চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Monday, July 27, 2020

সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।
  জানি নে তোর ধন-রতন আছে কিনা রাণীর মতন
  শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।
 কোন বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
 কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
 আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে।

সারমর্ম: মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে সেই দেশ তার সবচেয়ে প্রিয়। স্বদেশের মতো মহান ও প্রীতিময় স্থান জগতে বিরল।এখানে সকল কিছুর মধ্যেই সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। মাতৃভূমির মতো এমন আপন অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। তাই এদেশের বুকে মৃত্যুবরণ করাটাও গৌরবের।

  ছোট ছোট বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল,
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্তে নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
গড়ে যুগ যুগান্তর-অনন্ত মহান।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি, ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপ পথে, ঘটায় প্রমাদ।
প্রতি করুণার দান, স্নেহ পূর্ণ বাণী,
এ ধরার স্বর্গসুখ নিত্য দেয় আনি।

সারমর্ম: ক্ষুদ্র বস্তুর সমষ্টি থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সাধিত হয় বৃহৎকর্ম। আবার ছোট ছোট অপরাধ মিলে বড় অপরাধ তৈরি হয়। সামান্য স্নেহ-করুণা। আর ভালোবাসা থেকে স্বর্গ সুখের জন্ম হয়। তাই সমান্য কোনো কিছুকেই তুচ্ছজ্ঞান করা উচিত নয়।
 বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
   বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
  দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
 দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
  দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
    ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
  একটি ধানের শীষের উপরে
 একটি শিশির বিন্দু।

সারমর্ম: মানুষ বহু অর্থ ও সময় ব্যয় করে দূরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যায়। কিন্তু ঘরের কাছের সৌন্দর্যটুকু আর দেখা হয়ে ওঠে না। সৌন্দর্যের বিচিত্র সমারোহ মানুষের চারপাশে বিদ্যমান। তাই দূরে যাওয়ার আগে কাছের জিনিসও সবাইকে চিনতে জানতে হবে।
  
 বসুমতি, কেন তুমি তই কৃপণা?
 কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
  দিতে যদি হয় দে মা প্রসন্ন সহাস
     কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
     বিনা চাষে শস্য দিলে কি তাহাতে ক্ষতি?
  শুনিয়া ঈষৎ হাসি কহে বসুমতি
  আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে,
  তোমার গৌরব তাতে একেবারে ছাড়ে।

সারমর্ম: শ্রমলব্ধ সম্পদে গৌরব আছে, আছে আনন্দ আর শ্রমহীন প্রাপ্তিতে থাকে দুর্বলতা, থাকে অবসাদ। তাই সকলেরই উচিত পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা। কারণ, পরের দান গ্রহণে কোনো আত্মতৃপ্তি নেই, শ্রমেই সত্যিকারের গৌরব।

   অধ্যবসায়

ভূমিকা:
‘কেন পান্থ ক্ষান্ত হও, হেরি দীর্ঘ পথ
উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?’
                                                                       - কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

সময়ের সাথে জীবন, জীবনের সাথে কর্ম ও অধ্যবসায়- একই বিনিসুতোর মালায় গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না। এ পৃথিবীতে যে-কোনো কাজ করতে গেলেই সফলতা ও নিষ্ফলতা উভয় প্রকার ঘটনাই ঘটে থাকে। অধ্যবসয় সফলতার চাবিকাঠি। অধ্যবসায় ছাড়া মানবজীবনে উন্নতির আশা কল্পনা মাত্র।

অধ্যবসায় কী ও বৈশিষ্ট্য: মানুষ জীবনকে সাজাতে চায়, সফল করতে চায় কিন্তু জীবনের পথ খুব সহজ নয়। জীবনের সব কাজই সহজে সমাধা হয় না। অনেক কাজেই প্রথমবারে সফলতা আসে না। এমনকী পরের বারও তার সফলতা নাও আসতে পারে। কিন্তু এতে হতাশ হলে চলবে না। বার বার চেষ্টা করতে হয়। তাতে এক সময় না একসময় সাফল্য আসবে। সাফল্য লাভের এই প্রয়াসই অধ্যবসায়। এই ধারণাকে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রবাদতুল্য একটি কবিতায়:

‘পারিব না, পারিব না এ কথাটি বলিও না আর,
পারো কি না পারো করো যতন আবার।
একবার না পারিলে দেখ শতবার।’

কোনো কাজে সফলতা অর্জন করতে হলে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা করার নামই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় হচ্ছে কতিপয় গুণের সমষ্টি। চেষ্টা, উদ্যোগ, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, ধৈর্য ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে অধ্যবসায় পরিপূর্ণতা লাভ করে। মনের আস্থা ও বিশ্বাসকে বাস্তব রূপদানের জন্যে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্যের মধ্য দিয়ে ঈস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্যেই অধ্যবসায়ের সার্থকতা নিহিত। প্রসঙ্গত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার বলেছেন-

‘কেন পান্থ ক্ষান্ত হও, হেরি দীর্ঘ পথ
উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?’

অধ্যবসায়ের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা: মানবসভ্যতার মূলে রয়েছে অধ্যবসায়ের এক বিরাট মহিমা। মানবজীবনের যে-কোনো কাজে বাধা আসতে পারে, কিন্তু সে-বাধাকে ভয় করলে চলবে না, কেননা ‘জীবনের সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার অর্থ হচ্ছে, জীবনকে অস্বীকার করা’ (-জন লিলি)। রাতের আঁধার পেরিয়ে যেমন দিনের আলো এসে দেখা দেয়, ঠিক তেমনি বার বার অবিরাম চেষ্টার ফলেই মানুষের ভাগ্যাকাশে উদিত হয় সাফল্যের শুকতারা। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড় হয়, অসাধ্য সাধন করতে পারে। সকল ধর্মগ্রন্থে অধ্যবসায়কে একটি চারিত্রিক গুণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশ্বাস, মেধা, সুযোগ কোনো কিছুই চূড়ান্ত সার্থকতা এনে দিতে পারে না যদি না তাদের যথার্থ প্রয়োগে অধ্যবসায়কেই মুখ্য করে তোলা হয়। একমাত্র অধ্যবসায়ী ব্যক্তির পক্ষেই এসব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভবপর। নিজেকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে এবং দেশ, জাতি ও বৃহত্তর মানবসমাজের জন্যে তাকে কিছু-না-কিছু অবদান রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। যে অধ্যবসায়ী নয় মনের দিক থেকে সে পঙ্গু। ফলে সমাজে তার দ্বারা কোনো মহৎ কাজ সম্ভব নয়। বস্তুত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিরাশা বা ব্যর্থতাকে জয় করার প্রধান উপায় হচ্ছে অধ্যবসায়- “Failure is the pillar of success”

অধ্যবসায়ের উদাহরণ: জগতে যত বড় শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সেনানায়ক, ধর্মপ্রবর্তক রয়েছেন, তাঁদের সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ী। ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে তার দৃষ্টান্ত। মহাকবি ফেরদৌসি দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে রচনা করেছিলেন অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দশ বিশ বছরের একক প্রচেষ্টায় রচনা করেন পঞ্চাশ হাজারের বেশি শব্দ সংবলিত বাঙলা ভাষার অভিধান। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নিজের চেষ্টা ও সাধনায় দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে সংগ্রহ করেছিলেন দু’হাজার প্রাচীন পুঁথি, যার ফলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় চার’শ বছরের ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উদ্ঘাটিত হয়। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বেরোয় জনসনের বিখ্যাত অভিধান ‘এ ডিকশনারি অফ দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ’ যাকে ইংরেজ জাতি গ্রহণ করে এক মহৎ কীর্তিরূপে : ফরাসিরা যা সম্পন্ন করেছে একাডেমির সাহায্যে ইংরেজ তা করেছে এক ব্যক্তির শ্রমে-মেধায়, এ-তৃপ্তি পাওয়ার সাথে সাথে ভাষার মানরূপ শনাক্তির জন্যে একাডেমি প্রতিষ্ঠার সমস্ত স্বপ্ন ত্যাগ করে ইংরেজ। মনীষী কার্লাইল অনেক বছরের শ্রমে ফরাসি বিপ্লবের এক অসামান্য ইতিহাস লিখেছিলেন। এ-সবই অধ্যবসায়ের ফসল। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস অধ্যবসায়ের আর এক জীবন্ত উদাহরণ। অগণিত ইংরেজ সৈন্যের সাথে পুনঃপুন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েও রবার্ট ব্রুস ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করার বাসনা ও চেষ্টা পরিত্যাগ করেন নি। বরং একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের ফলে তিনি যুদ্ধে জয়ী হন। এমনিভাবে স্যার ওয়াল্টর স্কট প্রমুখ ব্যক্তিগণও বার বার ব্যর্থ হয়েও অধ্যবসায়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন নিজেই স্বীকার করেছেন বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের মূলে আছে বহু বছরের একনিষ্ঠ ও নিরবচ্ছিন্ন শ্রম। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, “Impossible is a word, which is only found in the dictionary of fools.”

অধ্যবসায়ীর জীবনাদর্শ: জীবনসংগ্রামে সাফল্য লাভের মূলমন্ত্র হচ্ছে অধ্যবসায়। অর্ধ পৃথিবীর অধীশ্বর নেপোলিয়ন তাঁর জীবনকর্মের মধ্য দিয়ে রেখে গেছেন অধ্যবসায়ের অপূর্ব নিদর্শন। কোনো কাজকে তিনি অসম্ভব বলে মনে করতেন না। তাই তিনি একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ফরাসি জাতির ভাগ্যবিধাতা হতে পেরেছিলেন। শুধু অধ্যবসায়ের বলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ মনীষীগণ বিশ্বখ্যাত হয়েছেন।

পক্ষান্তরে, অধ্যবসায়ের অভবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবনও অকালে ঝরে যায়। অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি জগতের কোনো কাজেই সফলতা লাভ করতে পারে না। তার জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অধ্যবসায়ীকে কখনোই অসহিষ্ণু হলে চলবে না। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতাকে অর্জন করা যেমন সম্ভব তেমনি যোগ্যতার বলে অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যাওয়াও বিচিত্র নয়। এক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে নিজের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা। তাই অধ্যবসায়ী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কবি বলেছেন-

‘ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো! বাঁধো বাঁধো বুক,
শত দিকে শত দুঃখ আসুক আসুক।’

ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব: বিধাতা প্রত্যেক মানুষকেই প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিভাকে বিকশিত করার বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। মানবজীবনের এই সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে হলে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। অনেকের ধারণা- অসাধারণ প্রতিভা ছাড়া কোনো বড় কাজে সফলতা সম্ভব নয়। কিন্তু অসাধারণ প্রতিভা ছাড়াও নিরলস পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা যে কোনো কাজে জয়যুক্ত হওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক নিউটন বলেছেন-
‘আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে দুরূহ তত্ত্বগুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি।’

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন-
‘প্রতিভা বলে কিছুই নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে’।

ডালটন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,
‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না’

তাই প্রতিভা লাভ করতে হলে অধ্যবসায়ী হওয়া প্রয়োজন, এবং প্রতিভাকে অধ্যবসায়ের গুণে কাজে লাগাতে হবে, অন্যথায় সে-প্রতিভা কোনো কাজে আসবে না।

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব: ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সর্বাধিক। ছাত্রজীবন আর অধ্যবসায় মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। বিদ্যার্জনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অলস, কর্মবিমুখ ও হতাশ ছাত্র-ছাত্রী কখনও বিদ্যালাভে সফলতা অর্জন করতে পারে না। একজন অধ্যবসায়ী ছাত্র বা ছাত্রী অল্প মেধাসম্পন্ন হলেও তার পক্ষে সাফল্য অর্জন করা কঠিন নয়। কাজেই অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রীকে হতাশ না হয়ে পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে অধ্যবসায়ে মনোনিবেশ করা উচিত। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন,

‘কোন কাজ ধরে যে উত্তম সেই জন
হউক সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন।’

শুধু অধ্যবসায়ই পারে ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিয়ে সাফল্যের পথ দেখাতে।

জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব: মানুষ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দূর করেছে আঁধার, বিমান আবিষ্কার করে জয় করেছে আকাশ, রকেটের সাহায্যে অর্জন করছে চন্দ্র বিজয়ের গৌরব। আর এসব সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে মানুষের যুগ যুগান্তরের সাধনা, তাঁর অবিরাম অধ্যবসায়। বর্তমান সভ্যতার যুগে মানুষ নিজ নিজ কৃষ্টি ও সভ্যতা অর্জন করতে চায়, পৌঁছতে চায় সভ্যতার চরম শিখরে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় তা সহজে হয়ে ওঠে না। কোনো সভ্যতাই একদিনে গড়ে ওঠে নি। বার বার চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সৃষ্টির প্রথম মানবগোষ্ঠীর সভ্যতাও স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। বস্তুত সামগ্রিকভাবে একটি জাতির সগৌরবে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সকল নাগরিককেরই অধ্যবসায়ী হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর বুকে তখনই মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে সগৌরবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব যখন জাতীয় উন্নয়নে দল মত নির্বিশেষে সবাই সর্বশক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করবে। তাই জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

অধ্যবসায় ও উন্নত বিশ্ব: উন্নত বিশ্ব আজ অধ্যবসায়ের বলে সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছেছে। জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, কানাডা কেবলমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই উন্নতির শীর্ষস্থান করছে।

অধ্যবসায় ও বাঙালি জাতি: আমরা বাঙালি জাতি। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, আমাদের অনেকের মধ্যে অধ্যবসায়ের মহৎ গুণটি অনুপস্থিত। আমাদের মধ্যে নেই কোনো প্রচেষ্টা, নেই কোনো উদ্যম, কোনো আগ্রহ। বরং আছে আস্ফালন, হুঙ্কার, গরিমা ও নিজেকে প্রকাশ করার মিথ্যে বাহাদুরী। কেবলমাত্র অধ্যবসায়ের অভাবে আজ আমরা এত পিছিয়ে আছি। জাতি হিসেবে আমরা তাই অনুন্নত। সতরাং আর একটি মুহূর্তও বিলম্ব না করে নিজেদেরকে অধ্যবসায়ী রূপে গড়ে তোলা খুবই জরুরি।

উপসংহার:
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’
-অধ্যবসায় সম্পর্কিত একটি পরম সত্য প্রবাদ। যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ী নয়, সে জীবনের কোনো সাধারণ কাজেও সফলতা লাভ করতে পারে না। জীবনের সফলতা এবং বিফলতা অধ্যবসায়ের ওপরই নির্ভর করে, তাই আমাদের সকলের উচিত অধ্যবসায়ের মতো মহৎ গুণটিকে আয়ত্ত করা, পরশপাথরের মতো এই পাথরটিকে ছুঁয়ে দেখা এবং সোনার কাঠির মতো একে অর্জন করা। মনে রাখতে হবে অধ্যবসায়ই জীবন, জীবনই অধ্যবসায়।
       মানব কল্যাণে বিজ্ঞান

ভূমিকা: বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের অব্যাহত জয়যাত্রার এক যুগান্তকারী যুগ। একদা গুহাবাসী, অরণ্যচারী মানুষ বিজ্ঞানের বদৌলতে আজ ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় বেগ, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে করেছে দ্রুততর ও বহুমাত্রিক। ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর-দূরান্তরের ব্যবধান। মানুষকে দিয়েছে অনিঃশেষ সম্ভাবনার অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা।

বিজ্ঞানের উদ্ভব: বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান। অতি প্রাচীনকালে মানুষের বিশেষ কৌতূহলের চেতনায় বিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রাকৃতিক নানা বিষয় সম্পর্কে অন্বেষু দৃষ্টি মানুষের মনে বিজ্ঞানের প্রেরণা সঞ্চারিত করেছে। আর এই প্রেরণাই মানুষকে পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে এবং বিজ্ঞানকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

মানব সভ্যতায় বিজ্ঞান: প্রাচীন কালে, বিজ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতের এক অসহায় ক্রীড়নক। গুহাবাসী সেই পশুসদৃশ মানুষ যখন প্রথম পাথর ঘষে আগুন জ্বালায় তখন থেকেই শুরু হয় মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তারপর সেখানেই বাধার সম্মুখীন হয়েছে, কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে, মানুষ ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেছে। বিজ্ঞানই মানুষকে গুহাবাসী অবস্থা থেকে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত করেছে।

বিজ্ঞানীর আত্মত্যাগ: বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানব সভ্যতাও অগ্রগতির দিকে এগিয়েছে। অতীতের সাথে বর্তমান পৃথিবীর তুলনা করলে এ সম্পর্কে কোনো সংশয় থাকে না। কিন্তু এই উন্নতির পেছনে অসংখ্য বিজ্ঞানীর অবদান সম্পর্কে চিন্তা করলে আপনা থেকেই আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। সত্য কথা বলেছিলেন বলে ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, ল্যাভয়সিয়েকে হত্যা করা হয়েছিল গিলোটিনে। মহান বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস, কোপর্নিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ অসংখ্য বিজ্ঞানী তাঁদের সমগ্র জীবন বিজ্ঞানের পিছনে ব্যয় করেছেন। তাঁদের অক্লান্ত সাধনার পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমানে মানুষ এক অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে উন্নীত হয়ে সক্ষম হয়েছে।

মানব জীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান: বর্তমান যুগে, মানব জীবনের বিভিন্ন শাখায় বিজ্ঞানের বহুবিধ অবদান পরিলক্ষিত হচ্ছে। যাতায়াত, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ মানব জীবনের বহুক্ষেত্রে বিজ্ঞান এক বিশাল ভূমিকা রাখছে। বিজ্ঞানকে এখন বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এর ফলে বিজ্ঞানকে মানব জীবনের বহুক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।

কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: মানব সভ্যতার সূচনা লগ্নে মানুষ তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উর্বর জমিতে কৃষিকাজের উপায় উদ্ভাবন করে। বিজ্ঞানের বদৌলতে সেই কৃষিতে মানুষ এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মানুষ আবিষ্কার করেছে ট্রাক্টরসহ নানা রকম কৃষি সরঞ্জাম। আগে যেখানে নদী থেকে পানি তুলে সেচ দিতে হত, এখন তার পরিবর্তে মানুষ পাম্প ব্যবহার করে ভূঅভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন করে সেচ কাজ সম্পন্ন করছে। কীটনাশকের সাহায্যে পোকামাকড় ও পঙ্গপালের হাত থেকে ফসল রক্ষা করছে। বর্তমানে ক্লোনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা উন্নত জাতের অধিক উৎপাদনশীল বীজ তৈরি করেছেন। এর ফলে মরুভূমির মতো উষর জায়গায় কৃষিকাজ সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনাবৃষ্টির অঞ্চলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এভাবে খাদ্য উৎপাদনে বিজ্ঞান বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।

যাতায়াত ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: বিজ্ঞান আর দূর-দূরান্তরকে করেছে নিকট। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আবিষ্কার করেছে দ্রুতগামী যানবাহন, বুলেট ট্রেন, শব্দাতিগ উড়োজাহাজ। আজ মানুষ পৃথিবীর একপ্রান্তে বসে অপর প্রান্তের মানুষের সাথে টেলিফোনে কথা বলতে পারে। টেলিভিশন, ফ্যাক্স, রেডিও, ই-মেইল ইত্যাদির মাধ্যমে সারা বিশ্বের খবর যে-কোনো মুহূর্তে পেয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, রকেটে করে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে পাড়ি জমাতে প্রস্তুত এখন মানুষ। পৃথিবীর বাইরের কৃত্রিম উপগ্রহগুলো হল বর্তমানের সর্বাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন নামক এই প্রক্রিয়ার দ্বারা স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের খবরাখবর, তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করা যায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আলোক তন্তু নিয়ে এসেছে নতুন প্রযুক্তি। এর ফলে টেলিফোনে কথা বলার পাশাপাশি পরস্পরের ছবি দেখা যাচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেন করা যাচ্ছে কম্পিউটারের তথ্যাবলি। এভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাফল্যগুলোও কম বিস্ময়কর নয়। জন্মপূর্ব রোগ নির্ণয়ে সাফল্যের ক্ষেত্রে বড় রকমের উত্তরণ ঘটেছে। জিন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা প্রয়োগিক ক্ষেত্রে এক বিশাল সম্ভাবনা হাজির করেছে। কর্নিয়া (অক্ষিগোলকের স্বচ্ছ আবরণ), বৃক্ক, অস্থিমজ্জা, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস এবং যকৃতের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সাফল্য অভাবনীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফাইবার অপটিকস্ (আলোক তন্তু বিদ্যা) ব্যবহারের ফলে মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, উদর, অস্থিগ্রস্থি, শিরা, ধমনী ইত্যাদির অবস্থা যন্ত্রের সাহায্যে অবলোকন করে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়। শুধু তাই নয়, অপটিক ফাইবার (আলোক তন্তু) সংবলিত বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্যে নমুনা সংগ্রহ করা যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুসামগ্রী ও ছোট ছোট টিউমার অপসারণ করা যায়। অতিকম্পনশীল শব্দ ও লেজারকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছে। এর ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের অবস্থা দেখা যেমন সম্ভব হচ্ছে তেমনি মূত্রথলি ও পিত্তকোষের পাথর চূর্ণ করার কাজেও এর সফল ব্যবহার হচ্ছে। বহুমূত্র রোগীর অন্ধত্ব প্রতিরোধে ব্যবহৃত হচ্ছে লেজার রশ্মি। এই রশ্মি কোষকলা ছেদনে ও রক্তবাহী নালিকার ভেতরে জমে ওঠা প্রলেপ অপসারণেও সাহায্য করছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছে সর্বাধুনিক পর্যায়ে। এর মাধ্যমে ছবি তুলে রোগ নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: শিক্ষা ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর প্রায় সবই বিজ্ঞানের উদ্ভাবন। বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষা-ব্যবস্থাকে করেছে আরও আধুনিক ও উন্নত। এখন বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশন শিক্ষার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কম্পিউটার বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করেছে এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতি। বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা এখন কম্পিউটারেই শিখতে পারছে অসংখ্যা জিনিস। তাছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন বিখ্যাত লাইব্রেরির বই পাঠ করা যায় এবং প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন বিদেশী শিক্ষকের কাছ থেকে পড়ালেখা সম্পর্কে পরামর্শও গ্রহণ করা যায়।

আবহাওয়ায় বিজ্ঞান: মানুষের জীবনযাত্রার প্রায় সব কাজই নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। আর এই আবহাওয়ায় খবরাখবর বের করতে গিয়ে বিজ্ঞান তার প্রচণ্ড ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বৈজ্ঞানিকরা মহাকাশে এমন কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করেছেন যেগুলো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে প্রতিদিনই তৈরি করছে পৃথিবীর মানচিত্র। ৭/৮ দিন আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে আসন্ন ঘূণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা এখন সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। তাছাড়াও কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে খনিজ সম্পদ, তেল ও গ্যাসের উৎস, মাটির উপাদান ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে পঙ্গপালের আক্রমণের আশঙ্কা সম্পর্কে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। যেমন, মানুষ এখন কৃত্রিম বৃষ্টি নামাতে পারে, রঙ্গিন ধোঁয়া দিয়ে আকাশের গায়ে রংধনুও ‍সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া বাঁধ দিয়ে মানুষ এখন বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থামিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে। এমন দিন দূরে নয় যেদিন মানুষ আবহাওয়ার ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবে। আর তা কেবলই সম্ভব হতে পারে বিজ্ঞানের বদৌলতে।

বিজ্ঞান আশীর্বাদ না ভিশাপ: বিজ্ঞান মানব সভ্যতার উন্নতির সর্ববৃহৎ হাতিয়ার। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানব জীবন হয়েছে সহজ ও স্বচ্ছল। কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান শুধুমাত্র মানুষের উপকারই করে নি। স্বয়ংক্রিয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্র মানুষের কাজ সম্পাদন করতে শুরু করার পরপরই অসংখ্য মানুষ বেকারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে বিশ্বের এক বিশাল জনসমষ্টির রুজি-রোজগারের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রসম্বলিত বড় বড় শিল্প- কারখানা ও মোটরচালিত গাড়িগুলো নষ্ট করছে পরিবেশ। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ অনেক সময় পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি করছে। অ্যারোসল স্প্রে, ফ্রিজ ইত্যাদি হতে নির্গত পদার্থ পৃথিবীর ওজন স্তরকে ফুটো করে দিচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে ও মেরুদ্বয়ের বরফ গলা শুরু হয়েছে। তবে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভয়াবহতা পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ করেছিল প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। এ সময় মানুষ বিজ্ঞানের অপব্যবহার দেখে চমকে উঠেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে অসংখ্য শহর-বন্দর ধ্বংস কর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যত যাই হোক, বিজ্ঞানের অবদানকে মানুষ কখনই অস্বীকার করতে পারবে না। বরং বিজ্ঞানের অপব্যবহার রোধে সচেষ্ট হলে তা মানব জীবনে আরও ফলপ্রসূ প্রভাব বিস্তারের সক্ষম হবে।

উপসংহার: “বিজ্ঞান যেন এ যুগের তিলোত্তমা স্বরূপিনী যার এক হাতে আছে অমৃত ভাণ্ডার কিন্তু তার নয়ন কটাক্ষে প্রলয় ঘটে যায়।” মানুষের জীবনে তাই বিজ্ঞানের সার্থক ও ইতিবাচক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। বিজ্ঞানের আলোকে মানবজীবন আলোকিত করতে হবে। বিজ্ঞানের অপব্যবহার রোধে সকল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে সঠিক পথে পরিচালনার মাধ্যমেই মানব
 শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।

মুলভাব: শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না। শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ কুসংস্কার, জড়তা ও হীনমন্যতা থেকে মুক্ত হয়ে জাতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পারে।

সম্প্রসারিত ভাব: মেরুদণ্ডহীন মানুষ জড় পদার্থের মতো স্থবির, অচল। জীবন্মৃতের মতো সে এ সংসারে জীবনযাপন করে থাকে। তার দ্বারা সমাজ তথা দেশের কোনো মঙ্গল আশা করা যায় না। জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে সে তিলে তিলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এ পৃথিবী থেকে। তাই একজন মানুষকে সচল ও দণ্ডায়মান রাখতে যেমন মেরুদণ্ড প্রয়োজন, তদ্রুপ কোনো জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে মেরুদণ্ডসম শিক্ষার গুরুত্বও অপরিসীম। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি পৃথিবীকে তত প্রভাবিত করে। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে না। শিক্ষা-দীক্ষাহীন জাতি উন্নতির পথে পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই শিক্ষাকে মেরুদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন জগত-সংসারে অর্থব মূল্যহীন, তেমনই শিক্ষাহীন জাতি পৃথিবীতে ক্রমশ অস্তত্বহীন, অচল ও অসার হয়ে পড়ে। প্রায় এক যুগ আগে ফিলিপাইনের মিন্দানো দ্বীপে প্রাগৈতিহাসিক একটি জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের শিক্ষা বা সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। তাই প্রকৃতির খেয়ালের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায়, তারা প্রায় বিলুপ্ত হতে যাচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে তারা শিক্ষিত মানবসমাজের সংস্পর্শ পেয়ে অনিবার্য ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষা করার সুযোগ লাভ করেছে। ঐ মানবগোষ্ঠীটি যদি প্রগতিশীল বিশ্বের মানুষের সঙ্গে একই সময়ে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হতো তাহলে তারা বিলুপ্তির পথে ধাবিত হতো না। শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ নানা কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙে জাতিকে নিয়ে যেতে পারে উন্নতির চরম লক্ষ্যে। তাই শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ডরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মন্তব্য: শিক্ষাই জাতির আত্মপরিচয়ের বাহন। কোনো জাতিকে বিশ্বদরবারে উন্নত মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।

মূলভাব: স্বাধীনতা মানুষের আজন্ম সাধনার জিনিস। যা অর্জনেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না বরং এর মর্যাদা ও মাহাত্মাকে সমুন্নত রাখাই দুঃসাধ্য বিষয়।

সম্প্রসারিত ভাব: স্বাধীনতাহীনতায় কোনো ব্যক্তি বা জাতি বাঁচতে চায় না। স্বাধীনতাহীনতা বস্তুত জীবনহীনতারই সমতুল্য। কেননা মৃত ব্যক্তি যেমন অসাড়, তেমনি পরাধীন ব্যক্তির জীবনও অবরুদ্ধ, অসাড়। পরাধীনতা মানবতাকে খর্ব করে, মানুষের জীবনকে করে অপমানিত। পরাধীন মানুষ ও সমাজের আত্মবিকাশের সুযোগ নেই। নেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। অন্যের নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে মানুষের উচ্চবৃত্তি ও সুন্দর ভাবনাগুলোর অপমৃত্যু ঘটায়। ব্যক্তির মনোজাগতিক বিনাশ সমাজকেও করে অচলায়তন-বন্দি। সে জন্যই যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর পরাধীন জাতিগুলো স্বাধীনতা অর্জনের জন্য রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। একদা সারা বিশ্বই কয়েকটি ঔপনিবেশিক জাতির শাসনাধীনে বন্দি হয়ে পড়েছিল। তার থেকে মুক্ত পেতে বিশ্বকে কম রক্ত দিতে হয় নি। আমাদের দেশ দুদশ বছর ইংরেজ শাসনাধীনে এবং পঁচিশ বছর পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে ছিল। লাখ লাখ মানুষ এ পরাধীনতা-শৃঙ্খলমুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো পরাধীন জাতিই রক্তের বিনিময় ছাড়া স্বাধীনতার ছোঁয়া পায় নি। তবে প্রকৃত বিচারে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো একে রক্ষা করা। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের পুনর্গঠন, উন্নয়ন ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে একে রক্ষা করার জন্যে সদাপ্রস্তুত থাকা একান্ত প্রয়োজন। স্বাধীনতা লাভের পর পরাধীনতার মতো জীবনযাপন না করে বলিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে স্বাধীনতাকে অম্লান রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব। নতুবা ঈপ্সিত স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হবে। আপন কর্মপ্রেরণা, চিন্তাধারা ও শৃঙ্খলা বোধের দ্বারাই প্রমাণ করতে হবে কাঙ্ক্ষিত-স্বাধীনতার যৌক্তিকতা। আর মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের মূল উদ্দশ্য হচ্ছে স্বাধীনতাপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল জীবনের বিকাশ।

মন্তব্য: পরাধীন জাতি কঠিন ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম, সুদীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই স্বাধীনতার ব্যাপকতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে একে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য।

Sunday, July 26, 2020

   স্বদেশপ্রেম

(সংকেত: ভূমিকা; স্বদেশপ্রেম কী; স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ; স্বদেশ প্রেমের উৎস; স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ; দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ; স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম; সাহিত্যের আয়নায় স্বদেশপ্রেম; ছাত্রজীবনে স্বদেশপ্রেম; স্বদেশপ্রেমের প্রভাব; স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত; বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম; উগ্র দেশপ্রেম; উপসংহার।)

ভূমিকা: নিজ দেশ ও জন্মভূমির প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের প্রকৃতি ও ধূলিকণা আমাদের নিকট অতি প্রিয় ও পবিত্র। শিশুকাল থেকেই মানুষ স্বদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠে। মায়ের বুক যেমন সন্তানের নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়, স্বদেশের কোলে মানুষ তেমনি নিরাপদ ও নিশ্চিত আশ্রয় লাভ করে। স্বদেশকে ভালোবাসার মাঝেই মানব জীবনের চরম সার্থকতা নিহিত। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

“সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে।

সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।”

স্বদেশপ্রেম কী: স্বদেশপ্রেম মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে সেটিই তার জন্মভূমি। জন্মভূমির প্রতি, স্বজাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধই স্বদেশপ্রেম। দেশপ্রেমীর নিজ দেশের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, সীমাহীন আনুগত্য। বিশ্বের উন্নত জাতিগুলো স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। স্বদেশপ্রেম না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী দেশ গড়তে হলে তাই নাগরিকদের অবশ্যই স্বদেশপ্রেমী হতে হবে।

স্বদেশপ্রেমের উৎস: প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালোবাসে। সকল জীবের মধ্যেই এ গুণ বিদ্যমান। বন্যপশুকে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে আনলে, পাখিকে নীড়চ্যুত করলে তারা আর্তনাদ শুরু করে। এটি করে নিজ আবাসস্থানের প্রতি ভালোবাসার টানে। নিজ আবাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি, পানি, আলো, বাতাস যেন আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানির শামিল। এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সৃষ্টি হয় স্বদেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি মমত্ববোধের সাথে মিশে থাকে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও গৌরববোধের আকাঙ্ক্ষা।

স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ: মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সে বেড়ে উঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে পরিচয় লাভ করে। এ দেশই তার জন্মভূমি, তার স্বদেশ। মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত-পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায়। ফলে স্বদেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। কবি ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখেছেন-

“মিছা মনিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম

তার চেয়ে রত্ন নাই আর।”

স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ: স্বদেশপ্রেম মানব হৃদয়ে লালিত হয়। আর স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায়, স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জেগে ওঠে। যাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাদের নাম ও কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁদের সে প্রেম ও আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে চিরকাল। স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গকারীরা সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-

ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।

তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।

দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ: কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া যেমন শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখাও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গাইতে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষের একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমরই বহিঃপ্রকাশ। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে বিশ্বসভ্যতায় গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ড. মুহাম্মদ ইউনুস, সাকিব আল হাসান প্রমুখের গৌরবময় অবদানের জন্য বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই, দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন- “হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”

স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম: স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনও বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসাহিত হতে হবে। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ, ভাষা, গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই দেশপ্রেমের মধ্যেই বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটে।

সাহিত্যের আয়নায় দেশপ্রেম: বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা, কাব্য, নাটক, গান, উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ, আনন্দমঠ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।

ছাত্রজীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা: স্বদেশপ্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও এ গুণটি তাকে অর্জন করতে হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেমের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ছাত্রজীবনে যে দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তা মনে আজন্ম লালিত হয়। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশের ভালো-মন্দ তাদের উপর অর্পিত হবে। সবার আগে দেশের বিপদে-আপদে ও প্রয়োজনে ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসেত হবে। প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে ছাত্রদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। যেমনটি ছাত্ররা করেছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে।

স্বদেশপ্রেমের প্রভাব: স্বদেশেপ্রেমের মহৎ চেতনায় মানব চরিত্রের সৎ গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহৎ করে, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মসুখ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে, দেশবাসীকে ভালোবাসো।

স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত: যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী স্বদেশের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নাম না জানা লক্ষ লক্ষ শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন দিয়ে অমর হয়েছেন। বিশ্ব অঙ্গনে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রেখেছেন চীনের মাওসেতুং, রাশিয়ার লেলিন ও স্ট্যালিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন প্রমুখ ব্যক্তি। দেশেপ্রেমের জন্যেই তাদের সকলের নাম বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

র্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম: নগর কেন্দ্রীক সভ্যতায় মানুষ তার পাশের বাড়ির মানুষের কথাই ভুলে গেছে। মানুষ আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের মানুষের চিন্তা করার মানসিকতা তার নেই। মানুষের মধ্যে বাঁচার তাগিদ আজ আর কেউ অনুভব করে না। কেননা মানুষের মধ্যে বাঁচা মানে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঁচা। কিন্তু সবাই এখন নিজের জন্য বাঁচতে চায়। তাই দেশ ও জাতির জন্য আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

উগ্র দেশপ্রেম: দেশপ্রেম দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই উগ্র দেশপ্রেম সব সময় অশুভ, চির অকল্যাণকর ও চির অশান্তির।

উপসংহার: জন্মভূমি সকলেরই প্রিয়, তা রক্ষার দায়িত্বও সকলের। তবে মনে রাখতে হবে নিজের দেশকে রক্ষার নামে অপরকে আক্রমণ করা মানবতাবিরোধী। স্বদেশপ্রেমের মতো পবিত্র গুণ আর নেই। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের উচিত স্বদেশকে ভালোবাসা। প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষ সকলের কাছে পরম পূজনীয়। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকারী ব্যক্তিই বিশ্ববরেণ্য।
আমি কবি,সেই কবি
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক

আমি কবি, সেই কবি
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্‌মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!

স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা করে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা,
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়,-পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভরে!

ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন,- শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটরক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!

বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!
ছায়া-প্রিয়া
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক

দুপুররাতে ও কার আওয়াজ!
          গান কে গাহে,- গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
          নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
         এ কার তবে কান্না!
 গান কে গাহে,- গান না!

শার্শি ঘরের উঠছে বেজে,
         উঠছে কেঁপে পর্দা!
বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে
         জল-ডাহুরের বুকের কাছে;
এ কোন্‌ বাঁশি শার্শি বাজায়
         এ কোন হাওয়া ফর্দা
দেয় কাঁপিয়ে পর্দা!

নূপুর কাহার বাজল রে ঐ!
        কাঁকন কাহার কাঁদল!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
        দুধের শিশুর বুকের কাছে;
ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া
          মায়ার মিলন ফাঁদল!
কাঁকন যে তার কাঁদল!

খসখসাল শাড়ি কাহার!
           উস্‌খুসাল চুল গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
           দুধের শিশুর বুকের কাছে:
জুল্‌পি কাহার উঠল দুলে!
           -দুলল কাহার দুল গো!
উস্‌খুসাল চুল গো!
আজকে রাতে কে ঐ এল 
            কালের সাগর সাতরি !
জীবন-ভোরের সঙ্গিনী সেই,-
             মাঠে ঘাটে আজকে সে নেই !
কোন তিয়াশায় এল রে হায়
              মরণপারের যাত্রী !
-কালের সাগর সাতরি !

কাঁদছে পাখি পউষনিশির
              তেপান্তরের বক্ষে!
ওর বিধবা বুকের মাঝে
         যেন গো কার কাঁদন বাজে!
ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে,
         নিদ্‌ নাহি মোর চক্ষে!
তেপান্তরের বক্ষে!

এল আমার ছায়া-প্রিয়া,
         কিশোরবেলার সই গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
         দুধের শিশুর বুকের কাছে;
মনের মধু-মনোরমা,-
         কই গো সে মোর- কই গো!
কিশোরবেলার সই গো!

ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে!
         গান কে গাহে, গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
         বনের ছায়ায়,-মাঠের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
          এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে,-গান না!
সিন্ধু
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক

বুকে তব সুর-পরী বিরহ-বিধুর
          গেয়ে যায়, হে জলধি, মায়ার মুকুর!
কোন্‌ দূর আকাশের ময়ুর-নীলিমা
           তোমারে উতলা করে! বালুচর সীমা
উলঙ্ঘি তুলিছ তাই শিরোপা তোমার,-
           উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি,-তরঙ্গের বাঁকা তলোয়ার!
গলে মৃগতৃষ্ণাবিষ, মারীর আগল
           তোমার সুরার স্পর্শে আশেক-পাগল!
উদ্যত উর্মির বুকে অরূপের ছবি
            নিত্যকাল বহিছ হে মরমিয়া কবি
হে দুন্দুভি দুর্জয়ের, দুরন্ত, আগধ।
            পেয়েছি শক্তির তৃপ্তি, বিজয়ের স্বাদ
            তোমার উলঙ্গনীল তরঙ্গের গানে!
কালে কালে দেশে দেশে মানুষ-সন্তানে
            তুমি শিখায়েছ বন্দু দুর্মদ-দুরাশা!
আমাদের বুকে তুমি জাগালে পিপাসা
            দুশ্চর তটের লাগি-সুদূরের তরে।
রহস্যের মায়াসৌধ বক্ষের উপরে
          ধরেছ দুস্তর কাল;- তুচ্ছ অভিলাষ,
দুদিনের আশা, শানি, আকাঙক্ষা, উল্লাস,
পলকের দৈন্য-জ্বালা-জয়-পরাজয়,
          ত্রাস- ব্যথা হাসি-অশ্রু-তপস্যা সঞ্চয়,-
পিনাকশিখায় তব হল ছারখার।
           ইচ্ছার বাড়বকুন্ডে, উগ্র পিপাসার
           ধূ ধূ ধূ ধূ বেদীতটে আপনারে দিতেছ আহুতি।
মোর ক্ষুধা-দেবতারে তুমি কর স্তুতি!
          নিত্য নব বাসনার হলাহলে রাঙি
পারীয়ার প্রাণ লয়ে আছি মোরা জাগি
         বসুধার বাঞ্ছাকূপে, উঞ্ছের অঙ্গনে!
নিমেষের খেদ-হর্ষ-বিষাদের সনে
         বীভৎস খঞ্জের মতো করি মাতামাতি!
         চুরমার হয়ে যায় বেলোয়ারি বাতি!
ক্ষুরধার আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া চিতা
        গড়ি তবু বারবার-বারবার ধুতুরার তিতা
নিঃস্ব নীল ওষ্ঠ তুলি নিতেছি চুমিয়া!
        মোর বক্ষকপোতের কপোতিনী প্রিয়া
কোথা কবে উড়ে গেছে,-পড়ে আছে আহা
         নষ্ট নীড়,- ঝরা পাতা,- পূবালির হাহা!
কাঁদে বুকে মরা নদী,- শীতের কুয়াশা!
          ওহে সিন্ধু,‌ আসিয়াছি আমি সর্বনাশা
ভুখারি ভিখারি একা, আসন্ন-বিকাশ!
           -চাহি না পলার মালা, শুক্তির কলস,
মুক্তাতোরণের তট মীনকুমারীর,
চাহি না নিতল নীড় বারুণীরাণীর।
            মোর ক্ষুধা উগ্র আরো, অলঙ্ঘ্য অপার!
একদিন কুকুরের মতো হাহাকার
             তুলেছিনু ফোঁটা ফোঁটা রুধিরের লাগি!
একদিন মুখখানা উঠেছিল রাঙি
             ক্লেদবসাপিন্ড চুমি রিক্ত বাসনার!
মোরে ঘিরে কেঁদেছিল কুহেলি আঁধার,-
             শ্মশানফেরুর পাল,- শিশিরের নিশা,
             আলেয়ার ভিজা মাঠে ভুলেছিনু দিশা।
আমার হৃদয়পীঠে মোর ভগবান
             বেদনার পিরামিড পাহাড়প্রমাণ
গেঁথে গেছে গরলের পাত্র চুমুকিয়া;
রুদ্র তরবার তব উঠুক নাচিয়া
              উচ্ছিষ্টের কলেজায়, অশিব-স্বপনে,
হে জলধি, শব্দভেদী উগ্র আস্ফালনে!
-পূজাথালা হাতে লয়ে আসিয়াছে কত পান্থ, কত পথবালা
সহর্ষে সমুদ্রতীরে; বুকে যার বিষ-মাখা শায়কের জ্বালা
              সে শুধু এসেছে বন্ধু চুপে চুপে একা
             অন্ধকারে একবার দুজনার দেখা!
                     বৈশাখের বেলাতটে সমুদ্রের স্বর,-
              অনন্ত, অভঙ্গ, উষ্ণ, আনন্দসুন্দর!
                      তারপর, দূরপথে অভিযান বাহি
চলে যাব জীবনের জয়গান গাহি।