চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Wednesday, July 29, 2020

নবান্ন উৎসব

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিসংশ্লিষ্ট অনেক উৎসব রয়েছে। নবান্ন উৎসব এর মধ্যে অন্যতম।বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণই কৃষিজীবী। কঠিন মাটিকে তারা তাদের শ্রম ও শক্তির দ্বারা নমনীয় করে সেখানে প্রাণের জোয়ার সৃষ্টি করে। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অসম্ভব খাটুনির পর ক্ষেতের সোনালি ফসল যখন তারা ঘরে তুলতে পারে তখন তাদের প্রাণে ও আনন্দের বান বয়ে যায়। নবান্ন উৎসব এই আনন্দমুখর প্রাণেরই উৎসব। হেমন্তের শুরু থেকেই সারা বাংলার ঘরে ঘরে ফসল তোলার ধুম পড়ে যায়। তখন এই লোকউৎসব গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয়। উৎসবের দিন ভোর না হতেই ছেলে-মেয়েরা ঘরের বাইরে এসে ছড়া কেটে দাড়ঁকাকদের নিমন্ত্রণ করত। এদিন ভোরে নতুন ধানের নতুন চাল ঢেঁকিতে কোটা হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ির প্রবীণরা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং ছোট ছেলে-মেয়েরা নতুন জামা-কাপড় পরে। এর পর বাড়ির উঠোনে গর্ত করে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। একে বলে ‘বীরবাঁশ’। বীর বাঁশের প্রতিটি কঞ্চিতে নতুন ধানের ছড়া বাধাঁ হয়। বীর বাঁশ পোঁতার পর একটি কলার খোলে চাল মাখা কলা ও নারকেলের নাড়ু কাককে খেতে দেওয়া হয়। কাককে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত এ পর্বটির নাম ‘কাকবলি’। এ অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আহার করে না। শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে পূজা এবং নবান্ন দিয়ে পরে সকলে আহার করে। ক্রমান্বয়ে এই লোকউৎসবটি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমান সময়ে নবান্ন উৎসবের ব্যাপকতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। আমাদের উচিত বাংলা ও বাঙালির এই লোক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা।

 অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনো বিনষ্ট হয় না।

মানুষ যখন থেকেই সভ্যতা নির্মাণ করার শুরু করেছে তখন থেকে অর্থের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমান সভ্যতার মাপকাঠিতে অর্থ একটি বড় ব্যাপার। অর্থ দিয়েই মূলত আমরা সমাজে মানুষের অবস্থান এবং গ্রহণযোগ্যতা পরিমাপ করে থাকি। বিত্তবান হিসেবে সমাজে পরিচিত হওয়াটাও অনেকের কাছে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এই বিত্ত-বৈভব, ধন-সম্পদ যেকোনো মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে। আমীর পরিণত হতে পারে ফকিরে।

কিন্তু জ্ঞান এমন এক সম্পদ যা কোনদিন বিনষ্ট হয় না। একজন জ্ঞানী চিরদিনের জন্য জ্ঞানী। কিন্তু একজন ধনী চিরদিন ধনী নাও থাকতে পারে। অর্জিত সম্পদ যেকোনো সময় হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। অর্জিত জ্ঞান কখনোই হারানোর ভয় থাকে না। ধনী ব্যক্তি তার সম্পদ দান করে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু জ্ঞানীর বিতরণ করা জ্ঞান অন্যদেরকেও জ্ঞানীর কাতারে সামিল করে অনিঃশেষ থেকে যায়।

জ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দান করে, সম্পদ তা পারে না। সক্রেটিস, প্লেটো, নিউটনরা বহু শতাব্দি আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের জ্ঞান সভ্যতাকে এখনো পথ দেখাচ্ছে। জ্ঞানের শাশ্বত এ সত্য সবারই জানা, সম্পদের বিনাশ আছে কিন্তু জ্ঞান সম্পদের বিনাশ নেই। মানুষের গড়া বহু সভ্যতা বহু ধন সম্পদ সময়ের সাথে সাথে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ যে জ্ঞান পৃথিবীতে রেখে গেছে তা ক্রমশ নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু জ্ঞানের কারণেই মানুষ সকল সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।

শিক্ষা: জ্ঞান আহরণ এবং জ্ঞান বিতরণ সভ্যতাকে গুহার অন্ধকার থেকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সুতরাং জ্ঞান কখনোই বিনষ্ট হতে পারে না। অর্থ সম্পদ মানুষকে সাময়িক তৃপ্তি দিলেও জ্ঞানের সমকক্ষ হতে পারে না।

      পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।

মানুষ একা বাস করতে পারে না। তাকে সমাজের মধ্যে বাস করতে হয়। সমাজে প্রতিটি মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাস করে। মানুষের অন্যতম মানবিক এবং নৈতিক গুণ হচ্ছে একে অপরের কল্যাণসাধন করা। মানুষ শুধু নিজের কথা চিন্তা করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। মানুষকে তার চারপাশের জগৎ নিয়েও ভাবতে হয়।

যে ব্যক্তি সর্বদা অন্যের কল্যাণ এবং উপকারের কথা চিন্তা করে, সেই ব্যক্তি সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ যখন নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তখন সে অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না।

অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা চরম অন্যায় হিসেবে বিবেচিত। অন্যায়কারীরা নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে সমাজ, দেশ এবং জাতির চরম ক্ষতিসাধন করে। এরা সমাজের মানুষের নিকট ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যায়কারীরা সব সময় হীনমন্যতায় ভোগে। তাই তাদের মন-মানসিকতায় শুদ্ধি আসে না। ফলে তারা তাদের কর্মক্ষেত্র তথা জীবনে উন্নতি করতে পারে না। পরের অনিষ্টকারী ব্যক্তিরা অপরের জন্য পাতা ফাঁদে নিজেরাই পতিত হয়। নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে মহাবিপদ ডেকে আনে।

শিক্ষা: প্রত্যেক মানুষেরই উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরের মঙ্গল কামনা করা, অপরের মঙ্গল করার চেষ্টা করা। তবেই নিজের কল্যাণ সাধিত হবে।


ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ।

প্রাণীকূলের মধ্যে সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রাণী ধরা হয় পিপড়া এবং মৌমাছিকে। শুধু কর্মই যদি শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হত তবে মানুষের আগে শ্রেষ্ঠত্ব পেত পিপড়া এবং মৌমাছি। মানুষকে অন্য সকল প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ করেছে তার জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা। পরিশ্রমের পাশাপাশি এই তিনের সমন্বয় প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে। মানুষ মাত্রই ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করবে। প্রতিটা মানুষের বর্তমান জুড়ে থাকে তার ভবিষ্যতের ভাবনা।

কাজেই ভবিষ্যতই হল মানব জাতির একমাত্র চিন্তার স্থল। ভবিষ্যতের কর্ম-পরিকল্পনাই ঠিক করে দেয় জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে কারা বসবে। কে নেতৃত্ব দেবে আগামীর পৃথিবীকে। ক্ষুদ্র পিপীলিকা আর মৌমাছি যদি আগত শীতের জন্য সারা বছর খাদ্য সঞ্চয় করে ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতে পারে; তবে মানুষ হিসেবে আমাদেরও উচিত ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা। সাধারণ মানুষ আর জ্ঞানীজনদের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় কর্ম পরিকল্পনা। আজকের পৃথিবী উন্নত বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে বিভক্ত শুধু ভবিষ্যতের কর্মপন্থা আর তার বাস্তবায়নের জন্য।

প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারাই ঠিক করে রাখে আগামী দিন কি করবে। ভবিষ্যতের ভাবনায় যাদের বর্তমান কাটে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী। কারণ, বলা হয়ে থাকে “একটি ভাল পরিকল্পনা কর্ম সম্পাদনের অর্ধেক পথ অতিক্রম করে।” কাজেই ভবিষ্যৎ নিযে যে যত ভাবে তার উন্নতি তত বেশি বেগবান হয়।

শিক্ষা: মানুষ অতীত থেকে শুধু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে। জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতকে সাজানোর কোন বিকল্প নেই। আর তাই ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই সকল উন্নয়নশীল জাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার।
     গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন।

মানুষের জ্ঞানের ধারক ও বাহক হচ্ছে গ্রন্থ। গ্রন্থ পাঠ করে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। নিজের ও অন্যের প্রয়োজনে সেই বিদ্যাকে কাজে লাগায়। বিদ্যার আলোকে জগৎকে উদ্ভাসিত করে। শাশ্বত সত্য-সুন্দরের পথ নির্দেশ করে। কিন্তু বিদ্যা যদি কেবল গ্রন্থগতই হয় তবে তা কোনো কাজেই লাগে না।

গ্রন্থগত বা পুঁথিগত বিদ্যা মানুষকে যথার্থ জ্ঞানী করে তুলতে পারে না। বিদ্যাকে জীবনের উপযোগী করে তোলার মধ্যেই এর যথার্থ উদ্দেশ্য নিহিত। কাজেই তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞানও থাকা দরকার। বিদ্যা অর্জন করে তাকে কাজে লাগাতে হবে। কেবল মুখস্থ করে লেখাপড়া করলে তা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায় না।

যে জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে আসে না সে জ্ঞান দ্বারা নিজেরও যেমন কোনো উপকার হয় না তেমনি জগতেরও কোনো কল্যাণসাধন হয় না। আর যে বিদ্যা প্রয়োজনের সময় কাজে ব্যবহার করা যায় না প্রকৃতপক্ষে সে বিদ্যার কোনো মূল্য নেই। তেমনি মানুষের জীবনে ধন-সম্পদেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম।

পরের ধন-সম্পদকে নিজের মনে করা কিংবা নিজের ধন-সম্পদ অন্যের কাছে জমা রেখে নিজের বলে হিসাব করা চরম বোকামি। কারণ অন্যের নিকট জমা রাখা ধনসম্পত্তি প্রয়োজনের সময় কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। সুতরাং সার্থক ও সুন্দর জীবনের জন্যে বিদ্যাকে যেমন আত্মস্থ করতে হবে, ঠিক তেমনি ধন-সম্পদ অন্যের কাছে অহেতুক গচ্ছিত না রেখে নিজের আয়ত্তে রাখতে হবে। যাতে বৃহত্তর মানবকল্যাণে তা কাজে লাগানো যায় তথা দেশ ও দশের মঙ্গলে ব্যবহার করা যায়।

শিক্ষা: গ্রন্থগত বিদ্যা আর অন্যের আয়ত্বে থাকা ধন কোনো প্রয়োজনে আসে না। মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই এসবের সার্থকতা।

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনি পরে। 
সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

পৃথিবীতে কোনো মানুষই চিরস্থায়ী নয়। মানুষ কেবল চিরস্থায়ী থাকতে পারে তার মহৎ কর্মের মাধ্যমে। কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে দীর্ঘ সময়। মানুষের যথার্থ পরিচয় নিহিত কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। যারা শুধু নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না।

জীবনে কেউ যদি ভালো কাজ না করে তবে সে জীবন অর্থহীন। মানবজীবন শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, সবার সুখ তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে। কারণ ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষুদ্র পরিসরে মানবস্বার্থের চিন্তার অবকাশ থাকে না। অন্যের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করার মধ্যেই আত্মা প্রকৃত অর্থে সুখী হয়। মানুষ সুখের জন্য দিশেহারা, তারা কাজের মধ্যে সুখ খুঁজে পেতে চায়।

তাই মানুষের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে পৃথিবীতে কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা নিজের কথা চিন্তা না করে, অন্যের সুখ-শান্তি তথা কল্যাণের কথা চিন্তা করে। অপরের সুখ-শান্তির মাঝে নিজের পরম সুখের ঠিকানা খুঁজে পায়। যেমন- মাদার তেরেসা মেসোডেনিয়া ছেড়ে কলকাতায় এসে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের ২৭টি বছর, তাছাড়া মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মাগান্ধী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। বিশ্বের যা কিছু মহান, মহৎ কর্ম, যা মানব সভ্যতাকে স্বর্ণ শিখরে নিয়ে গেছে তার মূলে রয়েছে মহৎ মানুষের ভূমিকা।

অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য তারা তাদের নিজেদের সুখ শান্তি, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সবকিছু বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি।

শিক্ষা: সংকীর্ণ স্বার্থপরতায় বিভোর মানুষ কোনো দিন সুখ নামক বস্তুটির দেখা পায় না। তাই মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই প্রকৃত মানুষের কাজ।

   সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা আশা তার একমাত্র ভেলা।

প্রতিনিয়ত মানুষ পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজাতে চায়। চায় মায়া মমতার বন্ধনে আবদ্ধ সুখের সংসার। কিন্তু মানবজীবন পুষ্পশয্যা নয়। সংসারে আছে জটিলতা, নানা সমস্যা আর চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব। কখনো দুঃখ এসে তছনছ করে দেয় সুখের সাজানো সংসার। স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা।

জীবনের চরম বিপর্যয়ের দিনগুলোতেও মানুষ আশায় বুক বাঁধে। সংসার সাগরে একদিকে দুঃখ খেলা করে অন্যদিকে সে খেলায় টিকে থাকার জন্য মানুষের অবলম্বন আশা। মানুষ আশাকে ভরসা করেই জীবনতরীর হাল ধরে শক্ত করে। উত্তাল সাগরের বুকে জাহাজ চালানো খুবই কঠিন। তারপরও নাবিক বেঁচে থাকার আশায় তীরে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে।

তেমনি সংসাররূপ উত্তাল দুঃখের সাগর মানুষ পাড়ি দেয় আশার তরণী ভাসিয়ে। মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তাই জীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যায় এই আশাতে যে,্আগামী দিনগুলো সুন্দর হবে। কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না। স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, ধরা দিবে বাস্তবে এসে। তাই মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন হলো আশা। সাফল্যের পথে আশা মানুষকে দেয় প্রেরণা। কেননা, পৃথিবীর সব ছোট-বড় সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে আশা। শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে যারা আশা নিয়ে পরিশ্রম করে গেছেন তারাই হয়েছেন স্মরণীয়-বরণীয়। কখনো দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে হয়তো দুরাশা এসে মন দখল করতে পারে।

কিন্তু সেটা ক্ষণস্থায়ী। দুরাশার দুঃসময়েও মানুষ নতুন করে আশায় উদ্দীপ্ত হয়। চায় নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে। আশাই মানুষের জীবনীশক্তি। তাইতো বলা হয়- ‘আশায় বসতি।’ আশা ভাগ্যহতকে শোনায় জেগে উঠার গান। আশার ভেলায় ভর করেই চলছে পৃথিবী, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমাজব্যবস্থা। আশা আছে বলেই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিটি মানুষ বাঁচতে শেখে।

শিক্ষা: এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষকে নানা বাধা বিঘ্ন পার হতে হয়, পুড়তে হয় দুঃখের আগুনে। কিন্তু আশা মানুষকে পথ দেখায় কীভাবে দুঃখের আগুনে পুড়ে সুখ লাভ করা যায়, প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়।

      জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। চারপাশের জীব-জগৎ নিয়েই মানুষ জীবনযাপন করে। কেননা, সৃষ্টিকর্তা বহুরকম উপাদান দিয়ে পৃথিবীকে সাজিয়েছেন। প্রত্যেক জীবের সাথে অন্য জীবের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী মানুষও সেই সম্পর্ক বা বন্ধনে আবদ্ধ। যে সৃষ্টিকর্তা তাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষের কর্তব্য তাঁর উপাসনা করা, তাঁকে খুশি করা। মানুষ তাঁকে খুশি করতে পারে উপাসনালয়ে প্রার্থনা করার মাধ্যমে এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবেসে সেবা করে।

স্রষ্টার সৃষ্টিকে না ভালোবেসে, মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে যদি আমরা সারা দিন রাত তাঁকে ডাকি তিনি খুশি হবেন না। কেননা, সৃষ্টিকর্তা সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন পরম ভালোবেসে। ক্ষুদ্র থেকে বিশাল সবকিছুর প্রতিই তাঁর দৃষ্টি রয়েছে। আর সব কিছু তিনিই লালন-পালন করছেন। তাই তাঁর সৃষ্টির সেবার মাঝেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। সৃষ্টির বৈচিত্র্যতার মাঝেই রয়েছে স্রষ্টার বিশালত্ব। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, সংসার ত্যাগী হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে তাঁকে খুঁজলে পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে যারা ঐশ্বর্যশালী মানুষ তাদের উচিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

এতে অসহায় মানুষগুলো খুশি হবে। মানুষের এই খুশিই সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করবে। সমাজ হবে সুন্দর। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিকেও ভালোবাসতে হবে। তাকে পেতে হলে জীবে দয়া করতে হবে। তাইতো সব ধর্মের মূল কথা জীবে দয়া করা। স্রষ্টার সৃষ্টি যে কত মূল্যবান তা আমরা বৌদ্ধ ধর্মের ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এই বাণী থেকে বুঝতে পারি। হযরত মুহাম্মদ (স.) সব সময় জীবের সেবা করতেন এবং মানুষকে সবসময় জীবের প্রতি সদয় হতে উৎসাহিত করেতেন। সর্বোপরি সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ। তাই ঈশ্বরকে সেবা করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকেই সেবা করতে হবে।

শিক্ষা: সৃষ্টিবিহীন যেমন স্রষ্টার কথা ভাবা যায় না, ঠিক তেমনি সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে স্রষ্টাকে খোঁজা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

       ধনের মানুষ, মানুষ নয় মনের মানুষই মানুষ।

মানুষ জন্ম থেকেই দুটি পরিধির মধ্যে বাস করে। একটি আত্মপরিধি অন্যটি বিশ্বপরিধি। একদিকে থাকে আত্মসুখ ও ঐশ্বর্য আকাক্সক্ষা অন্যদিকে থাকে ত্যাগ ও মানবকল্যাণের চিন্তা। আত্মপরিধি সম্পন্ন মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। কারণ প্রকৃত মানুষ যারা তারা অপরের হিতকামনা করেন। সহানুভূতি, পরার্থপরতা ও সমষ্টিগত কল্যাণবোধ ছাড়া মনুষ্যত্ব থাকে না।

এ গুণগুলো মানুষকে সুন্দর মনের অধিকারী করে তোলে। পরোপকারী ও ত্যাগী মনের মানুষই প্রকৃত মানুষ। জনসাধারণের কাছে সংকীর্ণ মনসম্পন্ন প্রবল অর্থশালী লোকের কোনো মূল্য নেই। তারা আপাত সম্মান পেলেও হৃদয়ের শ্রদ্ধাবোধ পায় না কখনই। মৃত্যুর সাথে সাথে তার নামও বিলীন হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। মৃত্যুর পর মানুষ আর তাকে স্মরণ করে না কখনই।

একমাত্র পরোপকারী মনের অধিকারী বিত্তবান মানুষ সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কথায় বলে ‘বিত্তের চেয়ে চিত্ত বড়।’ সুন্দর মনের মানুষ সম্পদহীন হলেও অপরের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পায়। মানুষ তাকে মৃত্যুর পরেও অনন্তকাল মনে রাখে। মৃত্যুর পরও সে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় হয় সিক্ত।

শিক্ষা: ধন-ঐশ্বর্য নয়, মানবকল্যাণকামী সহানুভূতিশীল মনই মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করতে পারে। এ ধরণের মানুষই প্রকৃত মানুষ।


 স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।

প্রত্যেক মানুষের কাছেই স্বাধীনতা একান্ত কাম্য। কেউ পরাধীন থাকতে চায় না। তবে পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়া অনেক কঠিন। আবার স্বাধীন হওয়ার চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা আরো কঠিন। কারণ তখন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি অনেক সোচ্চার থাকে। তাই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আরো বড় হয়ে সামনে আসে। শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বহুকষ্টের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও নানা কারণে তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়।

কারণ স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল থাকে। আর তখন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নানাভাবে এসব দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায়। এসময় তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নতুন স্বাধীন হওয়া দেশকে প্রথমে সুগঠিত করতে হয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে অর্থনীতি, শিল্প, কৃষিসহ সকল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়।

ফ্রান্সের বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ রোঁমা রোঁলা বলেছেন- “কোনো দেশ বা জাতিকে শুধু তার সীমান্ত রক্ষা করলেই চলবে না তার শুভ বুদ্ধিকেও রক্ষা করতে হবে। জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, পাশাপাশি রক্ষা করবে তার চিন্তা ও আত্মার স্বাধীনতা।” স্বাধীনতা অর্জন করতে যেমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয় তেমনি রক্ষার জন্যও আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ও সংগ্রামী হতে হবে। স্বাধীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সকলকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে হবে।

স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হবে এবং স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত বিরোধী শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য দায়িত্ব সচেতন ও নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক হতে হবে।

শিক্ষা: স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি জাতিকে বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আবার এই অর্জিত স্বাধীনতাকে ধরে রেখে নিজেদের অবস্থান আরো উন্নত করার জন্য দেশের সকলকে আরো বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।

 জাতীয় জীবনে টেলিভিশনের ভূমিকা

সূচনা: টেলিভিশন বর্তমান বিশ্বে বিনোদনের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যম। ‘টেলি’ শব্দটি ল্যাটিন ‘tele’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ দূরবর্তী আর ‘Vision’ শব্দ ‘Visio’ শব্দ থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ দেখা। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা ঘরে বসে দূরবর্তী স্থানে প্রচারিত কোনো অনুষ্ঠানের দৃশ্য ও শব্দ একই সঙ্গে দেখতে এবং শুনতে পাই।

আবিষ্কার: বিজ্ঞানীদের বহু বছরের সাধনা ও গবেষণার পথ ধরে ১৯২৫ সালে ইংল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। ১৯৪৫ সালে তা বর্তমান রূপ লাভ করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে টেলিভিশন এনে দিল অভাবিত উন্নতি। ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে মানুষ সারাবিশ্বকে জেনে নিতে পারছে আজ।

জনমনে টেলিভিশনের প্রভাব: জনমনে টেলিভিশনের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। কি আনন্দ, কি শিক্ষা, কি জ্ঞান, উপদেশ, সতর্কবাণী- যেকোনো বিষয়ে টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান লক্ষ লক্ষ দর্শক হৃদয়ে একই সঙ্গে যেভাবে অনুভূতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় তেমনটি আর কারো পক্ষেই করা সম্ভবপর নয়। সাধারণত টেলিভিশনকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ধরা হলেও শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, দেশ-বিদেশের খবরা-খবর, দেশের নানা সমস্যার সমাধান, সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়ন বিষয়ক নানা প্রকার আলোচনা, সমালোচনা, প্রতিবেদন ইত্যাদি ভিত্তি করে টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। তাই শিক্ষা-দীক্ষা বিস্তার এবং জাতি গঠনে টেলিভিশনের উপযোগিতা আজ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চ-নিম্ন সকল ধরনের পেশাজীবী, ছোট-বড় নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে টেলিভিশন একটি আকর্ষণীয় আনন্দের মাধ্যম। তাই জনকল্যাণের এক বিশাল সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার অন্যতম হাতিয়ার রূপে আজকের দিনে টেলিভিশনের অপরিসমি ভূমিকা রয়েছে।

টেলিভিশন ও বিশ্ব শিল্প: টেলিভিশন দূরকে নিকট করে। সারা বিশ্বকে এনে দেয় চোখের সামনে। হিউস্টনে বসে আমেরিকার মানুষ দেখতে পেয়েছিল চাঁদের বুকে নীল আমস্ট্রং-এর অবতরণ। বাংলাদেশে বসে আমরা দেখতে পাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বড় বড় খেলাসমূহ। দেখতে পেয়েছি জাপানে অনুষ্ঠিত মোঃ আলী ক্লের মুষ্টিযুদ্ধ, ইংল্যান্ডের রাজপুত্র চার্লস-এর বর্ণাঢ্য বিবাহ উৎসব, সুদূর মক্কার কা’বা প্রাঙ্গনের হজ্জ্ব, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আরো হাজারো চমকপ্রদ ঘটনাবলি। টেলিভিশন প্রতিদিনকার পৃথিবীকে তথ্যে সমৃদ্ধ করে আমাদের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত করে দিচ্ছে।

শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশে টেলিভিশন: শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে টেলিভিশন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নিজস্ব ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশ জাতীয় উন্নয়নের একটি অপরিহার্য শর্ত। টেলিভিশনে বিভিন্ন প্রকার গান, বাজনা, নাচ, নাটক, আবৃত্তি, কৌতুক প্রচারিত হয়। এতে একদিকে যেমন শিল্পচর্চার অব্যাহত ধারা সৃষ্টি হয় তেমনি জাতীয় জীবনে প্রতিভা বিকাশের পথও প্রশ্বস্ত হয়। টেলিভিশনে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিল্পী ও উপস্থাপকদের উপস্থাপনা, কথাবর্তা, বাচনভঙ্গি ইত্যাদির শিল্প মাধুর্য জনগণের মধ্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

গণতান্ত্রিক সরকার ও টেলিভিশন: গণতান্ত্রিক সরকার সৃষ্টির একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম টেলিভিশন এর মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রধান বা দেশের প্রখ্যাত নেতাগণ জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করে দেশ ও সমাজের কল্যাণের লক্ষ্যে গণসচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি করতে পারেন। সরকারের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যাবলির প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র গড়ে তোলা যায়।
টেলিভিশন ও বাংলাদেশ: সমস্যাসংকুল বাংলাদেশে টেলিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সমাজের নানা সমস্যার সমাধানকল্পে টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে যথেষ্ট সুফল পাওয়া সম্ভবপর। টেলিভিশন গণশিক্ষার একটি উপযুক্ত মাধ্যম। উন্নত দেশে স্কুল কলেজে শিক্ষাদানের অনুষ্ঠান, পাঠ্যপুস্তকের আলোচনা, বিজ্ঞান ও গবেষণা বিষয়ক আলোচনা, বিতর্ক অনুষ্ঠান, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা ইত্যাদি প্রচার করে শিক্ষা বিস্তারে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারে।

কৃষি ও টেলিভিশন: বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। জাতীয় উন্নতির অন্যতম শর্ত কৃষির উন্নতি। এ লক্ষ্যে টেলিভিশনের উন্নত পদ্ধতিতে চাষবাস, সঠিক সময়ে উপযুক্ত শস্যের আবাদ, মৎস্য চাষ, পশুপালন, খামার স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন, আলোচনা ও প্রশিক্ষণমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে বাংলাদেমের কৃষকদের অশেষ উপকার-সাধন করা যায়। এই উপলক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে ক্লাব অথবা সেবা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র কৃষকদের দর্শনের সুবিধার্থে অধিকসংখ্যক টিভি সেট সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

জাতি গঠনে টেলিভিশন: একটি জাতি গঠনে এবং জাতিকে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে টিশিভিশনের সমকক্ষ আর কিছু নেই। ক্ষেত-খামার থেকে শুরু করে কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খেলাধূলা ইত্যাদির সকল বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে টিলিভিশন জাতির প্রতিটি সদস্যকে কিছু না কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে।

জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে টেলিভিশনের গুরুত্ব: বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পরিবার পরিকল্পনা, সমাজের নানা প্রকার দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা ইত্যাদি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আইন আদালত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের চোরাচালানী, কালো-বাজারী, দুর্নীতি, ধূমপান বা মাদকদ্রব্যের মরণনেশা ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নৈতিক অধঃপতন রোধে এবং দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের ভূমিকা অসামান্য। বিনোদনের ক্ষেত্রে টেলিভিশন অবশ্যই উন্নত রুচির শিল্প মাধুর্যমন্ডিত অনুষ্ঠান প্রচার করে জনগণকে সুস্থ ও নির্মল আনন্দ-প্রধানের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। টেলিভিশনের মাধ্যমে একটি জাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞান লাভ করতে পারে।

উপসংহার: উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলোতে টেলিভিশনকে শুধুমাত্র বিনোদনের বিলাসসামগ্রী হিসেবে না দেখে এবং ধনীগৃহে এর ব্যবহার সীমিত না রেখে সরকারি প্রচেষ্টায় তাকে গণমুখী করে তোলা দরকার।
  পল্লী উন্নয়ন

ভূমিকা:

‘লাগলে মাথায় বৃষ্টি বাতাস
উল্টে কি যায় সৃষ্টি আকাশ
বাঁচতে হলে লাঙ্গল ধর রে
আবার এসে গাঁয়।’
                                            -শেখ ফজলুল করিম।

হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ- যার মূলভিত্তি ‘ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো’। প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম (বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী) নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৭৭ জন১ লোক পল্লাীগ্রামে বাস করে। পল্লীর সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা রূপ নিয়ে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-

’আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’

কিন্তু পল্লীর সে-সৌন্দর্য এখন আর দেখা যায় না, আমাদের অবহেলার কারণে পল্লীগ্রামগুলো আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। মানুষ কেবলই- ‘ইটের পর ইট মাঝে মানুষ-কীট, নেইকো ভালোবাসা নেইকো মায়া’- এমনি কৃত্রিম সুখের অন্বেষণে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ কৃষিনির্ভর এই দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়, যদি না পল্লীর উন্নয়ন হয়। পল্লীর উন্নতি মানে দেশের উন্নতি।

পল্লী উন্নয়ন কী?: পল্লী উন্নয়ন বলতে পল্লীর উৎপাদন বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য এক পরিকল্পিত পরিবর্তনকে বুঝায়। আজকের বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ ভিত্তহীনদের, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ মহিলা ও শিশুদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করা। এবং সে নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার যথাযথ বণ্টন।

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি:
পল্লী উন্নয়নের একটি নবতর পদ্ধতি বা পল্লী উন্নয়নে সাম্প্রতিক ভাবনা : দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করে। তাই দেশের অর্থনীতি এখনও গ্রামীণ মানুষের সার্বিক কৃষি ও অন্যান্য কর্মের ওপর নির্ভরশীল। দেশের উন্নয়ন করতে হলে আমাদের গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়ন করতে হবে। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে। গ্রামীণ জনগণ প্রায়ই বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেক সময় অকাল মৃত্যুর কবলে পড়ে অল্প বয়সে পৃথিবীর সম্ভাবনাময় জীবনের ইতি টানছেন। অপরদিকে শিক্ষার নিম্নহার আমাদেরকে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দারুণভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব যখন কম্পিউটার জগতে প্রবেশ করে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা এখনও গণ স্বাক্ষরতা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া প্রতি বছর প্রাকৃতিক দূযোগ ব্যাপক হারে গ্রামীণ জনগণের জানমালের ক্ষতি করছে। ফলশ্রুতিতে আমরা বিশ্ববাসীর জীবন মানের তুলনায় বিরাট অসম দূরত্বে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। এ লক্ষে পরনির্ভরশীরতা কাটিয়ে পারিবারিক পর্যায়ে পরিবারকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত পূর্বক গ্রামের সব পরিবারের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন সমতালে এগিয়ে নেয়ার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদ আহরণের মাধ্যমে এবং গ্রামীণ জনগণের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট তৃণমূল পরিকল্পনার ভিক্তিতে পারিবারিক ও গ্রামীণ উন্নয়নের বিকাশ সাধনই পল্লী উন্নয়নের সাম্প্রতিক ভাবনা।২

প্রাচীন-পল্লী:
চাষী ক্ষেতে চালাইতে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার।
তারি’পরে ভার দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’
                                                                        -রবীন্দ্রনাথ।

-প্রাচীন পল্লীর এই ছিল রূপ। আদিকাল থেকেই পল্লীগ্রাম ছিল দেশের প্রাণকেন্দ্র। পল্লীবাসী মানুষের ছিল গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর-ভরা মাছ, গলায় গলায় গানের সুর, কুটিরশিল্পের প্রচলন। ঢাকার মসলিন কাপড় ও জামদানি শাড়ি তৎকালীন মোগল বাদশাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কুমিল্লার হুক্কা ও খদ্দর-কাপড়, ময়নামতির ছিট কাপড়, পল্লীর নকশীকাঁথাও তৎকালীন ঐতিহ্য বহন করেছিল।

বর্তমান-পল্লী:
’বড় দুঃখ, বড় ব্যথা সম্মুখেতে কষ্টের সংসার,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
                                                               -বন্দে আলী মিয়া

গ্রামের সেই সহজ-সরল চিত্রপঠ এখন আর নেই। দিন বদলের পালায় বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। সর্বগ্রাসি বিশ্বায়নের এই যুগে বদলে যাচ্ছে মানুষের রুচি, অভ্যাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড, পেশাসহ অনেক কিছুই। গত এক বা দুই যুগের ব্যবধানে শুধু যে রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরের চাকচিক্য ও জৌলুশ বেড়েছে তাই নয় গ্রাম পর্যায়ে আরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আমাদের ঘরের চালে লাউ-কুমড়োর সবুজ লতানো গাছপাতা শোভা পায় না। কোনো গ্রামে ছায়াঘেরা মাটির দেয়াল তোলা ছনের ঘর চোখে পড়ে না। প্রায় সব গ্রামেরই চোখে পড়বে পাকা দালান-কোঠা। গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। ফ্রিজ, টিভি এখন ঘরে ঘরে। খাওয়ার পানির জন্য গ্রামের বাড়িতে আগে ছিল পাতকুয়ো এবং ইদারা, আজ তা নিশ্চিহ্ন। সে স্থান দখল করে নিয়েছে নলকূপ। গত শতক নাকি চিহ্নিত হয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রসার ও ব্যবহারের জন্য। তার ঢেউ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে লাগে নি তা নয়। বেশ ভালোভাবেই লেগেছে। তার মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়েছে আশ্চর্যজনকভাবে। গ্রামেগঞ্জে যার তার হাতেরই এই ফোন। এটা ছাড়া কারোই দিন চলছে না। চাষাবাদ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দেশ-বিদেশে থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সকল ক্ষেত্রেই চলছে মোবাইলের ব্যবহার। গ্রামীণ জীবনের অচলায়তন ভাঙতে এই মোবাইলের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিচার বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। দক্ষিণ বাংলায় যেখানে বিদ্যুৎ যায় নি সেখানে দেখা যাচ্ছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল, রহিম আফরোজ, গ্রামীণ শক্তি এসব প্যানেল বিক্রি করছে। আরেকটা বড় মানসিক পরিবর্তনের কথা না বললেই নয়। সেটা হল স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা। গ্রামের দরিদ্ররা আজ কোনো না কোনোভাবে একটা কাজ খুঁজে নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছ। গ্রামেগঞ্জে এখন নানারকম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। হাঁস-মুরগী পালন, ছাগল-গরু পালন, মাছ চাষ, নানা উন্নত জাতের কৃষি ফলনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগণ এখন নিজ প্রচেষ্টায়ই স্বাভলম্বী হতে শুরু করছে। স্ব-নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। শহরের মানুষ বাসার জন্য গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের খুঁজত ’কাজের ছেলে’ বা ’কাজের মেয়ে’ হিসেবে নিয়োগের জন্য। আজকাল তেমন কাউকে পাওয়া মুশকিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমে আসছে। এখন নব্য ধনীক শ্রেণী ও যুবক শ্রেণী গ্রামের ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্বে গ্রামের বয়স্ক মাতব্বর এই ক্ষমতা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করত। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষালাভের আগ্রহ বাড়ছে এবং তারা শিক্ষিত হচ্ছে। এভাবে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও পরিবর্তন ধারা অব্যাহত আছে।

পল্লী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বা জাতীয় উন্নতিতে পল্লীর গুরুত্ব: আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল উৎস পল্লী। পল্লী উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সর্বমুখী বা সর্বজনীন কল্যাণ সম্ভব নয়। পল্লীর অবস্থান ও উন্নয়নের উপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাই পল্লীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যে যেসব উপকরণ প্রয়োজন, পল্লীতে তার কোনো অভাব নেই, অভাব শুধু যুগোপযোগী শিক্ষা, আদর্শ ও কর্মপ্রেরণার। পল্লী সব সময়েই উন্নয়নযোগ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লীর সামগ্রীক উন্নয়নসাধন সম্ভব। তাই কবিগুরুর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে পারি-
”ফিরে চল ফিরে চল মাটির টানে।”

পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পণা: পল্লীর ভাগ্য উন্নয়নের মাঝেই সার্বিক উন্নয়ন নির্ভরশীল একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ উন্নয়ন- কাজে অগ্রসর হতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পল্লীবাসীকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সকল সময় সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। আত্মশক্তির উপর ভরসা করেই আমাদেরকে পল্লী-উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হতে হবে। উন্নয়নের প্রতিটি ব্যবস্থা যাতে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে, তার জন্যে সুষ্ঠু পরিকল্পণা গ্রহণ করতে হবে।

পল্লী উন্নয়নের উপায় ও গৃহীত উদ্যোগ: বাংলাদেশে পল্লী উন্নয়নের চাবিকাঠি হল : (ক) দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, (খ) আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন, (গ) ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, (ঘ) পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, সুযোগ সুবিধার অংশীদারিত্ব, পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির মূল্যায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ; (ঙ) অপ্রতুল সম্পদের ব্যবহার ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রামীণ জনগণকে অধিকতর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান। তাই সঠিক কর্মসূচি নিয়ে গ্রামে জনগণের উন্নতিকল্পে এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যায়:

পল্লী উন্নয়নের উপায়:

(১) শিক্ষার ব্যবস্থা:
‘এই বড় মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা,
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।’
গ্রামের মানুষের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পল্লীর অনগ্রসরতার মূল কারণ অশিক্ষা ও কুশিক্ষা।

(২) স্বাস্থ্য উন্নয়ন: পল্লীর ৭৫% শিশু অপুষ্টির শিকার। বছরে ত্রিশ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধত্বের কবলে পড়ে, লাখ লাখ শিশু মারা যায় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার আক্রমণে। অধিকাংশ গ্রামে রয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা। সাম্প্রতিক কালে গ্রামে গ্রামে আর্সেনিক দূষণ গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষার মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত স্বাস্থ্য শক্তিশালী- জাতি গঠনে সহায়ক- এ সত্যকে সামনে রেখে পল্লীর জনস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং এর জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

(৩) কৃষি উন্নয়ন: বাংলাদেশের পল্লীজীবন কৃষিভিত্তিক। বর্তমান যুগের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় কৃষিব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের দেশে কৃষকদের অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন করতে হবে।

(৪) কুটিরশিল্পের উন্নয়ন: কুটিরশিল্পের মাধ্যমে গ্রামের বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে। কুটিরশিল্পক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত সরকারকে প্রসারিত করতে হবে। কারণ, গ্রামবাসীর অগ্রগতিই দেশের অগ্রগতি।

(৫) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: যাতায়ত ও মালামাল পরিবহনের জন্যে রাস্তাগুলোর সংস্কার সাধন ও পর্যাপ্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে।

(৬) মৎস্য চাষের ব্যবস্থা: গ্রামে অনেক হাজামজা পুকুর নালা ডোবা পতিত অবস্থায় আছে। এগুলো সংস্কার করে মাছ চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৭) পল্লী বিদ্যুতায়ন: পল্লীর জনগণের উন্নতির জন্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন একান্ত অপরিহার্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ-সুবিধা পৌঁছায় নি। তাই যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৮) সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলা: গ্রামের জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে তাদেরকে সঞ্চয়ী করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়ী ব্যাংক যেমন: গ্রামীণ ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক প্রভৃতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও-

(৯) ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা

(১০) কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা

(১১) সমবায় প্রবর্তন করা

(১২) প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও পরবর্তী পুনর্বাসন এবং

(১৩) সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে।
গৃহীত উদ্যোগ: বর্তমান পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিতে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি প্রচেষ্টা পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। পল্লীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্যে কৃষি, গবাদি পশু পালন, সমবায়, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম এ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। সর্বোপরি উপর্যুক্ত আলোচনায় পল্লী উন্নয়নের জন্যে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে সরকার ইতোমধ্যে সবকটি পদক্ষেপই নিয়েছেন, তন্মধ্যে-

১. গ্রামে শিক্ষাবিস্তারের জন্যে স্কুল-কলেজের ব্যবস্থা করেছেন।
২. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা, সর্বজনীন শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বায়স্কশিক্ষা, অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।
৩. গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবল করার জন্যে সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
৪. কুটিরশিল্পের উৎকর্ষ বিধানের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান ও মূলধন সরবরাহ করা হচ্ছে।
৫. কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে।
৬. জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে নানাধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
৭. জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত মোকাবিলায় এবং বেকার-সমস্যা সমাধানে নানাধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
৮. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাপল্পে নানাধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত হয়েছে।
৯. ঋণের ব্যবস্থা করেছেন।
১০. গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টি আর) কর্মসূচির আওতায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮০ মে. টন চাল ব্যয়ে ৯৪ হাজার ১৭০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন।

পল্লী উন্নয়নের জন্যে সরকারের এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে পল্লীর জীবনে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। বিংশ শতাব্দীর গ্রামকে আর অবহেলিত বলা চলে না, একবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে শহর আর গ্রামের পার্থক্য নির্ণয় করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে- যা আমাদের সবার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও বহুবিধ সমস্যা ও বাধা রয়ে গেছে।

পল্লী উন্নয়নের সমস্যা: পল্লী উন্নয়ন প্রয়াস সম্পর্কিত অতীত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ থেকে বড় ধরনের বেশ কিছু সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায়, যেগুলি সকল প্রয়াসের সফল সম্পাদনকে ব্যাহত করে আসছে। এসব সমস্যা হচ্ছে: ১. পল্লী উন্নয়ন সংস্থাসমূহের অস্থায়িত্ব, ২. অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব, ৩. কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক স্থানীয় সরকারগুলোকে অসহযোগিতা, ৪. একটা সুবিন্যস্ত পল্লী উন্নয়ন নীতিমালার অভাব, ৫. পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উদ্ভূত সযোগ-সুবিধার অসম বণ্টন, ৬. প্রাকৃতিক ও লব্ধ সম্পদের সীমাবদ্ধতা, ৭. পল্লী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনায় উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য এবং অসহায়ক এক গ্রামীণ সমাজ।

বাংলাদেশের পল্লীর আর্থসামাজিক বুনিয়াদের প্রকৃতিই পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দেখা দেয়। সেসব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুঁজি গঠনের নিম্নস্তর, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি, নিপুণ ও শিক্ষিত জনশক্তির অভাব, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, বিদেশি সহায়তার উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রাম্য রাজনৈতিক দলাদলি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনুন্নত বাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ।

একবিংশ শতাব্দীর পল্লী উন্নয়ন চিন্তা: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বিপর্যয়ের সম্মূখিন। এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে দরিদ্রতম এবং বেশির ভাগ জনসংখ্যা মূলত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে অপরিকল্পিত এবং মাত্রাধিক্য ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ ব্যাপক ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং শষ্য উৎপাদনের জন্য মাটির উর্বরতা কিংবা উৎপাদনশীলতা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। আর স্বয়ংসম্পন্ন কৃষি ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করছে গ্রামীণ উন্নয়ন। এ জন্য একবিংশ শতাব্দীর পল্লী উন্নয়ন চিন্তা ভাবনায় কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ লক্ষে মাটির উপাদন, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণের প্রতি জোড় দেয়া হচ্ছে।

আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য: গ্রামে সহস্র অভাব, এই ভেবে গ্রাম ত্যাগ করলে চলবে না। গ্রামের মানুষকে ফিরে যেতে হবে গ্রামে এবং গড়তে হবে কলুষমুক্ত গ্রাম। সমস্যা এড়িয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হয় না। গ্রামের উন্নয়নকে নিজের মনে করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রবল প্রচেষ্টায় গ্রামের হৃতশ্রী পুনরুদ্ধার সম্ভব।

উপসংহার: দেশের পঙ্গু অর্থনীতিকে সজীব ও জীবন্ত করে তুলতে হলে গ্রামকে সজীব করে তুলতে হবে। ’গ্রামই দেশের প্রাণ’ এটা ভুলে গেলে চলবে না। ড. লুৎফর রহমান বলেছেন- ‘জাতিকে বড় করতে হলে পল্লীর মানুষকে প্রথমে জাগাতে হবে।’ গ্রামের উন্নতি ও দেশের উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আশা করা যায়, অচিরে আমাদের সরকার ও সচেতন দেশবাসীর সক্রিয় সহযোগিতায় গ্রামগুলোকে আমরা ‘সোনার গ্রাম’ হিসেবে দেখার সুযোগ পাব। তখন আমরা অতি আনন্দে নিমন্ত্রণ করবে-
”তুমি যাবে ভাই
যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয়?” 
 শিষ্টাচার

শিষ্টাচার কি?: আচরণে ভদ্রতা ও সুরুচিবোধের যৌক্তিক মিলনের নাম শিষ্টাচার। শিষ্টাচার মনের সৌন্দর্যের বাহ্য উপস্থাপনা। তার মার্জিততম প্রকাশ ঘটে সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে। যে মানুষ যত বেশি শিষ্ট তার প্রিয়তাও তত বেশি। আর এই শিষ্টতা তার চরিত্রকেও করে আকর্ষণীয়। মানুষের মাঝে লালিত সুন্দরের প্রকাশ তার চরিত্র। শিষ্টতা সেই সুন্দরের প্রতিমূর্ত রূপ।

অন্তর্গত মহত্ত্ব মানুষকে উদার করে। আর সেই উদারতা ব্যক্তিকে রূঢ় করে না, তাকে শিষ্ট আর ভদ্র হতে শেখায়। মানুষের মাঝে এই মহত্ত্বের পরিশীলিত প্রকাশই শিষ্টতা। সাধারণভাবে চালচলন, কথাবার্তায় যে ভদ্রতা, শালীনতা আর সৌজন্যের পরিচয় পাওয়া যায় তা-ই শিষ্টতা। শিষ্টাচার ব্যক্তিজীবনের যেমন তেমনি সমাজজীবনেরও গৌরবসূচক আভরণ।

আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয়, ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে তবে কখনো শিষ্টাচার হওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পালে কখনো পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। মানবিক সত্তা তার স্ফুরণে চরিত্রে সাধুতাকে অবলম্বন করে, তার প্রকাশ ঘটে শিষ্ট স্বভাবে। ঐদ্ধত্য আর উচ্ছৃঙ্খলতা এখানে পরাজিত হয়। অহংকার অন্যকে ছোট ভাবতে শেখায়। শিষ্টতা বিপরীতভাবে মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। কদর্যতা আর অশ্লীলতা শিষ্টাচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কাজেই ব্যক্তিকে হতে হয় আচরণে মার্জিত, বক্তব্যে সৎ, সরল আর স্পষ্ট। বিনয় মানুষকে ছোট করে না, বরং পরায় সম্মানের মুকুট। এই বিনয় শিষ্টতার অঙ্গভূষণ।

শিষ্টাচারের গুরুত্ব: আচরণে যে জাতি যত বেশি সভ্য সে জাতি তত বেশি সুশৃঙ্খল ও উন্নত। কেবল পশুপাখির মতো বেড়ে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য নয়। আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ও জাতীয় জীবনে কোনো-না-কোনো ভাবে অবদান রাখা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আর তা করতে হলে শিষ্ট আচরণের অনুশীলন ছাড়া বিকল্প নেই। শিষ্টাচারের প্রথম প্রকাশ ঘটে ব্যক্তিস্বভাবে। যা ক্রমাগত ব্যক্তি থেকে আলোর বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা সমাজে, রাষ্ট্রে। এর আলোতে উজ্জ্বল ব্যক্তির আত্মিক মুক্তির সাথে যোগ হয় বৈষয়িক অগ্রগতি। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজের অপরাপর দশ জনের সাথে যোগাযোগ আর ভাবের আদান-প্রদান করতে হয়। এরই মাঝে শিষ্টজন সহজে সকলের মন জয় করতে পারে। পারস্পরিক সম্প্রীতির জন্যে এর খুবই প্রয়োজন। কেননা সম্প্রীতি না থাকলে হিংসা আর হানাহানি সমাজকে ঠেলে দেয় বিশৃঙ্খলার দিকে।

শিষ্টাচারী ব্যক্তি দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু তার সৌজন্যে আর বিনয়ের মাধ্যমে সে সকলের প্রিয়তা অর্জন করে। শিষ্টজন সহজেই অর্জন করেন অন্যের আস্থা। অন্যের সহানুভূতি লাভ করার জন্যে শিষ্টজনই উত্তম। অপর দিকে শিষ্টাচারীকে সকলে সম্মানের চোখে দেখে। সামাজিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্যে শিষ্টাচারের বিকল্প নেই। এতে করে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সকলের আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে সুষম উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি।
শিষ্টাচার ও ছাত্রসমাজ: জ্ঞানার্জনে নিষ্টা, অভিনিবেশ আর শৃঙ্খলাবোধের পাশাপাশি শিষ্টাচার অনুশীলন খুবই জরুরি। নৈতিক চরিত্রে উৎকর্ষের জন্যে ছাত্রজীবনেই ব্যবহারের ভব্যতা আর শিষ্টতার সম্মিলন ঘটানোর কোনো বিলল্প নেই। কাজেই দেখা যাচ্ছে জ্ঞানের সাথে শিষ্টাচারের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ ঘটে পোশাক-পরিচ্ছদে। রুচিশীল আর সরল জীবন-যাপনের পাশাপাশি পোশাকের ক্ষেত্রেও সুরুচির পরিচয় থাকা দরকার।

শিষ্টাচার ও সমাজ: সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক- প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিষ্টাচারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তা না হলে বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানি আর অশান্তি জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠায় সমাজ-ব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব প্রদর্শন করা দরকার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যৌক্তিক সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিলে শিষ্টাচারী হওয়া যাবে না। সমাজে নিজের অবস্থান সম্পর্কে থাকতে হবে সতর্ক। সামাজিক অবস্থান শিষ্টাচারের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই ভাবে ক্রোধ আর প্রতিহিংসার মতো চারিত্রিক দোষগুলো অতিক্রমের চেষ্টা থাকতেই হবে। এব বিপরীতমখী দিনগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্যে দরকার চারিত্রিক দৃঢ়তা।

শিষ্টচার ও রাষ্ট্র: জাতীয় জীবনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিষ্টতার প্রকাশ পায় রাষ্ট্র পরিচালনায়, নেতৃত্ব প্রদানকারীদের মধ্যে। এর প্রভাব পড়ে গোটা দেশজুড়ে। আবার আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণে কুটনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিষ্টতার বিকল্প নেই। চরম লাভ-লোকসানের ব্যাপার ব্যবসা-বাণিজ্যেও শিষ্টচারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

শিষ্টাচার না থাকার কুফল: শিষ্টাচারহীন সমাজ ও অন্তঃসারশূন্য, বিবেকহীন। সমাজে সৌন্দর্য আর সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোর দেখা মেলে না। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে বিরোধ হয়, দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়। সর্বোপরি মানব সভ্যতা চরম হুমকির মুখোমুখি দাঁড়ায়। শিষ্টাচারহীন মানুষ সবসময় উদ্ধত থাকে। আলাপ-আলোচনায় তার মধ্যে প্রকাশ পায় অমার্জিত ভাব। তার আচরণে প্রাধান্য পায় দুর্ব্যবহার ও দুর্মুখতা।

শিষ্টাচার অর্জনের উপায়: শিষ্টাচার নিজ থেকে মানব হৃদয়ে জন্ম নেয় না। একে বরণ করে নিতে হয়। এর চর্চা শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। তাই শিশু কোন পরিবেশে, কার সহচর্যে কীভাবে বেড়ে উঠছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে পয়োজন শিক্ষার। কেননা আমৃত্যু চলতে থাকে শিষ্টাচারের অনুশীলন। শিশু পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী কিংবা প্রতিবেশী যাদের সাহচর্য়ে থাকে তাদের কাছ থেকেই আচরণ শেখে। তাই সৎসঙ্গ শিষ্টাচারী হতে সাহায্য করে। স্কুল-কলেজেও শিক্ষার্থীরা শিষ্টাচারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। ভালো বইও একজন সৎ অভিবাবকের মতোই শিষ্টাচার শেখাতে পারে।

উপসংহার: শিষ্টাচারের ভিত্তিভূমিকার ওপর গড়ে ওঠে সৎ চরিত্রের সুরম্য অট্টালিকা। সৎ চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা শিষ্টাচারের অন্তরায়। তা প্রতিনিয়ত মানবিক মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে সমাজকে করে তুলতে পারে নিঃস্ব রিক্ত সর্বস্বান্ত। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে আমরা হতে পারি সমস্যা-জর্জরিত। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সুস্থতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে তাই আমাদের শিষ্টাচারের চর্চা করা উচিত।
   সংবাদপত্র

ভূমিকা: সংবাদপত্র আধুনিক জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। গণতান্ত্রিক যে-কোনো দেশে তা সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের দর্পণ। সমাজজীবনের দৈনন্দিন পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পৃক্ততায় এবং নিরন্তর তার বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনায় সংবাদপত্র এখনো শক্তিশালী গণমাধ্যম। জনমতের প্রতিফলনে ও জনমত গঠনে সংবাদপত্র পালন করে শক্তিশালী ভূমিকা। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধন।

সংবাদপত্রে মানদণ্ড: একটি সংবাদ পত্রের চারটি গুণ থাকা আবশ্যক। যথা:

(১) সহজপ্রাপ্যতা: একটি সংবাদ পত্র সহজে জনসাধারণের কাছেই থাকবে। যেমন দোকান, লাইব্রেরি, হকার্স দ্বারা ঘরে ঘরে পাঠেয়ে ইত্যাদি। বর্তমানে এতই সহজপ্রাপ্য যে ইন্টারনেটে দেশের বা বিশ্বের জনপ্রিয় সংবাদপত্রগুলো সহজেই দেখা যায় ও পড়া যায়।

(২) পর্যাবৃত্তি: যেসকল পত্রিকা দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, পাক্ষিক বা অন্য যেকোনো ধারায় প্রকাশ করা হয় সেগুলো তাদের নির্দিষ্ট সময় পর পর পুনঃ পুনঃ প্রকাশ করবে। এই ধারার পরিবর্তন হয় না। যেমন যে পত্রিকা সাপ্তাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় সেটি প্রতি সাত দিন পর পর অবশ্যই প্রকাশিত হবে এবং এই ধারা ভঙ্গ হবে না।

(৩) সাম্প্রতিকতম: সংবাদপত্র যে পর্যাবৃত্তিতেই প্রকাশিত হোকনা কেন তা অবশ্যই হতে হবে সর্বশেষ সত্য সংবাদে পূর্ণ।

(৪) সার্বজনীনত্ব: সংবাদপত্র অবশ্যই হতে হবে সব মানুষের জন্য। কোনো বিশেষ ধর্ম, বর্ণ বা বিশেষ গোষ্টিকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ হবে না বা অন্য গোষ্টিকে তাচ্ছিল্য করবে না। সংবাদপত্র হবে সকলের।

একটি ভালো মানের পত্রিকার এই চারটি দিক অবশ্যই থাকে।
সংবাদপত্রের ইতিহাস: সংবাদপত্রের ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রাচীন কালে রোমে সরকারের সংবাদ জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য সংবাদ পাথরে খোদাই করে তা নির্দিষ্ট দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। এরপর চীনে একটি রাজনৈতিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো ব’লে জানা যায়। ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্ব কালে সরকারের অভ্যন্তরিন কর্মচারীদের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদানের জন্য একটি হাতে লিখা সংবাদের কাগজ আদান প্রদান হতো।

১৭৮০ সালে ইংরেজদের মধ্যে সংবাদ প্রেরণের জন্য কলকাতায় দুই পাতার ‘ইন্ডিয়ান গেজেট’ নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৮ সালে ’সোমপ্রকাশ’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করনে। ১৮৬১ সালে প্রথম বাংলা ছাপা অক্ষরে ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সাল থেকে কাজগের সংবাদপত্রের পাশাপাশি হুবহু সংবাদপত্র ইন্টারনেটে থেকেও পড়ার সুযোগ তৈরি হয়।

সংবাদপত্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা: দৈনন্দিন জীবনের নানা অপরিহার্য তথ্য প্রতিদিন আমাদের হাতে তুলে দেয় সংবাদপত্র। পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যার মতো খবরাখবর সংবাদপত্র আমাদের জানিয়ে দেয়। এভাবে দেশ ও বিশ্ববাসীকে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সংবাদপত্রে দুর্ঘটনার খবর পড়ে নিহত-আহতের সন্ধানে ছুটে যেতে পারে তাদের আত্মীয়-পরিজন। সাম্রজ্যবাদী কিংবা আগ্রাসী তৎপরতা যখন সভ্যতাকে গ্রাস করে তখন সংবাদপত্র তার বিরুদ্ধে মানবতার জাগরণ ঘটায়। পারমাণবিক যুদ্ধ কিংবা স্নায়ুযুদ্ধের ভয়াবহতায় পৃথিবীর ধ্বংস-আশঙ্কা দেখে দিলে শান্তির সপক্ষে নেয় সচেতন দায়বদ্ধ ভূমিকা। দেশে সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র জনগণের টুটি চেপে ধরলে সংবাদপত্র তার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের পটভূমি রচনা করে। গণআন্দোলনের পক্ষে নেয় কার্যকর অবস্থান। যেখানেই মানবতার লাঞ্ছনা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিবেকের কণ্ঠরোধ, সেখানেই সংবাদপত্রের কণ্ঠস্বর নেয় প্রতিবাদী ভূমিকা।

আধুনিক সংবাদপত্রের বিষয়-বিস্তার: আধুনিক সংবাদপত্র কেবল সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম নয়। দেশ-বিদেশের রানীতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও এতে থাকে বিচিত্র তথ্য প্রতিবেদন। শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের বিচিত্র কর্মধারা এখন সংবাদপত্রের আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, ভূগোল, দর্শন- যে-কোনো বিষয়ের খবরাখবর, প্রবন্ধ এখন সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। শিশু-কিশোর ও ছাত্রছাত্রীদের জন্যে থাকে আলাদা বিভাগ, আলাদা পাতা। মেয়েদের জন্যে তো আলাদা পাতা থাকেই। এখন আমাদের দেশে পত্রিকার পাতায় আলাদাভাবে যোগ হয়েছে কোনো বিশেষ এলাকার জন্যে সাপ্তাহিক আলাদা পাতা। দীর্ঘকাল ধরে জনমত ও জনজীবনের সমস্যা ভিত্তিক চিঠিপত্রের কলাম ছিল পত্রিকার বিশেষ অঙ্গ। এখন কোনো কোনো পত্রিকা আবার পঠকদের নিয়ে আলাদা মঞ্চ বা ফোরাম গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে পাঠকদের মতামত জরিপ করে তার প্রতিবেদন প্রকাশ করছে এবং ঐসব ইস্যুতে সরকার ও জাতির করণীয় সম্পর্কে আলোকপাতের চেষ্টা করছে। আসলে সংবাদপত্র এখন জনজীবনের প্রায় সব দিককেই তার আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে। বিশেষ করে স্যাটেলাইট টিভির প্রভাব ব্যাপক হয়ে পড়ায় তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে সংবাদপত্র নিত্যনতুন বিষয়কে ধারণ করছে। ফলে এখন সংবাদপত্র হয়ে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের নির্দেশিকা। ভাগ্য গণনা, পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, চাকরির সন্ধান, অবসর নিবোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, হরতাল-ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ, আলোচনা-সেমিনার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির নির্দেশিকা, পরীক্ষার তারিখ ও ফলাফল, বার্ষিকী কিংবা দিবস পালন, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, পুরস্কার ও সম্মাননা- কী থাকছে না সংবাদপত্রে? দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সংবাদপত্র এখন আমাদের চলমান নির্দেশিকা।

সংবাদপত্র ও জনমত গঠন: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। ফলে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও ভূমিকা জাতীয় অগ্রগতির পক্ষে কতটা সহায়ক এবং কতটা জনস্বার্থের পরিপূরক তা নিয়ে জনগণের মধ্যে অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ক্ষমতাসীনরা সবসময় তাদের পদক্ষেপকে জোর গলায় ইতিবাচক বলে প্রচার করে এবং বিরোধীরা তাকে একেবারেই প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সংবাদপত্র উভয় পক্ষের মতামত, যুক্তি ও তথ্যনির্ভর আলোচনা প্রকাশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজেদের অভিমত গঠন করতে পারে। সংবাদপত্রের পাতায় জ্ঞানীগুণী ও বিশেষজ্ঞদের লেখা প্রবন্ধ ও অভিমত, কলাম লেখকদের তর্কবিতর্ক, যুক্তিপ্রদান ও যুক্তিখণ্ডন, পত্রিকার নিজস্ব সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় মতামত জনমত গঠনে সাহায্য করে। আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি ইত্যাদি ইস্যুতে জনমত গঠনে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য কখনো কখনো কোনো কোনো সংবাদপত্র বিশেষ গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে জনমতকে তাদের পক্ষে টানার জন্যে সংকীর্ণ উদ্দেশ্যপূর্ণ নানারকম প্রচারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু পাঠক সমাজ সচেতন হলে শেষ পর্যন্ত এসব সংবাদপত্রের অপপ্রচারের চেষ্টা ও হীন উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিপূরক ভূমিকা: সংবাদপত্র বর্তমানে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমভিত্তিক এবং পরীক্ষা-নির্ভর সার্টিফিকেট প্রদানের শিক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞানের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা নোট ও গাইড-বই নির্ভর মুখস্থ বিদ্যায় পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্র এখন যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রকেই তার আওতায় এনেছে তার ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠে বহুমুখী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়। এত তাদের জ্ঞানের ক্ষেত্র যেমন সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয় তেমনি বিষয়জ্ঞানের পাশাপাশি ভাষাজ্ঞানও বাড়ে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটে। তাদের শিক্ষা হয় সর্বতোমুখী।

সংবাদপত্রের অপকারিতা: সংবাদপত্রের অনেক উপকারিতা থাকলেও কিছু কিছু অপকারিতাও আছে। কখনো কখনো মিথ্যা, উদ্ভট খবর প্রচার করে পাঠককে বিভ্রান্ত করে থাকে। এতে মানুষ এবং দেশের ক্ষতি হয়। সংবাদপত্রের মালিকানা ব্যক্তিগত বলে মালিকের খেয়ালখুশিমত তা পরিচালিত হয়। কোনো কোনো পত্রিকা রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে বানোয়াট খবর প্রচার করে, এতে দেশ ও জনগণের উপকারের চেয়ে অপকার হয় বেশি।

উপসংহার: বর্তমানে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মানব উন্নয়ন এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যেও সংবাদপত্র ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। উন্নততর জীবন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আগ্রহ সৃষ্টিতেও সংবাদপত্রের দায়িত্ব কম নয়। বর্তমানে স্যাটেলাইট যোগাযোগ প্রযুক্তির ফলে গণমাধ্যমে উন্নত দেশের একচেটিয়া আধিপত্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের সংবাদপত্রকে হতে হবে ঐতিহ্য-সচেতন, জাতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। আমাদের দেশে ব্যাপক নিরক্ষরতা, সমাজজীবনে পশ্চাৎপদতা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে সমাজজীবনে আদুনিক ধ্যান-ধারণা ও বিজ্ঞানমুখী চেতনার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা হতে হবে কল্যাণমুখী। লুটেরা পুঁজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজজীবনে যে সন্ত্রাস, ও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিভেদ ও জবরদস্তিমুলক মানসিকতার বিস্তার ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে এবং দেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন সুশীল সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র সততা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দেবে- এটাই সবার কাম্য। জনস্বার্থে ও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানই সংবাদপত্রকে সত্যিকার অর্থে জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।