মানব
কল্যাণে বিজ্ঞান
ভূমিকা: বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের অব্যাহত
জয়যাত্রার এক যুগান্তকারী যুগ। একদা গুহাবাসী, অরণ্যচারী মানুষ বিজ্ঞানের বদৌলতে আজ
ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় বেগ, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে
করেছে দ্রুততর ও বহুমাত্রিক। ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর-দূরান্তরের ব্যবধান। মানুষকে দিয়েছে
অনিঃশেষ সম্ভাবনার অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা।
বিজ্ঞানের উদ্ভব: বিজ্ঞান শব্দের অর্থ
বিশেষ জ্ঞান। অতি প্রাচীনকালে মানুষের বিশেষ কৌতূহলের চেতনায় বিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটেছিল।
প্রাকৃতিক নানা বিষয় সম্পর্কে অন্বেষু দৃষ্টি মানুষের মনে বিজ্ঞানের প্রেরণা সঞ্চারিত
করেছে। আর এই প্রেরণাই মানুষকে পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে এবং বিজ্ঞানকে নিজ
প্রয়োজনে ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
মানব সভ্যতায় বিজ্ঞান: প্রাচীন কালে,
বিজ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতের এক অসহায় ক্রীড়নক। গুহাবাসী সেই
পশুসদৃশ মানুষ যখন প্রথম পাথর ঘষে আগুন জ্বালায় তখন থেকেই শুরু হয় মানুষের বৈজ্ঞানিক
আবিষ্কার। তারপর সেখানেই বাধার সম্মুখীন হয়েছে, কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে, মানুষ
ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব
বিস্তার করেছে। বিজ্ঞানই মানুষকে গুহাবাসী অবস্থা থেকে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত করেছে।
বিজ্ঞানীর আত্মত্যাগ: বিজ্ঞানের অগ্রগতির
সাথে সাথে মানব সভ্যতাও অগ্রগতির দিকে এগিয়েছে। অতীতের সাথে বর্তমান পৃথিবীর তুলনা
করলে এ সম্পর্কে কোনো সংশয় থাকে না। কিন্তু এই উন্নতির পেছনে অসংখ্য বিজ্ঞানীর অবদান
সম্পর্কে চিন্তা করলে আপনা থেকেই আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। সত্য কথা বলেছিলেন বলে ব্রুনোকে
আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, ল্যাভয়সিয়েকে হত্যা করা হয়েছিল গিলোটিনে। মহান বিজ্ঞানী
আর্কিমিডিস, কোপর্নিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ অসংখ্য বিজ্ঞানী তাঁদের সমগ্র জীবন বিজ্ঞানের
পিছনে ব্যয় করেছেন। তাঁদের অক্লান্ত সাধনার পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমানে মানুষ এক অত্যাধুনিক
বিজ্ঞানের যুগে উন্নীত হয়ে সক্ষম হয়েছে।
মানব জীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান:
বর্তমান যুগে, মানব জীবনের বিভিন্ন শাখায় বিজ্ঞানের বহুবিধ অবদান পরিলক্ষিত হচ্ছে।
যাতায়াত, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ মানব জীবনের বহুক্ষেত্রে বিজ্ঞান এক বিশাল
ভূমিকা রাখছে। বিজ্ঞানকে এখন বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এর ফলে বিজ্ঞানকে মানব জীবনের বহুক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।
কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: মানব সভ্যতার
সূচনা লগ্নে মানুষ তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উর্বর জমিতে কৃষিকাজের
উপায় উদ্ভাবন করে। বিজ্ঞানের বদৌলতে সেই কৃষিতে মানুষ এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মানুষ
আবিষ্কার করেছে ট্রাক্টরসহ নানা রকম কৃষি সরঞ্জাম। আগে যেখানে নদী থেকে পানি তুলে সেচ
দিতে হত, এখন তার পরিবর্তে মানুষ পাম্প ব্যবহার করে ভূঅভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন করে
সেচ কাজ সম্পন্ন করছে। কীটনাশকের সাহায্যে পোকামাকড় ও পঙ্গপালের হাত থেকে ফসল রক্ষা
করছে। বর্তমানে ক্লোনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা উন্নত জাতের অধিক উৎপাদনশীল
বীজ তৈরি করেছেন। এর ফলে মরুভূমির মতো উষর জায়গায় কৃষিকাজ সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া সর্বাধুনিক
প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনাবৃষ্টির অঞ্চলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এভাবে
খাদ্য উৎপাদনে বিজ্ঞান বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।
যাতায়াত ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
বিজ্ঞান আর দূর-দূরান্তরকে করেছে নিকট। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আবিষ্কার করেছে দ্রুতগামী
যানবাহন, বুলেট ট্রেন, শব্দাতিগ উড়োজাহাজ। আজ মানুষ পৃথিবীর একপ্রান্তে বসে অপর প্রান্তের
মানুষের সাথে টেলিফোনে কথা বলতে পারে। টেলিভিশন, ফ্যাক্স, রেডিও, ই-মেইল ইত্যাদির মাধ্যমে
সারা বিশ্বের খবর যে-কোনো মুহূর্তে পেয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, রকেটে করে পৃথিবীর
বাইরে মহাকাশে পাড়ি জমাতে প্রস্তুত এখন মানুষ। পৃথিবীর বাইরের কৃত্রিম উপগ্রহগুলো হল
বর্তমানের সর্বাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন নামক এই প্রক্রিয়ার
দ্বারা স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের খবরাখবর, তথ্য ও ছবি সংগ্রহ
করা যায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আলোক তন্তু নিয়ে এসেছে নতুন প্রযুক্তি। এর ফলে টেলিফোনে
কথা বলার পাশাপাশি পরস্পরের ছবি দেখা যাচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেন করা যাচ্ছে
কম্পিউটারের তথ্যাবলি। এভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয়
এনে দিয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: চিকিৎসা
ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাফল্যগুলোও কম বিস্ময়কর নয়। জন্মপূর্ব রোগ নির্ণয়ে সাফল্যের ক্ষেত্রে
বড় রকমের উত্তরণ ঘটেছে। জিন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা প্রয়োগিক ক্ষেত্রে এক বিশাল সম্ভাবনা
হাজির করেছে। কর্নিয়া (অক্ষিগোলকের স্বচ্ছ আবরণ), বৃক্ক, অস্থিমজ্জা, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস
এবং যকৃতের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সাফল্য অভাবনীয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফাইবার অপটিকস্ (আলোক তন্তু বিদ্যা) ব্যবহারের ফলে মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ
ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, উদর, অস্থিগ্রস্থি, শিরা, ধমনী ইত্যাদির
অবস্থা যন্ত্রের সাহায্যে অবলোকন করে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়। শুধু তাই নয়,
অপটিক ফাইবার (আলোক তন্তু) সংবলিত বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্যে
নমুনা সংগ্রহ করা যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুসামগ্রী ও ছোট ছোট টিউমার অপসারণ করা যায়।
অতিকম্পনশীল শব্দ ও লেজারকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছে।
এর ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের অবস্থা দেখা যেমন সম্ভব হচ্ছে তেমনি মূত্রথলি ও পিত্তকোষের
পাথর চূর্ণ করার কাজেও এর সফল ব্যবহার হচ্ছে। বহুমূত্র রোগীর অন্ধত্ব প্রতিরোধে ব্যবহৃত
হচ্ছে লেজার রশ্মি। এই রশ্মি কোষকলা ছেদনে ও রক্তবাহী নালিকার ভেতরে জমে ওঠা প্রলেপ
অপসারণেও সাহায্য করছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছে সর্বাধুনিক
পর্যায়ে। এর মাধ্যমে ছবি তুলে রোগ নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: শিক্ষা ক্ষেত্রেও
বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর প্রায় সবই বিজ্ঞানের উদ্ভাবন।
বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষা-ব্যবস্থাকে করেছে আরও আধুনিক ও উন্নত। এখন বিভিন্ন শিক্ষামূলক
অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশন শিক্ষার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কম্পিউটার
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করেছে এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতি। বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম
ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা এখন কম্পিউটারেই শিখতে পারছে অসংখ্যা জিনিস। তাছাড়া ইন্টারনেট
ব্যবহার করে বিভিন্ন বিখ্যাত লাইব্রেরির বই পাঠ করা যায় এবং প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন বিদেশী
শিক্ষকের কাছ থেকে পড়ালেখা সম্পর্কে পরামর্শও গ্রহণ করা যায়।
আবহাওয়ায় বিজ্ঞান: মানুষের জীবনযাত্রার
প্রায় সব কাজই নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। আর এই আবহাওয়ায় খবরাখবর বের করতে গিয়ে বিজ্ঞান
তার প্রচণ্ড ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বৈজ্ঞানিকরা মহাকাশে এমন কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ
করেছেন যেগুলো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে প্রতিদিনই তৈরি করছে পৃথিবীর মানচিত্র।
৭/৮ দিন আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে আসন্ন ঘূণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে
জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা এখন সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। তাছাড়াও কৃত্রিম উপগ্রহের
মাধ্যমে খনিজ সম্পদ, তেল ও গ্যাসের উৎস, মাটির উপাদান ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে।
জানা যাচ্ছে পঙ্গপালের আক্রমণের আশঙ্কা সম্পর্কে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে ব্যবহার
করে কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। যেমন, মানুষ এখন কৃত্রিম বৃষ্টি নামাতে
পারে, রঙ্গিন ধোঁয়া দিয়ে আকাশের গায়ে রংধনুও সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া বাঁধ দিয়ে মানুষ
এখন বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থামিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে। এমন দিন দূরে নয় যেদিন মানুষ আবহাওয়ার
ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে। আর তা কেবলই সম্ভব হতে পারে বিজ্ঞানের বদৌলতে।
অবিজ্ঞান আশীর্বাদ না ভিশাপ: বিজ্ঞান
মানব সভ্যতার উন্নতির সর্ববৃহৎ হাতিয়ার। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানব জীবন হয়েছে সহজ ও স্বচ্ছল।
কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান শুধুমাত্র মানুষের উপকারই করে নি। স্বয়ংক্রিয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্র
মানুষের কাজ সম্পাদন করতে শুরু করার পরপরই অসংখ্য মানুষ বেকারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে
বিশ্বের এক বিশাল জনসমষ্টির রুজি-রোজগারের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রসম্বলিত
বড় বড় শিল্প- কারখানা ও মোটরচালিত গাড়িগুলো নষ্ট করছে পরিবেশ। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত
বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ অনেক সময় পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি করছে। অ্যারোসল স্প্রে,
ফ্রিজ ইত্যাদি হতে নির্গত পদার্থ পৃথিবীর ওজন স্তরকে ফুটো করে দিচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর
উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে ও মেরুদ্বয়ের বরফ গলা শুরু হয়েছে। তবে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভয়াবহতা
পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ করেছিল প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। এ সময়
মানুষ বিজ্ঞানের অপব্যবহার দেখে চমকে উঠেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার
করে অসংখ্য শহর-বন্দর ধ্বংস কর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যত যাই হোক, বিজ্ঞানের অবদানকে
মানুষ কখনই অস্বীকার করতে পারবে না। বরং বিজ্ঞানের অপব্যবহার রোধে সচেষ্ট হলে তা মানব
জীবনে আরও ফলপ্রসূ প্রভাব বিস্তারের সক্ষম হবে।
উপসংহার: “বিজ্ঞান যেন এ যুগের তিলোত্তমা
স্বরূপিনী যার এক হাতে আছে অমৃত ভাণ্ডার কিন্তু তার নয়ন কটাক্ষে প্রলয় ঘটে যায়।” মানুষের
জীবনে তাই বিজ্ঞানের সার্থক ও ইতিবাচক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। বিজ্ঞানের আলোকে মানবজীবন
আলোকিত করতে হবে। বিজ্ঞানের অপব্যবহার রোধে সকল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানের
জয়যাত্রাকে সঠিক পথে পরিচালনার মাধ্যমেই মানব