চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Tuesday, July 28, 2020

  কৃষিকাজে বিজ্ঞান

ভূমিকা: একটু পেছনে ফিরে তাকালে আজ চমকে উঠতে হয়- কত পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনযাত্রায়। এ পরিবর্তন একশ বছর আগে মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু আজ এটাই বাস্তব সত্য। আর এই সত্যের পেছনে অনন্য ও অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে বিজ্ঞান। আজকের বিশ্বে প্রতিটি মানুষকে বিজ্ঞান দান করেছে তার সর্বব্যাপী মহাশক্তি। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় বেগ, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে করেছে দ্রুততর। ঘুচিয়ে দিয়েছে দূর-দূরান্তের ব্যবধান। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ প্রকৃতিকে করেছে তার আজ্ঞাবাহী। আর এই বিজ্ঞানই আজ তার সুদূরপ্রসারী কল্যাণী হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষিক্ষেত্রে।

মানবজীবনে কৃষির গুরুত্ব: কৃষি মানুষের অস্তিত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। মানবজীবন ও মানবসমাজে এর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এটি মানুষের আদিমতম জীবিকার উপায়। দেশে দেশে কৃষিই সমাজের মেরুদণ্ড, কৃষিই সমাজের ভিত্তি। স্বভাবতই কৃষির ক্রমোন্নতিতেই সমাজের ও দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি।

কৃষির প্রাচীন প্রেক্ষাপট: আদিম সমাজে মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্যে নির্ভর করত বন্য পশু-পাখি, জীবজন্তু, ফলমূল ও মাছের উপর। একসময় মানুষ বীজ বপন ও ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে নিজের খাদ্য নিজেই যোগাতে শেখে। এভাবে মানব সভ্যতায় কৃষি ও কৃষকের আবির্ভাব ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় গরু, ঘোড়া, মোষ প্রভৃতি জন্তুর সাহায্যে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করা হত। কৃষকেরা ফসলের জন্যে সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিল আবহাওয়ার উপর। কখনও প্রচণ্ড খরায়, কখনও অতিবৃষ্টিতে ফসলহানি ঘটত । ফলে, কৃষকের ফসল পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাাঁড়িয়েছিল। আবার একই জমিতে বার বার একই ফসল উৎপাদনের ফলে জমির উর্বরতা কমে যেত। ফলে উৎপাদন হত কম। এছাড়া উন্নত বীজের অভাবে উৎপাদিত ফসলও ভাল হতো না। সুতরাং এক কথায় বলা যায়, কৃষির প্রাচীন প্রেক্ষাপট ছিল কৃষকদের হতাশার প্রতিচ্ছবি।

কৃষির আধনিকায়নে বিজ্ঞান: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির আধনিকায়নের সূচনা ঘটে। এর ফলে কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ও কৃষি পদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়। জন্তু আর কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে কৃষকদের হাতে আসে কলের লাঙল, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার। উন্নত দেশগুলোতে জমি কর্ষণের পুরনো পদ্ধতিগুলো লোপ পেয়েছে। সেচ ব্যবস্থাতেও বিজ্ঞান অনেক পরিবর্তন এনেছে। কৃষকদের এখন ফসলের জন্য প্রকৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেচের জন্যে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎ শক্তি চালিত পাম্প। অতিবৃষ্টিও আজ কৃষককে ভীত করছে না। বিজ্ঞানের বদৌলতে জমির অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন আজ অত্যন্ত সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষিক্ষেত্রে নতুন অকল্পনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছেন। উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে তাও অভাবনীয়। বিশেষ করে কৃত্রিম উপায়ে উচ্চফলনশীল বীজ উৎপাদনে সাফল্য বিস্ময়কর। এসব বীজ সাধারণ বীজের তুলনায় ফসল উৎপাদনে তুলনামূলকভাবে সময়ও কম নেয়। সুতরাং বীজ নিয়েও কৃষকদের অতীতের অনিশ্চয়তা দূর করেছে বিজ্ঞান। আর শক্তিশালী রাসায়নিক সার আবিষ্কৃত হওয়ায় ফসল উৎপাদনে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বৃষ্টিহীন শুষ্ক মরু অঞ্চলে চাষাবাদ শুরু করার প্রচেষ্টা চলছে বিজ্ঞানের সহায়তায়। সেদিন দূরে নয় যেদিন এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা সাফল্য অর্জন করবেন।

উন্নত বিশ্বের কৃষি: উন্নত দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিজ্ঞাননির্ভর। জমিতে বীজ বপন থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত সমস্ত কাজেই রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। বিভিন্ন ধরণের বৈজ্ঞানিক কৃষিযন্ত্র যেমন, মোয়ার (শস্য ছেদনকারী যন্ত্র), রপার (ফসল কাটার যন্ত্র), বাইন্ডার (ফসল বাঁধার যন্ত্র), থ্রেশিং মেসিন (মাড়াই যন্ত্র), ম্যানিউর স্প্রেডার (সার বিস্তারণ যন্ত্র) ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোর কৃষিক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক সাফল্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের খামারে একদিনে ১০০ একর পর্যন্ত জমি চাষ হচ্ছে কেবল এক একটি ট্রাক্টরের মাধ্যমে। সেগুলো আবার একসাথে তিন-চারটি ফসল কাটার যন্ত্রকে একত্রে কাজে লাগাতে সক্ষম। তারা কৃষিকাজে ব্যাপকভাবে অগ্রগামী। যেমন বলা যায় জাপানের কথা। জাপানে জমির উর্বরাশক্তি বাংলাদেশের তুলনায় এক চতুর্থাংশ। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে তারা এদেশের তুলনায় ৬ গুণ বেশি ফসল উৎপাদন করছে।

কৃষি ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। এদেশের মাটি ও জলবায়ু অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় কৃষির অনুকূলে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো যখন প্রতিকূল অবস্থা ঘুচিয়ে ফসল উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক নেশায় মেতেছে সেখানে বাংলাদেশের কৃষকেরা তার কাঠের লাঙল আর একজোড়া জীর্ণ বলদ নিয়ে চেয়ে আছে আকাশের পানে বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। একথা সত্যি যে বাংলাদেশেও কৃষি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সফলতাও এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের শতকরা আশিভাগ কৃষক এখনও সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে চলেছে। শিক্ষা, সচেতনতা, মূলধন, পুঁজি ইত্যাদির অভাবে তারা কৃষিকাজে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তারা শ্রম দিচ্ছে কিন্তু উপযুক্ত ফসল পাচ্ছে না। কেননা তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করতে পারছে না।

উপসংহার: বিজ্ঞান আজ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানের সাহায্যে পাহাড় কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিভিন্নভাবে কৃষি জমি তৈরি করা হচ্ছে। ফসল আবাদের প্রতিটি পদক্ষেপে তারা বিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ তারা কৃষিক্ষেত্রে লাভ করছে বিরাট সাফল্য। কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সুজলা-সফলা আমাদের এই দেশে বিজ্ঞানের জাদুর ছোঁয়া আমরা যত বেশি কাজে লাগাতে পারব ততই কৃষি আমাদের দেবে সোনালি ফসলসহ নান ফসলের সম্ভার। কৃষকদের সচেতনতা, সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের সাহায্য প্রদান এবং বাংলাদেশে কৃষি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাই পারে আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে- বাংলাদেশকে একটি সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যমলা দেশ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে।

 দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার

ভূমিকা: যন্ত্রপ্রকৌশল ও প্রযুক্তি-নির্ভর মানব সভ্যতার অগণিত আবিষ্কারের বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই বিষ শতকে যে মহাবিস্ময়কে মানুষ আলাদিনের চোগের মতো হাতের মুঠোয় পেয়েছে তার নাম কম্পিউটার। এ এক মহাপরাক্রমশালী অথচ অনুগত যন্ত্র যা মানুষের কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবলীলায় অক্ষরে অক্ষরে প্রতিটি হুকুম পালন করে। আজকের দিনে তাই মানবসব্যতা হয়ে পড়েছে কম্পিউটার-নির্ভর স্বয়ংক্রিয়তা-কেন্দ্রিক। এবং এর ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণশক্তি বেড়ে গিয়েছে বহু গুণ, বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা। অনেক সহজ হয়ে উঠেছে প্রশাসনিক কাজকর্ম ও হিসাব নিকাশের জটিলতা। অনাবশ্যক অনেক মানসিক শ্রমের হাত থেকেও রেহাই ফেয়েছে মানুষ।

কম্পিউটার কী?: আভিধানিক অর্থে কম্পিউটার হলো এক ধরনের গণক যন্ত্র। কিন্তু আজকাল কম্পিউটারকে কেবল গণনাকারী বলা চলে না। এখন তা এমন এক ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ধারণা দেয় যা অগণিত তথ্য বা উপাত্ত গ্রহণ করে অত্যন্ত দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ, গণনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে পারে। কম্পিউটার আসলে এক ধরনের যন্ত্র-মস্তিস্ক। মানুষ যেমন করে মগজে ধরে-রাখা স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, তথ্য ও তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করে, কম্পিউটারের কাজও তেমনি। কম্পিউটারকে তথ্য ও নির্দেশনা প্রদানের জণ্যে যে বিশেষ ভাষা ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় ‘প্রোগামিং ল্যাংগুয়েজ’, আর এসব কিছুকে একত্রে অভিহিত করা হয় ‘কম্পিউটার সফ্টওয়্যার’। এছাড়া কম্পিউটারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী একটা কাঠামো থাকে, তাকে বলে ‘হার্ডওয়্যার’। কম্পিউটারের বড় উপযোগিত হলো তথ্য ও প্রোগ্রাামের রদবদল বা সংযোজন ঘটিয়ে একই কম্পিউটাকে দিয়ে নানারকম কাজ করানো চলে। কম্পিউটার যে আজকের দিনে বিস্ময়কর ও বিশ্বস্তভাবে সবধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। সেগুলো হলো : এক. অত্যন্ত দ্রুত গণনার ক্ষমতা, দুই. বিপুল পরিমাণ উপাত্তকে সুসংবদ্ধভাবে যন্ত্র-মগজে ধরে রাখার ক্ষমতা, তিন. তথ্য বিশ্লেষণের নির্ভুল ক্ষমতা, চার. ’ডেটা’ ও প্রোগ্রাম’ অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা। মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি ক্রমেই পম্পিউটারের কার্যকারিতা ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করছে।

উদ্ভাবন ও ক্রমোন্নতি: প্রাচীনকাল থেকে যান্ত্রিক গণনা পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে বর্তমান কম্পিউটারের রূপ নিয়েছে। তবে আধুনিক কম্পিউটারের সূত্রপাত হয়েছে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের গণকযন্ত্র অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন থেকে । এরপর ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর যন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ঘটেছে বৈপ্লবিক অগ্রগতি। প্রথমদিকে নির্মিত পেনসেলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনিয়াক’ নামের কম্পিউটারের ওজন ছিল ত্রিশ টন, তার আয়তনও ছিল বিশাল। ৪০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া ঘরের সবগুলো দেয়াল জুড়ে ছিল এর যন্ত্রপাতি। আর এখন এর আকার নেমে এসেছে হাতব্যাগের আকারে।

সবকাজের কাজি: কম্পিউটার আধুনিক বিশ্বের এমন এক সবজান্তা বিস্ময়কর যন্ত্র যে সব কাজেই পারদর্শী। এমন কোনো কাজ নেই যা কম্পিউটার করছে না। মানুষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু ও সঙ্গী সে। কোটি কোটি সংখ্যার যে জটিল অঙ্ক কয়েকদিনে করে শেষ করা যায় না তা মুহূর্তেই নির্ভুলভাবে করে দিচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটার এখন কলকারখানার উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যাংক, বিমা, টেলিযোগাযোগ, রেল ও বিমান পরিবহন, ডাক ব্যবস্থা, গবেষণা, প্রতিষ্ঠান, তথ্যকেন্দ্র কোথায় কাজ করছে না কম্পিউটার? কম্পিউটার রোগ নিরূপণ করে দিচ্ছে। ব্যবসায়ের লাভ-লোকসানের হিসাব রাখছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও কম্পিউটার নিয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবই শেখাচ্ছে নিপুণ দক্ষতার সাথে। দাবা, ক্রিকেট, ফুটবলসহ নানারকমের ভিডিও গেম খেলছে কম্পিউটার। এসব খেলায় কম্পিউটার মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। খেলার তথা রেকর্ড করছে নপুণভাবে। কম্পিউটার এখন ছবি আঁকছে, পুরনো-ছবি পুনরুদ্ধার করছে, মানচিত্র তৈরি করছে। ভস্কর্য তৈরি করছে। ফিংগার প্রিন্ট ও ছবি বিশ্লেষণ করে অপরাধীকে খুঁজে বের করওে কম্পিউটার বাহবা কুড়াচ্ছে। মুদ্রণ জগতেও অনেক বিস্ময়ের জন্ম নিদয়েছে কম্পিউটার। ইন্টানেটের সাহায্যে ঘরে বসে মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোন জায়গায় যে-কোন-তথ্য আদন-প্রদানের সুযোগ এনে দিয়েছে কম্পিউটার। কম্পিউটার চালিত ‘স্ক্যারাব’ সমুদ্র তলদেশ থেকে খুঁজে এনেছে আটলান্টিক মহাসাগরের ভেঙে-পড়া বিমানের ’ব্ল্যা বক্স’, নভোযানে বসে নিয়ন্ত্রণ করছে তার গতিবিধি, সেখান থেকে তথ্য পাঠাচ্ছে পৃথিবীর বুকে। মানুষের অসাধ্য ও বিপদজ্জনক কাজেও কম্পিউটার নিয়ে আসছে অকল্পনীয় সাফল্য। কম্পিউটারের এই অসাধারণ সাফল্যই একুশ শতকে পর্দাপণ করা বিশ্বকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন করে সাজানোর।

বাংলাদেশে কম্পিউটার: ১৯৬৪ সালে আণবিক শক্তি কেন্দ্রে IBM 1620 সিরিজের একটি কম্পিউটার আনার মাধমে প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলাদেশে কম্পিউটারের পদচারণা শুরু হয়। কিন্তু আশির দশকের আগে এদেশে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় নি। নব্বইয়ের শুরু থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার শিক্ষা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কম্পিউটাররের দ্রুত ও ব্যাপক ব্যবহার ঘটছে। কম্পিউটার শিক্ষাও যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশে কম্পিউটার বিজ্ঞান অধ্যয়নের সুযোগ অবশ্য কখনও যথেষ্ট সীমিত। কেবল ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য শহরগুলোর শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ পায়। আবার যারা বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেছে তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক মানের সফ্টওয়্যার তৈরি করছে। তবে দুঃখের বিষয়, কম্পিউটার বিজ্ঞানে উন্নয়ন প্রশিক্ষণ লাভকারীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এটা আমাদের দেশে কম্পিউটার প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
কম্পিউটার ও বেকারত্ব : কম্পিউটার মানবশক্তির এক বিস্ময়কর বিকল্প। এর ক্ষমতা সাধারণ নজশক্তির চেয়ে বহুগুণ বলে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। কম্পিউটার মানুষের কাজ কেড়ে নিচ্ছে বলে ক্রমেই কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে ও বেকারত্ব বাড়ছে আমাদের মত জনবহুল দেশে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার বেকারত্বের আশঙ্কাকেই ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে।

কম্পিউটারজনিত অন্যান্য সমস্যা: কম্পিউটার ব্যবহার শারীরিক দিক ‍দিয়েও কিছুটা ক্ষতিকর এর থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয়তা কখনো কখনো শরীরের জন্যে ক্ষতিকর হয়। ভাইরাস আক্রমণ যান্ত্রিক ক্রটি ইত্যাদির ফলে অনেক সময়ে কম্পিউটার বিপর্যয় ঘটে। ফলে অনৈক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুহুর্তেই নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে প্রশাসন ও কর্মক্ষেত্রে বিরাট ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সাম্প্রতিককালে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণায় নানা যান্ত্রিক ক্রুটির ফলে বহু শিক্ষার্থী জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।

উপসংহার: কম্পিউটার আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে যেমন বিবেচিত হচ্ছে তেমনি এর ব্যাপক ব্যবহারে বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের আশঙ্কাও আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। এজন্যে কম্পিউটারের পরিকল্পিত, ভারসাম্যমূলক ব্যবহার ও দেশে কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়ন, দরকার। তা না হলে একুশ শতকের চলার গতির সঙ্গে আমরা যেমন তাল মিলিয়ে চলতে পারব না, তেমনি অতিরিক্ত গতি নিতে গিয়ে তাল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ব সংকটের আবর্তে। এক্ষেত্রে পরিণামদর্শী পদক্ষেপই হবে আমাদের অগ্রযাত্রার রক্ষাকবচ।

 কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা

ভূমিকা: শিক্ষা মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায়। জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তাকে সামর্থ্য ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফলে মানব জীবনের নিত্যনতুন কর্মদিগন্ত খুলে গেছে। ফলে বংশানুক্রমিক পেশাগত বৃত্তি অবলম্বন করে নিশ্চিত জীবনযাপনের দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং নিত্যনতুন যে কর্মদিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে তার সঙ্গে বিশেষায়িত শিক্ষার যোগ হয়ে পড়েছে অপরিহার্য। এই কারণে আধুনিক বিশ্বে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ক্রমের অধিকতর গুরুত্ব লাভ করছে।

সংজ্ঞা ও গুরুত্ব: কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের জন্যে সম্ভাব্য পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা। মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক পরিবর্তন এবং জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে কর্মমূখী শিক্ষার গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়ছে। এককালে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বাস করে বাংলাদেশের মানুষ সুখে জীবন কাটিয়েছে। বৃত্তি বা পেশাগত শিক্ষা নিয়ে তাকে ভাবতে হয় নি। বংশানুক্রমিক পেশা অবলম্বন করেই জীবিকা নির্বাহ করেছে। কিন্তু এখন সে দিন আর নেই। জনসংখ্যা এখন বেড়েছে বিপুলভাবে। তার প্রচন্ড চাপ পড়েছে সীমিত সম্পদের ওপর। ফলে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে নব নব কর্মসংস্থান ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর না হলে জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনিবার্য সংকট।

আর তার জন্যে দরকার নিত্যনতুন কর্ম, বৃত্তি ও পেশার সঙ্গে জড়িত কর্মমুখী শিক্ষা। কিন্তু দুঃখের বিষয় দেশে এখনও সেই ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে কেরানি তৈরির উপযোগী সাধারণ শিক্ষার প্রাধান্যই রয়ে গেছে। ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে যারা বের হচ্ছে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় তাদের ব্যাপক অংশেই বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রচন্ড হতাশায় জীবনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। এই কারণে যতই দিন যাচ্ছে কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করছে। বিশ শতকের শেষ দশকে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করা গেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, বর্তমান বাস্তবতায় কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তা দেশের অগ্রগতি সাধনে যেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি দেশে এবং দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব মোচনেও ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম। এতে বহু পরিবার অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে পারে। এই শিক্ষার প্রসার ঘটলে সাধারণ ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ভিড় হ্রাস পাবে। তাছাড়া কর্মমুখী শিক্ষা স্বকর্ম সংস্থানের নানা সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং তা ফলত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা কেবল নতুন নতুন কর্মস্থানের সুযোগ তৈরি করে না, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। সেদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষা জাতির অর্থনৈতিক বুনিয়াদ রচনায়ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা স্বাধীন পেশা গ্রহণে ব্যক্তির আস্থা গড়ে তোলে, তাকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং এভাবে বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের হাত থেকে জাতিকে বাঁচায় এবং পরমুখাপেক্ষী অবস্থায় অভিশাপ থেকে রক্ষা করে। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির যুগে কর্মমুখী শিক্ষা তাই আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

কর্মমুখী শিক্ষার স্বরূপ: কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্রিক শিক্ষা নয়। জীবনমুখী শিক্ষার পরিমন্ডলেই তার অবস্থান। পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবনবোধের আলোয় বিচার করা হয় কর্মমুখী শিক্ষার ভূমিকাকে। কর্মমুখী শিক্ষা নিঃসন্দেহে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক জনশক্তি সৃষ্টি করতে চায় কিন্তু তার মানবিক গুণাবলির বিকাশের দিকটিও উপেক্ষিত থাকতে পারে না। এদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষার লক্ষ ত্রিমুখী:

ক. জ্ঞান জিজ্ঞাসা সৃষ্টিতে: জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটানো, অজানাকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি এবং সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।
খ. মূল্যবোধ সৃষ্টি: শিক্ষার্থীকে নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং মানবিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করা এবং গণতন্ত্রমনা, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে তাকে গড়ে তোলা।
গ. কাজে উৎসাহ সৃষ্টি: কর্মমুখী, জীবনসম্পৃক্ত, বৃত্তিমূলক, উপার্জন মনষ্ক জনশক্তি গড়ে তোলা।

এই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি লক্ষ অর্জন করতে পারলে বাড়তি জনশক্তি হবে জনসম্পদ আর তা না হলে, আংশিক কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে তৈরি করবে মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জিত নিছক যন্ত্রে।

কর্মমুখী শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ: আমাদের দেশে এখনও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে নি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকারত্বের চরম অভিশাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় নিমর্জিত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিক্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাই্যোন্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গরুদুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। আর বাংলাদেশে এ হার ১ শতাংশেরও কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতেও কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে শিক্ষিত বেকারের সংক্যা আও বাড়ছে। অথচ যদি বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা হতো তবে অনেক তরুণ জীবন-জীবিকার নিশ্চিত অবলম্বনকে আশ্রয় করে সুখ-শান্তিময় ভবিষ্যৎ রচনা করতে সক্ষম হতো।

কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা: বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র যে একেবারে উন্নয়ন হয় নি তা নয়। বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার কার্যক্রম ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বিভাগ ও জেলা ভেদে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ২২টি মেডিকেল কলেজ ও ১টি ডেন্টাল কলেজের মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও ৪টি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট, অনেকগুলো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও ভেকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউট ইত্যাদির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ছোটখাটো কারিগরি প্রতিষ্ঠান দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার যে সুযোগ এখন বিদ্যমান তা যে বিপুল জনসংখ্যার তুলায় একেবারে নগণ্য তা বলাই বহুল্য।

তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সাম্প্রতিককালে সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরেই কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই কার্যক্রমকে বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ, মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে দেশের শিক্ষিত জনশক্তি। ইতমধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো : কৃষিবিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞানকে বাধ্যতামূলক করণ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডাবল শিফট চালু, স্কুল ও মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণিতে বেসিক ট্রেড কোর্স চালু, ১৯৯৫ সাল থেকে সাধারণ শিক্ষা ও ভোকেশনাল শিক্ষা সমন্বয়ে এস. এস. সি. শিক্ষাব্যস্থা চালু, মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শিক্ষাব্যবস্থা চালু ইত্যাদি।

কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তমায়নের সমস্যা ও সুপারিশ: কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক, অন্যান্য লোকবল, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, আর্থিক ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রকট সমস্যা বিধ্যমান। শিক্ষকদের গুণগত মান উন্নয়নের জন্যে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও প্রসার করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা।
২. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার জন্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ।
৩. কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের ভোকেশনাল শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং
৪. বৃত্তিমূলক শিক্ষা, কারিগরি এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহ তৈরির জন্যে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে সৃজনশীল কার্যক্রম প্রচার।

পসংহার: আমাদের দেশ বাড়তে থাকা বেকার সমস্যাসহ সামাজিক কুসংস্কার, জনসংখ্যা সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। এই প্রকট সমস্যা কাটিয়ে ওঠার অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে তরুন সমাজকে উপযুক্ত গঠনমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত কার্যকরী হবে। এ কাজে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি এবং তা বাস্তমায়নের জন্যে দরকার উপযুক্ত বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল। তাহলেই এ মহৎ প্রয়াস জাতীয় জীবনে ইতবাচক ফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
   বাংলাদেশের ঋতুচক্র

ভূমিকা: এক অসাধারণ সৌন্দর্যপটের নাম বাংলাদেশ। প্রকৃতির মায়া মমতা যার আপন বৈশিষ্ট্য। যে দেশকে বিধাতা সাজিয়েছেন তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, সুচারুরূপে, বর্ণাঢ্য করে। সে দেশর নাম বাংলাদেশ। যে দেশের সৌন্দর্যের মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া, আছে কেবল প্রগাঢ় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ, সে দেশর নাম বাংলাদেশ। নিসর্গ যে দেশের অলংকার, প্রকৃতি যে দেশের রূপ সুষমার মূল উপকরণ, সে দেশেইতো বাংলাদেশ। অপূর্ব সৌন্দর্যে শস্য-সম্পদে আর প্রকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা এমন দেশ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এদেশে জন্মেছি আমি। আমি ধন্য। আমি তৃপ্ত। এ-বাংলার রূপে বিমুগ্ধ কবি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে তাই গেয়ে ওঠেন-

“ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা,
আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ,
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।”

বাংলার সীমা ও ভূ-প্রকৃতি: ত্রিশ লক্ষ মানুষ যে দেশের জন্য জীবন দিতে পারে, সে দেশ কি যেই-সেই দেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জন করে স্বধীন বাংলাদেশ। এ বাংলাকে ঘিরে উত্তর দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শ্যমলিমায় জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার, উত্তর-পূর্বদিকে আসামের পর্বতময় অঞ্চল, পূর্বে বৈচিত্র্যময় দেশ বার্মা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের সমভূমি আর সর্বদক্ষিণে রয়েছে চির প্রবহমান বঙ্গোপসাগরের শীতল জলধারা।

বাংলার সৌন্দর্য:
 “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছিতই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর।”

গ্রাম বাংলার রূপে বিমুগ্ধ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের এ স্বীকারোক্তিতেই প্রতীয়মান হয় বংলার গ্রামীণ সৌন্দর্য। গ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন চিহ্নসূত্রই থাকবে না। গ্রাম প্রধান দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তই বাংলার যে দিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন চোখে পড়ে শ্যামল শোভাশয় সবুজ অরণ্যানী। কোখাও বা মাঠের পর মাঠ আর সোনালি পাকা ধানের শোভা দৃশ্যমান। সেই ধানের ক্ষেতে যখন মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে যায়, তখন নাবযৌবনা কুমারীর মতই কলহাস্যে নেচে দুলে ওঠে সেই স্বর্ণ রূপিনী ধানের ক্ষেত। কোখাও আবার সারি সারি তাল-নারিকেল-খেজুরের বনানী, কোথাও বা সুজচ্চ বটবৃক্ষ মৌন তপস্যায় মাথা উঁচু করে ঊর্ধ্বপানে তার বাহু প্রসারিত করে আছে আর অকৃপণভাবে স্নেহশীতল ছায়া দান করছে দূরদূরান্ত থেকে আগাত পথিককে। কোখাও বা রাখাল ছেলে গরু-মেষগুলোকে চরাতে দিয়ে কোন সুশীতল তরু মূলে বসে বাঁশিতে তুলছে মেঠো সুর। বাংলার এসব দৃশ্য যুগে যুগে তার সন্তানদের করেছে বাউল, কবি, গল্পকার, চিত্রকার। বাংলার এ রূপ দৃষ্টেই কবিগুরু গেয়েছিলেন-

“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।”

ঋতুবৈচিত্র্য ও বাংলার প্রকৃতি: বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আবর্তিত হয় এর ঋতুবৈচিত্র্যের সাথে সাথে। ছয়টি ঋতুর এক আশ্চর্য লীলা নিকেতন এই বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুই বৈচিত্র্যে আর সৌন্দর্যে অনন্য।

গ্রীষ্মে: এখানে গ্রীষ্ম আসে সূর্যের প্রচন্ড দাবদাহ নিয়ে। গাছে গাছে পেকে ওঠে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল প্রভৃতি ফল। মাঠ-ঘাঠ-প্রান্তর, জনজীবন সবকিছুই এ সময় মেতে ওঠে। প্রখর তাপদাহে জীবধাত্রী ধরিত্রীর বক্ষ বিধীর্ণ হয়ে যায়, চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। তাইতো কবি বলেছেন,
‘ঘাম ঝরে দর দর গ্রীষ্মের দুপুরে

মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে।’
বর্ষায়: গ্রীষ্ম বিদায় নেয় বর্ষার আগমনের সাথে সাথে। আষাঢ়ের জলধারা বাংলার প্রকৃতিকে দেয় চির সবুজ করে। খাল-বিল-নদী-নালা পানিতে থৈ থৈ করে তখন। কদম্ব, যুঁথী, কেয়া। কবি গেয়ে ওঠেন-
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে গোতোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”

শরতে: এর পর ধীরে ধীরে বর্ষার অবসান ঘটে এবং শরৎ তার শুভ্র জ্যোৎস্না ও পুষ্প সুষমা নিয়ে আগমন করে। বর্ষার নিপীড়িতা ধরণী আবার পুলকিত হয়ে ওঠে। শশীর উজ্জল কিরণে কি কাশবন, কি বনের বৃক্ষশীর্ষ, কি গৃহচূড়া, কি নদীর নির্জন বৃক্ষ সমস্তই হাস্যময়ীরূপ ধারণ করে। শরৎকালে শেফালী, কামিনী প্রভৃতি ফুল প্রস্ফুটিত হলে সৌন্দর্য সৌরভে সবাইকে মুগ্ধ করে। এ সময় কবি গেয়ে উঠেন-
“এবার অবগুণ্ঠন খোল
গহন মেঘ-মায়ায় বিজন বন ছায়ায়
তামার আঁচলে অবগুণ্ঠন সারা হল
শিউলি সরভি রাত বিকশিত জোচনাতে
মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো।”

হেমন্তে: বাংলার মানুষের জীবনে নব আশার সঞ্চার করে প্রকৃতিতে এবার আগমন ঘটে পাকা ধানের গন্ধে মাতাল করা হেমন্তের। শস্যক্ষেত্র ধারণ করে এসময় হরিদ্রাবর্ণ, রাত্রিতে শিশির পড়ে ভিজিয়ে দেয় সতেজ ঘাসের ডগা। ভোরে সেই ভেজা ঘাসের ওপর ঝরে পড়ে শিউলি ফুল।

শীতে: গাছপালাকে শ্রীহীন করে, বিবর্ণ করে দিয়ে, এরপর প্রকৃতিতে ঝেঁকে বসে শীত বুড়ি। অবশ্য শীতে বাংলার প্রকৃতি পায় এক ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য। চারদিকে সাদা কুয়াশার চাদর, ভোরে খেজুর রস পাড়ার দৃশ্য, নাড়ার আগুনে শিম পোড়ানো এ সবের মধ্যেই আছে এক স্বতন্ত্র আনন্দ।

ঋতুরাজ বসন্তে: সবশেষে প্রকৃতিরাজ্যে আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের। গাছ-পালা নব পল¬বে সুশোভিত হয়ে ওঠে, ফুলে ফুলে মধুমক্ষিকার গুন গুন তান, গাছে গাছে কোকিলের গান মুখরিত হয়। রাতে জ্যোৎস্না ধারার মাঝে মন কেমন করে ওঠে। হৃদয় ফুঁড়ে বেরোয় গান-
“আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে,
বসন্তের এই মাতাল সমীকরণে।”

উপসংহার: বাংলার প্রকৃতি এভাবেই তার বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য বিকাশের মাধ্যমে আমাদের বিমোহিত করে আসছে। বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্য সম্ভার রয়েছে, তা তার একান্তই নিজস্ব সম্পদ। এমন সৌন্দর্য সম্ভার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। বাংলার প্রকৃতি বিমুগ্ধ কবি তাই জীবনের চরম চাওয়া-পাওয়ার ঘটিয়েছেন এ প্রকৃতির বন্দনার মাধ্যমেই-
“কোন বনেতে জানিনে ফুল,
গন্ধে এমন করে আকুল।
কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাঁসি হেসে,
আঁখি মেলে তোমার আলো
দেখে আমার চোখ জুড়ালো;
ঐ-আলোতেই নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে।”

নানান দেশের নানান ভাষা বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?

মূলভাব: মানুষ মাত্রই তার মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি লাভ করে থাকে। অন্য ভাষা তার কাছে তত সহজে বোধগম্য নয়।

সম্প্রসারিত ভাব: স্বদেশি ভাষা বলতে মাতৃভাষাকেই বোঝায়। মাতৃভাষায় মনের ভাব যত সহজে ও অবলীলায় প্রকাশ করা যায় তা অন্য কোনো ভাষায় সম্ভব নয়। বিদেশি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হলেও মাতৃভাষার মতো চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও তার সাবলীল প্রকাশ ভাষায় সম্ভব হয় না। কারণ শিশুকাল থেকেই মানুষ মাতৃভাষা আয়ত্ত কওে, মাতৃভাষায় কথা বল্ েঅর্থাৎ মাতৃভাষা তার আবাল্য পরিচিত, নিতান্তই মায়ের মতো আপন। স্বদেশের মাটি, পানি, বায়ু আর ভাষাকে ব্যবহার করে বেড়ে ওঠে মানুষ। তাই মানুষের কথা বলার ও মনের ভাব প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট বাহন মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে মানুষ যতটা স্বাচ্ছন্দবোধ করে এবং আনন্দ পায়, অন্য কোসো ভাষায় তা অসম্ভব। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষায় বিশিষ্টতা রয়েছে। মাতৃভাষার সাথে তাদের নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। যে জাতি পৃথিবীতে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানচর্চা, গবেষণা কাজে মাতৃভাষার যত বেশি চর্চা করেছে সে জাতি তত বেশি উন্নত হয়েছে। মাতৃভাষার ব্যাপক চর্চা ও প্রয়োগ ছাড়া জাতীয় বিকাশ সম্ভব নয়। মননশীল সাহিত্য চর্চা মাতৃভাষা ব্যতিরেকে করা যায় না। পৃথিবীর বিদ্বান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা বিভিন্ন ভাষা শেখেন, সাধনা করেন, জ্ঞান চর্চা করেন। কিন্তু অর্জিত সাধনার ফল প্রকাশ করেন মাতৃভাষায়। কারণ মাতৃভাষার দ্বারা যত সুন্দও ও সাবলীলভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় অন্য ভাষায় তা সম্ভব হয় না।   

মন্তব্য: আমাদের আশা আকাঙ্খা ও বিমূর্ত চিন্তা-চেতনা মূর্তি লাভ কওে মাতৃভাষার মাধ্যমেই। তাই মাতৃভাষাই মানুষের ভাব বিনিময়ের অন্যতম বাহন।

পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন/ নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।

মূলভাব: পরের কুশল কামনাই মঙ্গলজনক। অন্যের অনিষ্ট চিন্তা শুধু পরের ক্ষতিই বয়ে আনে না; পরিণামে নিজেকেও বিপদে পড়তে হয়।

সম্প্রসারিত ভাব: পারস্পরিক শুভ কামনাই সামাজিক প্রশান্তির পূর্বশর্ত। আত্ম-স্বার্থ ও আত্মকেন্দ্রিকতাকে পরিহার করে মানুষ যদি প্রত্যেকের প্রতি সহানুভূতিশীল ও শুভার্থী হয় তাহলে পারস্পরিক হৃদ্যতার জন্ম হয়। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধনে মানুষের জীবন সুন্দর ও কল্যানকামী চেতনায় সুশোভিত করার জন্য সকলেই পরশ্রীকাতর মনোবৃত্তি পরিহার করে চলতে হয়। পরোপকারী মানুষ শুধু অন্যের কল্যাণ সাধন করে না, পরোক্ষভাবে নিজের জীবনকেও নিরাপদ করে থাকে।পরোপকারী ও পরদুঃখকাতর মানুষের কোনো শত্রু খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যের উপকার করার সাথে সাথে নিজের শুভার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে তোলেন, যারা বিপদের মুহূর্তে তার পাশে দাঁড়ায়। অপরদিকে যারা হিংসুক ও পরশীকাতর তারা প্রতি মুহূর্তে অন্যের অনিষ্ট সাধনের কথা ভাবে। তার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয় না। তারা অপরের কী করে সর্বনাশ করা যায় সেই চিন্তায় সব সময় মশগুল থাকে। তাদের অনিষ্ট আচরণে শুধু সেই নয়, সাথে ব্যক্তি ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যিনি বা যারা নিজের উপকার হবে বলে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা চালায় মূলত সে নিজেই তার নিজের ক্ষতি করে। যাদের অনিষ্ট করে তারা সকলেই তার শত্রুতে পরিণত হয় এবং শত্রুরা সুযোগ পেলেই তার ক্ষতি সাধনে কর্পণ্য করে না। পরের অনিষ্ট করতে গিয়ে বহু লোক নিজেদের জীবনকেই ধ্বংস করেছে। এর বহু নজর ইতিহাসের পাতায় রয়েছে।

মন্তব্য: পরের অনিষ্ট চিন্তা করা কোনো বিবেকবান ও বুদ্ধিমান মানুষের কাজ নয়। নিজের কল্যাণ চাইলে, নিজের স্বার্থেই সকলকে অন্যের অনিষ্টা চিন্তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।

মূলভাব: অন্যায়কারী এবং অন্যায়কে নতশিরে সহ্যকারী উভয়েই সমান অপরাধী। এ সমাজে কেউ নিজে অন্যায় না করলেই তার কর্তব্য ফুরায় না। আপ্রাণ চেষ্টা দ্বারা অন্যায়কে প্রতিহত করাই সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সম্প্রসারিত ভাব: ন্যায় নীতি বিধান যারা লঙ্ঘন করে, সমাজে নিঃসন্দেহে তারা ঘৃণার পাত্র। যারা শুভ বুদ্ধির মানুষ, তারা অন্যায় হতে দূরে থাকে, অন্যায়কারীর সান্নিধ্যও তারা এড়িয়ে চলে।কিন্তু শুধু এতটুকুতেই আমাদের কর্তব্য শেষ হতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়, অপরের কৃত অন্যায়কে প্রতিহত করাও অত্যন্ত জরুরী। সুস্থ এবং সুন্দর সামাজিক জীবনের স্বার্থেই এটি প্রয়োজন। অন্যায়কে প্রতিহত না করে ভালোমানুষের মতো নীরবে সহ্য করে গেলে তা কখনো শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। কেননা উপযুক্ত প্রতিফলের অভাবে অন্যায়কারীর স্পর্ধা বেড়ে যায় এবং সমাজের বুকে সমূহ অকল্যাণ ঘনিয়ে আসে। আর এই অকল্যাণের দায়িত্ব অন্যায় সহ্যকারী ব্যক্তিরাও অস্বীকার করতে পারে না। কেননা তারাই অন্যায়কারীকে প্রতিরোধ না করে তাকে দুঃসাহসী করে তুলেছে। তাই অন্যায় করার মধ্যে যেমন হীনতা আছে, তেমনি বিনাবাক্যে অন্যায় সহ্য করার মধ্যেও তদরূপ হীনতা বিদ্যামান। এই দুই প্রবণতাই সমানভাবে ধিক্কারযোগ্য। যেখানে প্রয়োজন প্রতিরোধের, সেখানে নীরবতা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অতএব অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়েই নিন্দার পাত্র। বিশ্ববিধাতাও উভয়ের প্রতি সমানভাবে তার ঘৃণা বর্ষণ করবেন।

মন্তব্য: সৃষ্টিকর্তা অন্যায়কারীকে যেমন ঘৃণা করেন, তেমনি অন্যায় সহ্যকারীকেও ঘৃণা করেণ। তাই আমাদের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

স্বদেশের উপকারে নাই যার মন/ কে বলে মানুষ তার? পশু সেই জন।

মূলভাব: মা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা প্রত্যেকের একান্ত আপন ধন। আর এসবকে যে অবজ্ঞা করে সে কখনও প্রকৃত মানুষের মর্যাদা পায় না। তার মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে না।

সম্প্রসারিত ভাব: দেশপ্রেম প্রতিটি মানুষেরই একটি একান্ত অনুভূতি। প্রত্যেক মনীষীই জন্মভূমিকে সর্বাগ্রে ভালোবাসার স্থান দিয়েছেন। কোন এক দেশপ্রেমিক বলেছেন, জননী জন্ম-ভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী। অর্থাৎ, মা আর মাতৃভূমিকে স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। জন্মের পর হতেই প্রতিটি মানুষেরই মাঝে নিজের অজান্তেই দেশপ্রেম গড়ে ওঠে। কেনানা শৈশব হতেই প্রাণের সাথী হয়ে ওঠে জন্মভূমি। তাই প্রতিটি মানুষের নিকটই জন্মভূমি অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ও্রঠে। এ স্বদেশের উপকার বা দেমকে রক্ষা করার জন্যে কত লোক যে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই, দেশের জন্য জীবন দিয়ে মানুষ রিক্ত হন না বরং হন তাঁরা ধন্য। তাঁরা কখনও মরেন না। শহীদ হয়ে অমর হয়ে থাকেন। যেমন—অমর হয়ে আছেন রফিক, সফিক, বরকত, সালাম এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর শহীদেরা বাংলাদেশের ইতিহাসে। দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসে সবার জীবন গড়ে তোলা উচিত। স্বদেশের উপকার করতে গিয়ে মনেরে সংকীর্ণতা দূর করতে হবে। জন্মভূমির মঙ্গল মানুষ মাত্রেই অবশ্য করণীয়। স্বদেশের উপকার এবং কল্যাণের জন্যে যার মন নেই সে ঘৃণ্য। দেশপ্রেম সকল মহত্ত্বের উৎস, মনুষ্যত্বের প্রসূতি। যার মধ্যে দেশপ্রেম নেই, স্বদেশের হিতার্থে যে হিতাকাঙ্ক্ষী নয় সে পশুর চেয়েও অধম। তাকে দিয়ে কোনো মহৎ কাজ সাধিত হয় না। সে মানুষ নয় পশু সমতুল্য। স্বদেশের সম্মান, স্বাধীনতা, কৃষ্টি, আচার সভ্যতা ও ভাষার জন্য যাঁরা জীবন দিতে পারেন তাঁরাই মানুষ। কেনানা স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।

মন্তব্য: নিজের দেশকে অবজ্ঞা করে কেউ কোনোদনি বড় হতে পারে না। শত দুঃখ লাঞ্চনার মাঝে থেকে আবার ফিরে আসতে হয়েছে স্বদেশের আঙিনায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য নিজের মাতৃভূমিকে ভালোবেসে তার সমৃদ্ধি সাধনে সচেষ্ট থাকা।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।

মূলভাব: মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।

সম্প্রসারিত ভাব: ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে গিয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ বাগ লোকের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ ভাগ লোকের মুখের ভাষা উর্দকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।  এ ঘোষণার বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন বিক্ষোভ চরতে থাকে। ১৯৫২ সালের শুরুতেই বাংলা ভাষা আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯৫২-ও ২১ ফেব্রæয়ারি ‘রাষ্টভাষা দিবস’ পালন করার সিদ্ধান্ত নিলে ছাত্রদের আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তানি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল) আম গাছ তলা থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, সফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা অনেকে শহিদ হন। তাঁদের এ আত্মত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলার  অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।  

মন্তব্য: যাদের জীবন দানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি রক্ষা পায় তাদের বাঙালি জাতি কোনো দিন ভুলবে না, চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

মূলভাব: মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, আদিকাল থেকে আজকের যে সভ্যতা তাতে নারী-পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী- পুরুষের সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টাই সভ্যতা সূচিত হয়েছে। সভ্যতা অর্জনে কারো অবদানই কম নয়।

সম্প্রসারিত ভাব: নারী এবং পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে সমাজব্যবস্থা। সুতারং সমাজে নারী এবং পুরুষের অবদান সমভাবে বিদ্যমান। এ নর-নারী একে অপরের পরিপূরক সত্তা। মহান স্রষ্টা বিশ্বের আদি মানব হযরত আদম (আ) এবং মনবী বিবি হাওয়া (আ)-এর আবাসস্থল হিসেবে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তীকালে আদম এবং হাওয়ার অবদানেই এ জগতে মানুষের আবাদ হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে নারীরাও পুরুষের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে তাদের উপর আেেরাপিত দায়িত্ব পালন করছেন। তাই নারীদের কর্মস্থল শুধু রান্নাঘরে সীমাবদ্ধ নয় বরং পরিব্যাপ্ত সমাজের সকল অঙ্গন। কথায় আছে, “যে শকটের এক চক্র বড় এবং এক চক্র ছোট হয় সে শকট অধিক দূর অগ্রসর হতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে ঘুরতে থাকবে।” অর্থাৎ যেখানে পুরুষ জাতিকে প্রাধান্য এবং নারীজাতিকে অবহেলা করা হবে সেখানে জাতির কোন উন্নতি বা পরিবর্তন হবে না।ইসলাম ধর্ম সমাজে নারীরা মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং শিক্ষার অধিকারসহ সকল অধিকার দান করেছে—” প্রত্যেক নর-নারীর বিদ্যা অর্জন করা ফরজ।” অন্ধকার যুগে নারীদের কোনো মর্যাদা দেওয়া হতো না। সে যুগে নারীরা দাসী ছিল এবং ন্যায্য অধিকার হতে তাদের বঞ্চিত করে রাখত, যা সময়ের বিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তন হয়। এখন সারাবিশ্বে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও কঠিন কর্তব্য পালন করতে হয়। সর্বক্ষেত্রে তারা দক্ষতার ছাপ রাখছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মায়ের কাছে সন্তান যে শিক্ষা লাভ করে তাই পরবর্তী জীবনে তার চরিত্র গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। সেজন্য মায়ের নিকট হতে শেখা উপযুক্ত শিক্ষার গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। এছাড়া সংসারে সুখ-সমৃদ্ধি ও উন্নতির ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। কথায় আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।’

মন্তব্য: নারী ও পুরুষের সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টার সৃষ্ট এ সমাজের উন্নতি এবং প্রগতির জন্য নারীরা সমান অংশীদার। তাই যাবতীয় উন্নয়নমূলক কার্যে নারীদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।