন্দের দেশ। বাংলাদেশের মাঠভরা ছিল সোনালি ধান, গোলাভরা ছিল গরু আর পুকুরভরা ছিল মাছ। ইংরেজদের শাসনকাল থেকে এদেশের কৃষকদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ব্রিটিশ আগমনের পর থেকে গ্রামবাংলার মানুষ শহরমুখী হতে আরম্ভ করে। কারণ, কুটিরশিল্পের পরিবর্তে তখন আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকে এদেশে। গ্রামের অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। তারা আস্তে আস্তে পাড়ি জমায় শহরের দিকে। ইংরেজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম হওয়ায় জমির মালিক হলো জমিদাররা। তার পর থেকে এদেশের কৃষকদের অবস্থা আরও শোচনীয় হতে থাকে। নানা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এদেশের কৃষকদের অবস্থার অবনতি ঘটে।

বাংলাদেশের কৃষক মানে এখন দারিদ্র্যের প্রতিমূর্তি। রোগ-শোক-পুষ্টিহীনতা ও দারিদ্র্যের প্রেষণে জরাজীর্ণ বাংলার কৃষক আজ প্রায় নিঃস্ব। এখন কৃষক বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এক করুণ মূর্তি। গ্রামের এক জীর্ণ কুটিরে তার বাস, মাথার ওপর কোনো রকমে একটি ছাউনি আর চারদিকে কোনো রকমে বেড়া দিয়ে তারা দিন যাপন করছে দুর্ভাগ্যের চরম অভিশাপের মধ্যে।

ভূমিহীন কৃষক: বাংলাদেশের শতকরা পঁচানব্বই জন কৃষক ভূমিহীন। তাদের নিজের জমি না থাকয় কষ্টার্জিত ফসলের মোট অংশটুকু জমির মালিককে দিয়ে তাদের হাতে এমন কিছু থাকে না। দুঃখ দারিদ্র্য তাদের কোনোদিন শেষ হয় না, যে-তিমিরে তাদের জীবন সে-তিমিরেই থেকে যায় সারা জীবন। বছরের বেশির ভাগ সময় একজন কৃষককে কাটাতে হয় অর্ধাহারে বা অনাহারে। কৃষকদের এ অবস্থা হওয়ার আরও কিছু কিছু কারণ রয়েছে। আমাদের দেশের কৃষকসমাজ আধুনিক শিক্ষার কোনো স্পর্শ পায় না। তাই তারা জানে না ফসল উৎপাদনের আধুনিক উপায়। কম পরিশ্রমে অধিক ফসল লাভের যে-পন্থা সেটা তাদের জানা নেই। তা ছাড়া নানা অপচয় ও অশিক্ষার ফলে পরিবারের লোকসংখ্যার চাপ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। গ্রামের কৃষকরা দূরদর্শী নয়। তারা নানা সামাজিক সংস্কার পালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে ঋণ শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় অনেকে।

কৃষকদের জন্য করণীয়: এদেশ যখন কৃষিপ্রধান দেশ এবং কৃষিই যখন এদেশের প্রধান সম্পদ, তাই কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের। তাদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে। ভূমিহীন কৃষকদের ভূমি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিঋণ যেন ঠিকমতো ভূমিহীন কৃষকদের হাতে পড়ে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের কাছে স্বল্পমূল্যে সার ও কৃষিসরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। গ্রাম্য মোড়ল, ফড়িল, ফড়িয়া ও কিছু সংখ্যক অসাধু কৃষি বিভাগের কর্মচারীর হাত থেকে কৃষকের হাতে যেন কৃষি-সাহয্য ঠিকমতো পৌঁছায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

সরকরি কর্মসূচি: সরকার বর্তমান নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। গ্রামে কৃষকদের সাক্ষর করবার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা দল বেঁধে অভিযান চালাচ্ছে। এতে গ্রামবাংলার কৃষকরা সচেতন হবে, তাদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্পর্কে এখন তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে। সরকার নানারকম প্রচারমাধ্যমের দ্বারা কৃষিকাজের নানা প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে ও উৎসাহ দিয়ে বর্তমানে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করছেন। কৃষকদের কৃষি উপকরণ, সার সরবরাহ ও জমিবণ্টন ছাড়া বছরের অন্য সময় কাজ করবার জন্য কুটিরশিল্পের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা হলে কৃষকরা ঘরের কোণে অলস ও নিশ্চেষ্ট হয়ে আর বসে থাকবে না।

উপসংহার: একদিন এই বাংলাদেশকে কবি কল্পনা করেছিলেন সোনার বাংলারূপে। আমাদের দেশে এখনও যে-সম্পদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভূমির উর্বরতা আছে তাতে এদেশকে সত্যিই আমরা রূপায়িত করতে পারব সোনার বাংলায়। তবে পরিবর্তন করতে পারে যারা তারা হলো এদেশের কৃষক। তাই কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তিত হলে, কৃষির উন্নতি হলে, তবে এদেশ হবে সুন্দর, এদেশ হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা।
নববর্ষ

ভূমিকা:
‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে’ -রবীন্দ্রনাথ

দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস গড়িয়ে আসে পহেলা বৈশাখ। চৈত্র অবসানে বর্ষ হল শেষ। এল নতুন বছর। নববর্ষ। পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ‘ট্র্যাডিশন’ বা প্রচলিত সংস্কৃতিধারা। আদিকাল থেকেই যে কোনো বছরের প্রথম দিনই ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। ‘পুরাতন বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি’-র অন্তিম প্রহর হল ঘোষিত। তিমির রাত্রি ভেদ করে পূর্বদিগন্তে উদিত হল নতুন দিনের জ্যোতির্ময় সূর্য। প্রকৃতির নিসর্গ মঞ্চে ধ্বনিত হল নব-জীবনের সঙ্গীত। আকাশ সাজল অপরূপ সাজে। পত্রে পত্রে তার পুলক-শিহরণ। গাছে গাছে তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস। পাখির কণ্ঠে কণ্ঠে নব প্রভাতের বন্দনা-গীতি। দিকে দিকে মানুষের বর্ষ-বরণের উৎসব-আয়োজন। অভিনন্দন-শঙ্খধ্বনিতে হয় নতুনের অভিষেক। রাত্রির তপস্যা শেষে এই শুভদিনের উদার অভ্যুদয়ে মানুষের হৃদয়ে-উৎসারিত কলোচ্ছ্বাসে ভরে গেল পৃথিবী। নতুন দিনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা দুঃখ জয়ের।

পহেলা বৈশাখ: পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্‌যাপিত হয় নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। তারপর থেকে মোগলরা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ পালন করতেন।

নববর্ষের আশ্বাস: নববর্ষের দিনটি প্রতিদিনের মতোই একটি সাধারণ দিন মাত্র। প্রতিদিনের মতো এ দিনটিও যথানিয়মেই উদয়-দিগন্তে ভেসে ওঠে। আলোক-প্লাবনে পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়। পাখি গান গায়। গাছে গাছে শিহরণ জাগে। কিন্তু তবু ও দিনটি অন্য দিনগুলোর চেয়ে স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট। প্রাত্যহিক তুচ্ছতার ঊর্ধ্বচারী। বর্ষ-প্রদক্ষিণের পথে এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যে মহিমা-ভাস্বর। এ দিনটি আমাদের কাছে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে। মুক্তি প্রাত্যহিকতার জীর্ণ জীবন থেকে, মুক্তি প্রতিদিনের ক্ষুদ্র, আত্মসর্বস্ব জীবনের গণ্ডি থেকে। মুক্তি চিত্তের দীনতা ও হতাশা থেকে। প্রতিদিনের জীবনে আমরা লাভ করি এক মহাজীবনের উদার সান্নিধ্য। বর্ষারম্ভের পুণ্য-প্রভাতে আমরা মহৎ। এ দিন আমাদের কাছে পরম আশ্বাসের, পরম প্রার্থনার। এই পুণ্য দিনে আমরা লাভ করি এক মহাজীবনের উদার সান্নিধ্য। বর্ষারম্ভের পুণ্য-মুহূর্তে নবোদিত সূর্যের আলোকের ঝরণা ধারায় আমরা শুচিস্নাত হয়ে অনুভব করি পরম প্রেমময়ের আনন্দ-স্পর্শ। আমাদের স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতার নির্মোক ভেঙে আমরা সেদিন মিলনের উদার উৎসব-প্রাঙ্গণে এসে সম্মিলিত হই। আমাদের হৃদয় আজ কোন্ অসীমের রাজ্যে, কোন্ অনির্বচনীয় আনন্দের অভিমুখে ধেয়ে চলেছে। নববর্ষের পুণ্য-প্রভাতে আমাদের নিজেদের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করার দিন। মানুষের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল সুখ-দুঃখে গড়া একটি বছর। কিন্তু তার জন্য শোক নয়- যা এলো, যা অনাগত সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল, তাকে আবাহন করার দিন আজ।

বাংলাদেশে নববর্ষ উদ্‌যাপনের বৈশিষ্ট্য: পয়লা বৈশাখ বাংলার জনসমষ্টি অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওঠে। জানে এ নতুন অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তাই মন সাড়া দেয়, চঞ্চল হয়। নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়। আর সে দিন প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে। আটপৌরে জামা কাপড় ছেড়ে ধোপদুরস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ পরে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করে পানাহারে মেতে ওঠে। রমনার বটের তলায় জড়ো হয়ে গান গাই, হাততালি দিই। সবকিছু মিলে দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবে আনন্দে পরিপূর্ণ। এছাড়াও এদেশের স্থানীয় কতগুলো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষের বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুটে ওঠে। যেমন : ‘মেঘের কাছে জল ভিক্ষা করা’, ‘বার্ষিক মেলা’, ‘পুণ্যাহ’, ‘হালখাতা’ ইত্যাদি।

নববর্ষ উদ্‌যাপনে গ্রামীণজীবন ও নগরজীবন: নববর্ষের উৎসব গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নববর্ষে পল্লী অঞ্চলের কোথাও কোথাও বেশ বর্ণাঢ্য মেলা বসে। মেলার বিচিত্র আনন্দ-অনুষ্ঠানে, কেনা-বেচার বাণিজ্যিক লেনদেনে, মিলনের অমলিন খুশিতে, অবারিত আন্তর প্রীতির স্পর্শে নববর্ষের বিশেষ দিনটি মুখর হয়ে ওঠে। এই পুণ্য দিনেই শুরু হয় ব্যবসায়ীদের হালখাতার শুভ মহরৎ। প্রায় প্রতি বিক্রয়- প্রতিষ্ঠানেই ক্রেতাদের মিষ্টান্ন সহযোগে আপ্যায়ন করা হয়। সর্বত্রই এক মধুর প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ। এ ছাড়া দরিদ্র ভোজনে, নৃত্য-গীতে, সভা-সমিতিতে, আনন্দে-উৎসবে বছরের প্রথম দিনটি মহিমোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গৃহস্থরাও নানাবিধ অনুষ্ঠান-ব্রতে পুণ্য দিনটিকে স্মরণীয় করায় মেতে ওঠে। পল্লীর কোথাও কোথাও রচিত হয় নববর্ষ উদ্‌যাপনের উৎসব-মঞ্চ। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বৈশাখী মেলা: নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকলপ্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তাঁরা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি বিভিন্ন আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজে এখনও বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক আনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।

নগরজীবনে নববর্ষ উদ্‌যাপন: বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উদ্‌যাপিত হয়। পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনো বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যুষে নগরবাসীরা সমবেত হয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন সাধারণত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে; আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকালবেলা পানতা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা। এভাবে লোকজ বর্ষবরণ প্রথাগুলোর কোনো কোনোটির অনুসরণের মাধ্যমে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে।

রাজধানী ঢাকার বর্ষবরণ আয়োজন: বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছ্বল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান
‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’

-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তোলে নয়ন-মনোহর। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সকল শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গন, টি.এস.সি. এবং চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।

জাতীয় কর্মসূচি ও নববর্ষ পালন: বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, নজরুল একাডেমী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।

বাংলা নববর্ষ ও উপজাতি সম্প্রদায়: বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ বলে আখ্যা দিলেও গোটা পার্বত্য এলাকায় তা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।

নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: আমাদের জীবনেতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে এ দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আমাদের জাতীয় চেতনা অর্থাৎ বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মাহাত্ম্য। রূপকথার জিয়ন কাঠির মতো এ দিনটির মর্মস্পর্শে দূরীভূত হয় পুরোনো দিনের সকল জরাজীর্ণতা। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে উঠে বাঙালির ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবন। প্রতিবছর এ দিনটি হয়ে উঠে উৎসবমুখর। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুজাতি-গোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শান্তির দেশ। এখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। এগুলোর অধিকাংশই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আনন্দ অনুষঙ্গ বলে স্বীকৃত, কিন্তু পহেলা বৈশাখই একমাত্র উৎসব যা কোনো ধর্মের বা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গোটা জাতির তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ একই সময় অভিন্ন আনন্দ-অনুভূতিতে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখণ্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে। নববর্ষ পরিণত হয় একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠানে।

দিন বদলের পালায় নববর্ষ: আজ উৎসবের অঙ্গে যুগ-পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। উৎসবে যেখানে একদা হৃদয়-আবেগের প্রাধান্য ছিল, ছিল প্রীতিময় আন্তরিকতা, আজ কৃত্রিমতা তাকে গ্রাস করেছে। সেখানে হৃদয়হীন আচার-অনুষ্ঠানের মাতামাতি। চোখ-ঝলসানো চাকচিক্য আজ উৎসবের বৈশিষ্ট্য। নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতা আজ আমাদের হৃদয়-ঐশ্বর্য লুণ্ঠন করেছে। নির্বাসিত করেছে শুষ্ক, নিষ্প্রাণ জড়জগতে। উৎসবে তাই আজ আমাদের হৃদয়-দৈন্যের নগ্নতা। উৎসবের মহতী কল্যাণী রূপটি তাই আজ আমাদের কাছে অনুদ্ভাসিত। নববর্ষের উৎসব-অনুষ্ঠানেও আজ আন্তরিক প্রীতির অনেক অভাব। মাইকে চটুল গানের বাড়াবাড়ি। সেখানেও উল্লাস মত্ততার চিত্র। সেখানে আমাদের হৃদয়-সংকুচিত, আমাদের দ্বার রুদ্ধ। বর্ষবরণ উৎসবেও ‘দীপালোকের উজ্জ্বলতা, খাদ্য-প্রাচুর্য, আয়োজন-বৈচিত্র্য।’ সেখানে আমাদের শুষ্কতা, আমাদের দীনতা, আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতারই প্রকাশ। তাই আজ এই সর্ব-বন্দনার পূর্ণ্য-মুহূর্তে আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘সমারোহ সহকারে আমোদ প্রমোদ করায় আমাদের উৎসব কলা কিছুমাত্র চরিতার্থ হয় না। তাহার মধ্যে সর্বদলের আন্তরিক প্রসন্নতা ও ইচ্ছাটুকু না থাকিলেই নয়।’ নববর্ষে যেন ফিরে পাই আমাদের সেই হৃত-গৌরব। আবার যেন আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আন্তরিক প্রসন্নতা ও কল্যাণী ইচ্ছার ভাবরসে। আবার যেন আমরা বর্ষারম্ভের উৎসবে খুঁজে পাই ‘মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব’ করার মহত্ত্ব। আজ নববর্ষ উৎসব ‘সত্যের গৌরবে, প্রেমের গৌরবে, মঙ্গলের গৌরবের, কঠিন বীর্য, নির্ভীক মহত্বের গৌরবে’ উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

উপসংহার: নববর্ষ সমগ্র মানুষের কাছে নবজীবনের দ্বার উন্মোচিত করে দিক। নতুন বছর যেন মুষ্টিমেয় ধনীর ভোগবিলাসের সঙ্কীর্ণ উল্লাসে পরিণত না হয়’ দারিদ্র্য লাঞ্ছিত পীড়িত মানুষের নিষ্ফল বিলাপে যেন পৃথিবী বিষণ্ণ না হয়ে ওঠে; যুদ্ধদীর্ণ বিশ্বের পাশবশক্তির তাণ্ডব যেন শান্তির শুভশক্তির কাছে পরাভূত হয়। আসুন পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও দ্বিধা দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা জাগ্রত হই অখণ্ড জাতীয় চেতনায়। আমরা ঋদ্ধ হই আগামীর গর্বিত প্রেরণায়। নতুন বছর আমাদের সবাই জীবনে সুখ-সম্ভার বয়ে আনুক এটাই হউক আমাদের প্রত্যাশা। আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে, আসুন, কবিকণ্ঠে মিলিয়ে আমরা বলি,
‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
শৈশব স্মৃতি

মানুষের সবচেয়ে আনন্দঘন সময় কাটে বুঝিবা শৈশবে। কিন্তু শৈশবকাল যখন অতীত হয়ে যায় তখনই তা উপলব্ধিতে আসে। রচিত হয় গল্প, কবিতা কিংবা গান।

শৈশবের স্মৃতির পাতা যখন চোখের সামনে মেলে ধরে, ছাড়াছবির মতো একের পর এক ভেসে ওঠে কত ঘটনা, কত ছবি। আর কিছু কিছু বেদনার অধিকাংশই আনন্দের। তাই শৈশব স্মৃতি সততেই সুখের। সব কথা হয়তো মনে পড়ে না, আলো-আঁধারির খেলায় ঢাকা পড়ে যায় অনেক ক্ষণ। তবু শৈশবকে যখনই মনে পড়ে, বর্তমানকে তুচ্ছ লাগে।

আমার শৈশব কেটেছে গাঁয়ে। ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম- মধুখালি। এই কমলডাঙ্গায় কত না সুন্দর ভোর হতো, কত না সুন্দর পাখিরা গাইতো। আর এক ঝাঁক দস্যি ছেলেমেয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো। আমি তাদেরই কতজন ছিলাম।

আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল। সব চাচা এক সাথে থাকতেন। আমরা চাচাতো ভাই-বোন সব মিলে ছিলাম এগারো জন- একটা ফুটবল টিম। মাঝে মাঝে ফরিদপুর সদর থেকে আসতেন আমার ফুপু। তখন আরো তিনজন সদস্য বেড়ে যেত। আর আমাদের আনন্দ একলাফে উঠে যেত আকাশে। সারাদিন শুধু হৈচৈ আর খেলা। প্রতি বেলায় রান্না হতো মজার মজার খাবার।

আমাদের বাড়িটা ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মস্ত উঠোনের চারধারে চারটে বড় বড় টিনের ঘর। পাশেই বিশাল বাগান। সান বাঁধানো পুকুরও ছিল একটা। আমার দাদু খুবই স্বচ্ছল ছিলেন। তাই দূর-সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনে সব সময় আমাদের বাড়িটা ভরে থাকতো। বেশির ভাগ সময়ই আমরা ছোটরা দাদুর ঘরে ঘুমাতাম। মেঝেতে ঢালাও বিছানা হত। কে কার পাশে শোব এ নিয়ে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। দাদি তাঁর হাতের তালপাখার ডাঁট দিয়ে আমাদের পিঠে দু-এক ঘা দিতেন আমরা যে যার মতো টুপটাপ শুয়ে পড়তাম। আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রনিক বাতি, পাখা সবই ছিল। তারপরও দাদি সারাদিন হাতে তালপাখা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।

রেলগাড়ি দেখা ছিল আমার খুব প্রিয় সখ। মাঝে মাঝে তাই একা আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম রেলস্টশনে। জংশন স্টেশন। কোন ট্রেন যেত ভাটিয়াপাড়া, কোনটা যেত কামারখালি। ট্রেন চলে গেলে আমি স্লিপারের ওপর দিয়ে হেঁটে ফিরতাম বাড়ির দিকে। রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে টেলিগ্রাফ পোস্টে ছুঁড়ে মারতাম। টং করে আওয়াজ হলেই মন বলতো, আজ খুব আনন্দের কিছু একটা হবে। বেশির ভাগ সময়ই আমার ছুঁড়ে দেয়া পাথর পোস্টে লাগত না, অনেক দূর দিয়ে চলে যেত। শরৎকালে রেললাইনের দুপাশে সাদা কাশফুল ফুটতো। মনের ভেতর তখন অন্য শিহরণ। গাঁয়ে এবার ঢোল বাজবে, মাইক বাজবে। পূজা এলো বলে।

আমরা সবাই একসাথে স্কুলে যেতাম। একবার স্কুল ফাঁকি দিয়ে ম্যাজিক আর বানরের খেলা দেখেছিলাম। শাস্তি হিসেবে দাদু আমাকে পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছিলেন। বড় উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি যখন কান ধরে ওঠাবসা করেছি, ফুটবল টিমের অন্য সদস্যরা তখন দাঁত বের করে হেসেছে। ইচ্ছে হয়েছে, বড় একটা সুঁই দিয়ে ওদের সবার ঠোঁট সেলাই করে দেই।

আমাদের পুকুরের চারধারে অনেক নারকেল আর সুপারি গাছ ছিল। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো ফুলির মা। সে সব সময় ভয় দেখিয়ে বলতো ঐসব গাছে ভূত আছে। একদিন পুকুরে বাসন মাজতে গিয়ে সে ভূত দেখেছি। যেদিন এসব গল্প শুনতাম তারপর থেকে বেশ কয়েকদিন আমার আর ওমুখো হতাম না। এক দুপুরে আমি একলা পুকুর ঘাটে বসে কত গল্পের বই পড়েছি। আমার ছোট মামা ঢাকায় থাকতেন। সেখান থেকে প্রায়ই আমার জন্যে মজার মজার গল্পের বই পাঠাতেন। সেদিন পড়ছিলাম ’কুৎসিত হাঁসের ছানা’ বইটি। আমি ভীষণ মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পানির ভেতর ভীষণ জোরে অদ্ভুত এক শব্দ হল। আমি তো হাতের বই ছুঁড়ে ফেলে পড়িমড়ি করে দৌঁড়। উঠোনে গিয়েই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। পরে জেনেছিলাম, গাছ থেকে পুকুরের পানিতে পড়ছিল এক ছড়া শুকনো নারকেল। তারপরও দু’রাত আমার ভালোমত ঘুম হয় নি।

আমাদের স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক যোগেন্দ্রমোহন বাড়িতে এসে পড়াতেন। সবাই তাকে ভীষণ ভয় পেত। যোগেন্দ্রমোহনকে সংক্ষেপ করে বলতো, ’যম স্যার’। স্যারের কাছে পাঁচ রকমের বেত ছিল। দুষ্টুমির মাত্রা অনুযায়ী এর ব্যবহার হতো। স্যার সন্ধ্যার পর আসতেন। আমরা সবাই লাইন ধরে সুর করে করে পড়তাম।

এক বুড়ো গান গেয়ে ভিক্ষা করতো। আমরা ছোটরা খুচরো পয়সা নিয়ে তার পেছনে পেছনে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে দাদু সেই বুড়োকে কাছারি ঘরের সামনে ডেকে নিয়ে গান শুনতো। ছোট্ট দুধের কৌটায় তবলার বোল তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সে গাইতো, ‘শোন মোমিন মুসলমান, করি আমি নিবেদন’। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে দাদি, মা আর চাচিরা দূরে দাঁড়িয়ে শুনতো। দাদুর চোখে চিকচিক করতো জল।

বাগানের পেছনে গন্ধলেবুর ঝোপে সন্ধ্যার আগেই আঁধার নামতো। সেখানে জোনাকির আড্ডা। আমরা দু’তিন জন ছোট ছোট কাঁচের শিশি নিয়ে জোনাকি ধরার প্রতিযোগিতায় নামতাম। লেবুর কাঁটায় গাঁ ছিড়ে যেত। তবু থামাথামি নেই। যম স্যারের কাছে পড়বার সময় সেই শিশি থাকতো পকেটে। শিশির মুখ পাতলা কাপড় দিয়ে বাঁধা। তখনও রোজাই লোড শেডিং হতো। আর লোড শেডিং হলেই আমরা জোনাকিগুলো ছেড়ে দিতাম। মনে হতো, আকাশ থেকে অসংখ্য তারা নেমে এসেছে মাটিতে।

আমার বয়স যখন ন’বছর তখন একবার ভীষণ জ্বর হল। দিন-রাত শুয়ে থাকতাম, মুখ তেতো হয়ে গিয়েছিল। কিছুই খেতে পারতাম না। সকালের দিকে জ্বরটা একটু কমলে মা আমায় বারান্দায় নিয়ে আসতো। চাদর দিয়ে সারা গা পেঁচিয়ে পিঁড়ি পেতে বসে থাকতাম আমি। প্রায় একমাস ভুগেছিলাম। সবাই হৈচৈ করে স্কুলে যাচ্ছে, দল বেঁধে খেলছে। কেবল আমি অসহায়ের মত বসে থেকেছি। একটু বসলেই মাথা ঝিমঝিম করতো, বমি পেতো, গা কেঁপে চোখ জ্বালা করতো। বুঝতাম, আবার জ্বর আসছে। সারাক্ষণ এক ঘোর লাগা ভাব, কনে ঝিঁ ঝিঁ পাকার ডাক। সেই ছেলেবেলাতেই মনে হতো- আর বুঝি ভালো হবো না।

পৃথিবীর অমোষ পরিবর্তনশীলতায় সবকিছু পাল্টে যায়। সকালের ঝকঝকে রোদ দুপুরে গড়ায়, দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ণের ছায়া দীর্ঘতর হয়, নামে রাত। মানুষের জীবনও তো তেমনি। সেই কবে শৈশব পেরিয়ে এসেছি। যাদের নিয়ে আমার চমৎকার আনন্দমুখর সময়গুলো কেটেছে তাদের কেউ কেউ পৃথিবীতেই নেই।

আমাদের ফুটবল টিমের প্রায় সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছি বিভিন্ন জায়গায়। দাদু, দাদির কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে গান গাইয়ে বুড়োটার কথা, যোগেন্দ্রমোহন স্যারের কথা। তাঁদের কেউই আজ আর নেই। শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, গন্ধলেবুর ঝোপ, রেললাইন আর সেই ছোট্ট স্টেশনটা আজও আমায় টানে। কিন্তু কিছুই আর আগের মতো নেই। তবু মনে হয় আবার যদি ফিরে পেতাম হারানো শৈশব। কিন্তু কর্মচঞ্চল জীবনের টানে টানে সময় গড়িয়ে যায় ব্যস্ততায়। ভবিষ্যৎ গড়ার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে দিন কাটে। শৈশবে ফিরে যাওয়া হয় না, ফিরে পাওয়াও যায় না তাকে। কেবল কাঁটার মতো বিঁধে থাকে একটু সুখের স্মৃতি।