চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Tuesday, July 28, 2020

 দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার

ভূমিকা: যন্ত্রপ্রকৌশল ও প্রযুক্তি-নির্ভর মানব সভ্যতার অগণিত আবিষ্কারের বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই বিষ শতকে যে মহাবিস্ময়কে মানুষ আলাদিনের চোগের মতো হাতের মুঠোয় পেয়েছে তার নাম কম্পিউটার। এ এক মহাপরাক্রমশালী অথচ অনুগত যন্ত্র যা মানুষের কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবলীলায় অক্ষরে অক্ষরে প্রতিটি হুকুম পালন করে। আজকের দিনে তাই মানবসব্যতা হয়ে পড়েছে কম্পিউটার-নির্ভর স্বয়ংক্রিয়তা-কেন্দ্রিক। এবং এর ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণশক্তি বেড়ে গিয়েছে বহু গুণ, বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা। অনেক সহজ হয়ে উঠেছে প্রশাসনিক কাজকর্ম ও হিসাব নিকাশের জটিলতা। অনাবশ্যক অনেক মানসিক শ্রমের হাত থেকেও রেহাই ফেয়েছে মানুষ।

কম্পিউটার কী?: আভিধানিক অর্থে কম্পিউটার হলো এক ধরনের গণক যন্ত্র। কিন্তু আজকাল কম্পিউটারকে কেবল গণনাকারী বলা চলে না। এখন তা এমন এক ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ধারণা দেয় যা অগণিত তথ্য বা উপাত্ত গ্রহণ করে অত্যন্ত দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ, গণনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে পারে। কম্পিউটার আসলে এক ধরনের যন্ত্র-মস্তিস্ক। মানুষ যেমন করে মগজে ধরে-রাখা স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, তথ্য ও তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করে, কম্পিউটারের কাজও তেমনি। কম্পিউটারকে তথ্য ও নির্দেশনা প্রদানের জণ্যে যে বিশেষ ভাষা ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় ‘প্রোগামিং ল্যাংগুয়েজ’, আর এসব কিছুকে একত্রে অভিহিত করা হয় ‘কম্পিউটার সফ্টওয়্যার’। এছাড়া কম্পিউটারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী একটা কাঠামো থাকে, তাকে বলে ‘হার্ডওয়্যার’। কম্পিউটারের বড় উপযোগিত হলো তথ্য ও প্রোগ্রাামের রদবদল বা সংযোজন ঘটিয়ে একই কম্পিউটাকে দিয়ে নানারকম কাজ করানো চলে। কম্পিউটার যে আজকের দিনে বিস্ময়কর ও বিশ্বস্তভাবে সবধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। সেগুলো হলো : এক. অত্যন্ত দ্রুত গণনার ক্ষমতা, দুই. বিপুল পরিমাণ উপাত্তকে সুসংবদ্ধভাবে যন্ত্র-মগজে ধরে রাখার ক্ষমতা, তিন. তথ্য বিশ্লেষণের নির্ভুল ক্ষমতা, চার. ’ডেটা’ ও প্রোগ্রাম’ অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা। মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি ক্রমেই পম্পিউটারের কার্যকারিতা ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করছে।

উদ্ভাবন ও ক্রমোন্নতি: প্রাচীনকাল থেকে যান্ত্রিক গণনা পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে বর্তমান কম্পিউটারের রূপ নিয়েছে। তবে আধুনিক কম্পিউটারের সূত্রপাত হয়েছে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের গণকযন্ত্র অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন থেকে । এরপর ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর যন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ঘটেছে বৈপ্লবিক অগ্রগতি। প্রথমদিকে নির্মিত পেনসেলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনিয়াক’ নামের কম্পিউটারের ওজন ছিল ত্রিশ টন, তার আয়তনও ছিল বিশাল। ৪০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া ঘরের সবগুলো দেয়াল জুড়ে ছিল এর যন্ত্রপাতি। আর এখন এর আকার নেমে এসেছে হাতব্যাগের আকারে।

সবকাজের কাজি: কম্পিউটার আধুনিক বিশ্বের এমন এক সবজান্তা বিস্ময়কর যন্ত্র যে সব কাজেই পারদর্শী। এমন কোনো কাজ নেই যা কম্পিউটার করছে না। মানুষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু ও সঙ্গী সে। কোটি কোটি সংখ্যার যে জটিল অঙ্ক কয়েকদিনে করে শেষ করা যায় না তা মুহূর্তেই নির্ভুলভাবে করে দিচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটার এখন কলকারখানার উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যাংক, বিমা, টেলিযোগাযোগ, রেল ও বিমান পরিবহন, ডাক ব্যবস্থা, গবেষণা, প্রতিষ্ঠান, তথ্যকেন্দ্র কোথায় কাজ করছে না কম্পিউটার? কম্পিউটার রোগ নিরূপণ করে দিচ্ছে। ব্যবসায়ের লাভ-লোকসানের হিসাব রাখছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও কম্পিউটার নিয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবই শেখাচ্ছে নিপুণ দক্ষতার সাথে। দাবা, ক্রিকেট, ফুটবলসহ নানারকমের ভিডিও গেম খেলছে কম্পিউটার। এসব খেলায় কম্পিউটার মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। খেলার তথা রেকর্ড করছে নপুণভাবে। কম্পিউটার এখন ছবি আঁকছে, পুরনো-ছবি পুনরুদ্ধার করছে, মানচিত্র তৈরি করছে। ভস্কর্য তৈরি করছে। ফিংগার প্রিন্ট ও ছবি বিশ্লেষণ করে অপরাধীকে খুঁজে বের করওে কম্পিউটার বাহবা কুড়াচ্ছে। মুদ্রণ জগতেও অনেক বিস্ময়ের জন্ম নিদয়েছে কম্পিউটার। ইন্টানেটের সাহায্যে ঘরে বসে মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোন জায়গায় যে-কোন-তথ্য আদন-প্রদানের সুযোগ এনে দিয়েছে কম্পিউটার। কম্পিউটার চালিত ‘স্ক্যারাব’ সমুদ্র তলদেশ থেকে খুঁজে এনেছে আটলান্টিক মহাসাগরের ভেঙে-পড়া বিমানের ’ব্ল্যা বক্স’, নভোযানে বসে নিয়ন্ত্রণ করছে তার গতিবিধি, সেখান থেকে তথ্য পাঠাচ্ছে পৃথিবীর বুকে। মানুষের অসাধ্য ও বিপদজ্জনক কাজেও কম্পিউটার নিয়ে আসছে অকল্পনীয় সাফল্য। কম্পিউটারের এই অসাধারণ সাফল্যই একুশ শতকে পর্দাপণ করা বিশ্বকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন করে সাজানোর।

বাংলাদেশে কম্পিউটার: ১৯৬৪ সালে আণবিক শক্তি কেন্দ্রে IBM 1620 সিরিজের একটি কম্পিউটার আনার মাধমে প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলাদেশে কম্পিউটারের পদচারণা শুরু হয়। কিন্তু আশির দশকের আগে এদেশে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় নি। নব্বইয়ের শুরু থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার শিক্ষা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কম্পিউটাররের দ্রুত ও ব্যাপক ব্যবহার ঘটছে। কম্পিউটার শিক্ষাও যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশে কম্পিউটার বিজ্ঞান অধ্যয়নের সুযোগ অবশ্য কখনও যথেষ্ট সীমিত। কেবল ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য শহরগুলোর শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ পায়। আবার যারা বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেছে তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক মানের সফ্টওয়্যার তৈরি করছে। তবে দুঃখের বিষয়, কম্পিউটার বিজ্ঞানে উন্নয়ন প্রশিক্ষণ লাভকারীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এটা আমাদের দেশে কম্পিউটার প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
কম্পিউটার ও বেকারত্ব : কম্পিউটার মানবশক্তির এক বিস্ময়কর বিকল্প। এর ক্ষমতা সাধারণ নজশক্তির চেয়ে বহুগুণ বলে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। কম্পিউটার মানুষের কাজ কেড়ে নিচ্ছে বলে ক্রমেই কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে ও বেকারত্ব বাড়ছে আমাদের মত জনবহুল দেশে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার বেকারত্বের আশঙ্কাকেই ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে।

কম্পিউটারজনিত অন্যান্য সমস্যা: কম্পিউটার ব্যবহার শারীরিক দিক ‍দিয়েও কিছুটা ক্ষতিকর এর থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয়তা কখনো কখনো শরীরের জন্যে ক্ষতিকর হয়। ভাইরাস আক্রমণ যান্ত্রিক ক্রটি ইত্যাদির ফলে অনেক সময়ে কম্পিউটার বিপর্যয় ঘটে। ফলে অনৈক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুহুর্তেই নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে প্রশাসন ও কর্মক্ষেত্রে বিরাট ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সাম্প্রতিককালে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণায় নানা যান্ত্রিক ক্রুটির ফলে বহু শিক্ষার্থী জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে।

উপসংহার: কম্পিউটার আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে যেমন বিবেচিত হচ্ছে তেমনি এর ব্যাপক ব্যবহারে বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের আশঙ্কাও আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। এজন্যে কম্পিউটারের পরিকল্পিত, ভারসাম্যমূলক ব্যবহার ও দেশে কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়ন, দরকার। তা না হলে একুশ শতকের চলার গতির সঙ্গে আমরা যেমন তাল মিলিয়ে চলতে পারব না, তেমনি অতিরিক্ত গতি নিতে গিয়ে তাল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ব সংকটের আবর্তে। এক্ষেত্রে পরিণামদর্শী পদক্ষেপই হবে আমাদের অগ্রযাত্রার রক্ষাকবচ।

No comments: