চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Wednesday, May 5, 2021

রচনা

 দেশ গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

রচনা সংকেত

  Ø  ভূমিকা;
Ø  আমাদের ছাত্রসমাজ;
Ø  ছাত্রসমাজে সুপ্ত প্রতিভা;
Ø  দেশের ধারণা;
Ø  ছাত্র সমাজ ও দেশের সম্পর্ক;
Ø  অনন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও দেশের উন্নতি;
Ø  বর্তমানের ছাত্র, ভবিষ্যতের দেশনেতা;
Ø  বিশ্বে দেশগঠনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ছাত্রসমাজ;
Ø  উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশ ও ছাত্রসমাজ ও
Ø  উপসংহার।


ভূমিকা: মানব সভ্যতার সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে ভিত্তি করে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে আলাদা আলাদা সমাজ, যা ইতিহাসে পরিণতি পেয়েছে রাষ্ট্র বা দেশ হিসেবে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত প্রখর বুদ্ধিমত্তার দ্বারা প্রতিটি সমাজ তথা দেশের ব্যাপক ও বহুমুখী অগ্রগতির মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে সমগ্র মানব সভ্যতা অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে। এইসকল সমাজ তথা দেশের উন্নতির পেছনে কাজ করে অসংখ্য ছোট-বড় বিষয়। এই অসংখ্য ভিন্নধর্মী উপাদান একত্রিত হয়েই একটি উন্নত রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই কল দেশ গঠনকারী শক্তিগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সংশ্লিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রের ছাত্রসমাজের ভূমিকা। যেকোনো সমাজ তথা বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক বিষয়ের ছাত্র সমাজের সক্রিয়  অংশগ্রহণ। এই অংশগ্রহণ ছাড়া কোনদিনই একটি দেশ অগ্রগতির কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারে না। 

আমাদের ছাত্রসমাজ: কোন একটি দেশের গঠনে ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে বোঝা প্রয়োজন, ছাত্রসমাজের মূলগত চরিত্র আসলে কি! পৃথিবীতে সমাজ, সংস্কৃতি বা দেশ যতই ভিন্ন প্রকৃতির হোক প্রতিটি জায়গার ছাত্র সমাজের মধ্যে কিছু মৌলিক চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ছাত্র সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অফুরন্ত প্রাণশক্তির কথা।

বয়স এবং মানসিকতায় তরুণ হওয়ার কারণে ছাত্রসমাজ অদম্য প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ থাকে। এই প্রানশক্তির মাধ্যমে তাদের মনের অন্তঃস্থলে জাগরিত তরুণ দেশপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট সমাজ তথা দেশের গঠনমূলক কার্যক্রমে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে চায়। কখনো কখনো তরুণ বয়সের অনর্থক আবেগপ্রবণতা তাদেরকে সিদ্ধান্তগত দিক থেকে ভুল পথে চালিত করলেও দেশ গঠনের ক্ষেত্রে এই ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণের ভূমিকা কখনোই অস্বীকার করা যায় না।

ছাত্রসমাজে সুপ্ত প্রতিভা: দেশ গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা কেন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তরে অনিবার্যভাবে উঠে আসে ছাত্র সমাজের মধ্যে সুপ্ত ব্যাপক প্রতিভা সম্পর্কিত আলোচনা। কোন সমাজ বা দেশ গঠিত হয় অদম্য প্রতিভাময় সম্ভাবনা দ্বারা। সেই সকল গঠনমূলক প্রতিভা সুপ্ত থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের ছাত্র সমাজের মধ্যে। সমাজের এই অংশ হলো ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনার পরম আধার।

বর্তমানে যে সকল মানুষ দেশের উন্নতির পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে, অতীতে একদিন তারাও সাধারণ ছাত্র ছিল। তাই একইভাবে আজ যারা সাধারণ ছাত্র হিসেবে দিনযাপন করছে কাল তারাই দেশকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছাত্রাবস্থাতেই মানুষ নিজের অন্তরের সুপ্ত প্রতিভাকে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে শেখে। সেই সম্ভাবনা ভবিষ্যতে পরিণতি পায় দেশ গঠনে। 

দেশের ধারণা: সমাজতত্ত্বের একটি অতি জনপ্রিয় বিতর্ক হল দেশের প্রকৃত ধারণা আসলে কি! এই নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানান মুনির নানান মত। তবে এই প্রতিবেদনে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল ছাত্র সমাজের মধ্যে দেশের ধারণা কিভাবে পরিণতি পায়। সাধারণভাবে বলা যায় কোন একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতার গণ্ডিকেই আধুনিককালে দেশ বলে অভিহিত করা হয়।

আমাদের ছাত্রসমাজ স্বভাবতই আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। সে কারণে দেশের এই তাত্ত্বিক সংজ্ঞা তাদের কাছে নেহাতই তত্ত্বরূপে পরিণতি পায় না। বরং বড় হয়ে ওঠার পথে দেশের তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ছাত্র সমাজের কাছে ব্যক্তিগত আবেগের বিষয় হয়ে ওঠে। এই আবেগের বশবর্তি হয়ে অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছাত্রসমাজ যেকোনো মূল্যে দেশের সেবা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে।

ছাত্র সমাজ ও দেশের সম্পর্ক: দেশ এবং ছাত্র সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। মানব সভ্যতার এই দুই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। ছাত্রসমাজ একদিকে যেমন দেশীয় সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে শিক্ষার উপাদান সংগ্রহ করে জীবনে আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে যায়। তেমনি দেশও সমৃদ্ধি পরম আশা নিয়ে এই ছাত্র সমাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেশের মহান ছত্রছায়া ভিন্ন ছাত্রসমাজ যেমন অস্তিত্বশীল থাকতে পারেনা, তেমনি ছাত্রসমাজের কাঁধে ভর না করে কোন সমাজের অগ্রগতির চাকাও সচল থাকতে পারে না। সেকারণে সভ্যতার প্রয়োজনে ছাত্র সমাজ এবং দেশ একে অপরের ওপর পারস্পারিক নির্ভরতার দ্বারা অগ্রগতির চাকাকে সচল রাখে।

অনন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও দেশের উন্নতি: ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রতিভার ব্যাপক সংমিশ্রনের ফলে শারীরিকভাবে এই সমাজের মধ্যে নিহিত থাকে অনন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনার ওপর ভর করেই সমগ্র সভ্যতা ভবিষ্যতে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষী আছে পৃথিবীতে যত উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তাতে সবথেকে বেশি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে ছাত্রসমাজের মধ্য থেকেই। এই ছাত্রসমাজই নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা দ্বারা বিভিন্ন উদ্ভাবনের সৃষ্টির মাধ্যমে নানা সময়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই ছাত্র সমাজের মধ্যে থেকেই উঠে আসে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী, সৈনিক, প্রশাসক কিংবা আদর্শ শিক্ষকরা। তারা ছাত্রাবস্থায় অর্জিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সার্বিকভাবে দেশকে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

বর্তমানের ছাত্র, ভবিষ্যতের দেশনেতা: দেশের সার্বিক অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞানী, সৈনিক, শিক্ষক, প্রশাসক প্রমুখদের প্রয়োজন থাকলেও যার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের সকল উদ্যোগ দেশের উন্নতিতে সার্থকভাবে বিকশিত হয় তিনি হলেন একজন রাষ্ট্রনেতা। রাষ্ট্রনেতা কোনদিন হঠাৎ করে তৈরি হতে পারে না। ছাত্রাবস্থায় থেকে নিজের অন্তঃস্থলে অপার দেশপ্রেম ও জাতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে ধীরে ধীরে দেশের জন্য কাজ করতে করতে একজন দেশ নেতা গড়ে ওঠে। যে ছাত্র বর্তমানে স্কুল কিংবা কলেজের কোন নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষক কিংবা কর্তৃপক্ষের সাথে বিতর্ক করে চলেছে, সেই ছাত্রই হয়তো কোন নিজের দেশের জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে একদিন বক্তব্য রাখবে কোনো এক আন্তর্জাতিক মঞ্চে। ছাত্র সমাজের মধ্যেকার দেশপ্রেমের চূড়ান্ত বিকশিত ও পরিণত হল একজন সার্থক রাষ্ট্রনেতা।

বিশ্বে দেশগঠনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ছাত্রসমাজ: আধুনিক যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজ দেশ গঠনের পথে নানান বাধা অতিক্রম করার জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর উদাহরণ আমরা বিংশ শতাব্দী থেকেই বারবার দেখতে পেয়েছি সমগ্র বিশ্বজুড়ে। কখনো দেখেছি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানিয়ে ছাত্র সমাজে ব্যাপক মিছিল; কখনো দেখা গেছে পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতায় শিহরিত হবা ছাত্রসমাজের শান্তি মিছিল। আবার কখনো এই দূষিত বিশ্বে বিজ্ঞানীদের বারংবার আবেদন সত্বেও সাধারণ মানুষ যখন প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসছে না, তখন ছাত্রসমাজকে দেখা গিয়েছে পরিবেশের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে ছাত্র সমাজ বৃহত্তর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইউরোপের সুইডেনের পরিবেশ কর্মী স্কুলপড়ুয়া গ্রেটা থুনবার্গ এর কথা তো বর্তমানে বিশ্ব বিদিত।

উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশ ও ছাত্রসমাজ: ভারতীয় উপমহাদেশে ছাত্র সমাজ ও দেশের এক অত্যন্ত গূঢ় সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান রয়েছে। অতীতকালে যখন ভারতের প্রতিটি ঘর থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছাত্র জীবন কাটানোর উদ্দেশ্যে গুরুগৃহে গমন করত, তখন থেকেই দেশের সাথে তাদের নাড়ির টান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বারা এই প্রতিভাবান ছাত্র সমাজকে শিক্ষিত করে তুলে তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা হতো ঐতিহ্যগত আবেগ। ছাত্রাবস্থা থেকেই দেশের বিভিন্ন গঠনমূলক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের নিদর্শন এই উপমহাদেশে রয়েছে। ছাত্র সমাজের এই প্রবণতা একইভাবে বর্তমান রয়েছে আধুনিক যুগেও। এই প্রসঙ্গে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বহু ক্ষেত্রে উপমহাদেশের বৃহত্তর আন্দোলনগুলিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এদেশের ছাত্র সমাজ। তাছাড়া স্বাধীনতার পরেও বহু গঠনমূলক গণ আন্দোলন, জাতীয় স্বার্থমূলক নানা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য দরবার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজের ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে সুষ্ঠু যানজট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দাবিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

উপসংহার: সমাজ যদি একটি শরীর স্বরূপ হয়, ছাত্রসমাজ তাহলে সেই শরীরের ডান হাত। জাতীয় উন্নয়ন মূলক যে কোন প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ছাত্র সমাজকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। সে কারণে কোন দেশের ছাত্র সমাজকে যদি অক্ষম করে রাখা হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে সেই দেশের মূল চালিকাশক্তিই স্তব্ধ হয়ে পড়বে। তাই ছাত্রসমাজকে জাতীয় সংস্কৃতির সকল নির্যাস দিয়ে স্বাধীন মনে  প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দ্বারা মৌলিক গঠনমূলক কর্মসূচি রূপায়ণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

রচনা


 জনসেবা

     সংকেত

  v  ভূমিকা;
v  জনসেবার অর্থ;
v  জনসেবার বৈশিষ্ট্য;
v  জনসেবার ক্ষেত্র;
v  জনসেবার পদ্ধতি;
v  জনসেবার মানসিকতা অর্জনে সহায়তা;
v  জনসেবা যুগে যুগে;
v  জনসেবা ও ধর্মীয় চেতনা;
v  জনসেবার গুরুত্ব;
v  জনসেবার পদ্ধতি ও জনসেবার চেতনা;
v  সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল;
v  উপসংহার।

ভূমিকা:

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার চেয়ে সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

সকলের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনধারণ এবং সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ানোর মধ্যেই জীবনের যথার্থ সার্থকতা নিহিত। নিজের স্বার্থের জন্যেই কেবল জীবন নয়। এ প্রসঙ্গে ডা. লুৎফর রহমান বলেন: প্রকৃত সুখ কোথায়? পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সুখটুকু ভাগ করে নেওয়াতে কি সত্যিকারের সুখ আছে? আত্মার সাত্ত্বিক তৃপ্তির কাছে জড় দেহের ভোগ সুখের মূল্য কিছুই না। যতদিন না মানুষ পরকে সুখ দিতে আনন্দবোধ করবে ততদিন তার যথার্থ কল্যাণ নাই। মানুষ সমাজবদ্ধ, সহানুভূতিশীল জীব বলেই আত্মস্বার্থে মগ্ন থাকা তার স্বভাব-বিরুদ্ধ। মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ হয় না। চাই মনুষ্যত্ব অর্জনের দীক্ষা। জনসেবা সামাজিক মানুষের সেই দীক্ষার যথার্থ মন্ত্র। সমাজের সহায় সাহায্যহীন সর্বহারা হতাশাগ্রস্তকে প্রাণবন্ত করে তােলাই মানুষের ধর্ম। আর তাই নিজের স্বার্থত্যাগ করে অপরের সেবায় আত্মনিয়োগ করার নামই জনসেবা।

জনসেবার অর্থ: জনসেবা কথাটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। এর দ্বারা শুধু আর্ত-পীড়িত, দুঃখী-দরিদ্রকে সাহায্য করা বুঝায় না বরং সকল মানুষের কল্যাণ সাধনকেও বুঝিয়ে থাকে। মানুষমাত্রই সামাজিক জীব। একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভেতরে বাইরে এক অদৃশ্য যোগসূত্রে গ্রথিত। সমাজস্থ মানুষের কল্যাণে যেকোনো কাজই জনসেবা হিসেবে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে কবি কামিনী রায়ের কবিতার চরণ দুটি স্মরণযোগ্য - 

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

জনসেবার বৈশিষ্ট্য: বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপকার করার নামই জনসেবা। Ruskin বলেন, 'There are three kinds of duties- duties towards God, duties towards parents and duties towards mankind.' মানুষ স্বভাবতই স্বার্থ ত্যাগ করতে চায় না। এ কারণে নিজের মঙ্গলকে লক্ষ করে অপরের মঙ্গল করার নামই জনসেবা। মানুষ সামাজিক জীব, সে কখনোই একা বাস করতে পারে না। সকলকে নিয়েই তার জীবন। কেননা সে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে পরোপকারের মহান ব্রতে মানুষের মন উদ্দীপ্ত হয়। পরোপকারের মাধ্যমেই সে আনন্দ লাভ করে। আর তখন সমাজজীবন হয়ে ওঠে সুন্দর। স্বার্থমগ্নতা মনুষ্যত্বের পরিপন্থী। স্বার্থপর ব্যক্তি বৃহত্তর জীবনাঙ্গন থেকে স্বেচ্ছানির্বাসিত। 

পৃথিবীর ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল তার হৃদয়মন স্পর্শ করে না। সে নিজেকে নিয়েই বিব্রত থাকে। মানবধর্মের অবমাননাকারী ব্যক্তি পৃথিবীর জঞ্জাল। সে কখনোই সুখকর জীবনযাপনের স্বাদ পায় না। এ ধরনের স্বার্থপর মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সে সমাজের কোনো উপকারে আসে না। আর মানুষ যদি মানুষের উপকারেই না আসে তবে তাঁর জীবন ব্যর্থ। সেজন্যে সত্যিকারের ভালোমানুষ বলতে তাকেই বোঝায় যে নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে পরোপকারে নিয়োজিত থাকে। সেই মহৎ মানুষ যে নিজের জন্য নয়, সে বিশ্বমানবের জন্যে নিবেদিত তাই বলা হয়েছে -

আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা
জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।

জনসেবার ক্ষেত্র: জনসেবার কথাটি যেমন ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এর প্রয়োগ ক্ষেত্রও বিস্তৃত। সারাবিশ্বে এমন কোনো কাল ও সমাজ নেই বা ছিল না যে সমাজে বা কালে আর্ত-পীড়িত, দুঃখী-দরিদ্র অসহায়-সম্বলহীন, অনাথ-প্রতিবন্ধী মানুষ ছিল না। এসব মানুষদের সেবা করা জনসেবা বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। সমাজের কেউ না কেউ এসব অসহায় মানুষদের সেবা করে আসছে। তাছাড়া রাস্তা-ঘাট, পুল-সাঁকো নির্মাণ, পুকুর-দিঘি খনন ইত্যাদিও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং জনসেবার ক্ষেত্র কোনো বিশেষ কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। 

জনসেবার পদ্ধতি: বিশ্বের সব সমাজের প্রকৃতি যেমন এক নয় তেমনি সমস্যাও এক রকম নয়। সমাজের প্রকৃতি অনুসারে সমস্যার প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের হয় বলে জনসেবার পদ্ধতিও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন- একজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া যেমন জনসেবার পর্যায়ে পড়ে তেমনি সংশ্লিষ্ট ভিক্ষকে ভিক্ষা না দিয়ে তাকে কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়াও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত। তাছাড়া রুগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মৃতদেহ সৎকারের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠন, অনাথ-আতুরদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান ইত্যাদিও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত।

জনসেবার মানসিকতা অর্জনে সহায়তা: জনসেবা মূলত একটি মানবিক গুণ। এর জন্য কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া স্কুল-কলেজসমূহে অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে কীভাবে জনসেবা করা যায় তার একটি দিক-নিদের্শনা দেওয়া যায়। এতে ছাত্রজীবন থেকেই প্রত্যেকে জনসেবার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। 

জনসেবা যুগে যুগে: পূর্বে আমাদের দেশে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডসমূহ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়ে সামষ্টিকরূপে উন্নীত হয়েছে। আগেকার দিনে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল রাস্তা নির্মাণ, খাওয়ার পানির জন্য পুকুর বা দিঘি খনন, পথিকদের জন্য পান্থশালা নির্মাণ, অতিথিশালা নির্মাণ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে মানুষের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি লাভ করেছে। এখন নানাভাবে জনসেবা চলছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যাত্রী ছাউনি, সংবাদপত্র কেন্দ্র, পাঠাগার, পার্ক, চিত্তবিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বমানবতার কল্যাণে নানা আন্তর্জাতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন রেডক্রস, রেডক্রিসেন্ট ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে। কোনো আকস্মিক বিপদ এসে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করলে আর্ত-মানবতার সেবায় এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ সূচনা পালন করে। 

জনসেবা ও ধর্মীয় চেতনা: সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। মানুষের এই সেবাব্রত প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মাশ্রিত। ধর্মীয় চেতনাই মানুষকে সেবাধর্মে অনুপ্রাণিত করেছে। জগতের ধর্মগুরু ও ধর্মপ্রবক্তরা সেবাধর্মকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলেছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন: মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি মানুষের উপকার করেন। ধর্মীয় চেতনাই মানুষকে সেবাধর্মে অনুপ্রাণিত করেছে। ধর্মপ্রবণতাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের মানুষের জীবন-প্রত্যয়। বিভিন্ন ধর্মশাত্রে, কুরআনে, রামায়ণ-মহাভারতে, মহাকাব্যে, পুরাণে জনসেবাই শ্রেষ্ঠধর্মের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব। স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয়েছে -

জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

জনসেবার গুরুত্ব: বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন : পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও  পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে মানবজীবন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ফুলের মতোই মানুষের জীবন। ফুল ফুটে সুবাস ছড়ায়। তার সৌরভে চারদিক আমোদিত হয়। এভাবে সৌরভ ছড়ানোর মধ্যেই সে তার সার্থকতা খুঁজে পায়। তদ্রপ, অপরের কল্যাণে নিজকে নিয়োজিত করতে পারলেই জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে জাতিতে খাটি জনসেবকের সংখ্যা যত বেশি সে জাতির ঐক্য, জাতীয়তাবোধ এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে তত বেশি। সমাজের উন্নতির মূলে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর মধ্যে শিক্ষা, সময়োপযোগী চেতনা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ অন্যতম। কিন্তু সমাজের সচেতন এবং যোগ্য ব্যক্তিগণ এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন না করলে সাধারণ জনগণ তা যথাসময়ে যথাযোগ্যভাবে অর্জন করতে পারে না।

 এ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতির জন্যে কাউকে না কাউকে সমাজসেবার মহৎ ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের সাধ্যমত সাহায্য করতে হবে। দেশের চরম দুর্গতির সময় জনসেবার মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে । সর্বোপরি যে ব্যক্তি যেখানে, যে কর্মে নিয়োজিত আছে তার সে অবস্থান থেকেই মানুষের সেবা করতে হবে। তবেই মানবজীবন থেকে দুঃখ দূরীভূত হবে। 

জনসেবার পদ্ধতি ও জনসেবার চেতনা: জনসেবায় সকলেরই অধিকার আছে। মানুষের সবকটি মহৎ গুণাবলির মধ্যে সেবাব্রত অন্যতম। অন্নহীনে অন্নদান, বস্র বস্রহীনে, 

তৃষ্ণাতুরে জল দান, ধর্ম ধর্মহীনে, 
মূর্খজনে বিদ্যাদান, বিপন্নে আশ্রয়
রোগীরে ঔষধ দান, ভয়ার্তে অভয় 
গৃহহীনে গৃহ দান, অন্ধেরে নয়ন,
পীড়াতে আরোগ্যদান, শোকার্তে সান্ত্বনা,
স্বার্থশূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান,
স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান।

রজনীকান্ত সেনের এই দ্বাদশ দানের মধ্যেই প্রকৃত জনসেবার পরিচয় ও পদ্ধতি ফুটে উঠেছে। যারা বিত্তবান, তাঁরা দীনদুঃখীর ক্লেশ মোচনে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে পারেন। যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা তাদের সাধ্যমত শ্রম দিয়ে হোক, ভালোবাসা দিয়ে হোক, সান্ত্বনা দিয়ে হোক-অপরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে পারলে তবেই জীবনের সার্থকতা। জনসেবায় কায়িক শ্রমের মূল্য অপরিসীম। এই ব্রত উদ্‌যাপনে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে সম্মিলিত বা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার গুরুত্ব বেশি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দুস্থ মানুষের সেবাই এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রকৃতির রুদ্ররোষে, যুদ্ধে বা সাম্প্রদায়িক মত্ততায় মানুষ যেখানে অসহায় সেখানে এসব প্রতিষ্ঠান নিঃশর্ত সাহায্যের হাত প্রসারিত করে ছুটে যান। তারা বিপক্ষের জাতি ধর্মের বিচার করেন। না। আর্তের সেবার মধ্য দিয়েই এঁরা মানব জন্মের মহিমাকে প্রচার করেন। আমাদের দেশের সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে। বিভিন্ন এন. জি. ও, রেড ক্রিসেন্ট, রামকৃষ্ণ মিশন প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল: জনসেবায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক দলগুলো সংঘবদ্ধ শক্তি। এঁরাও, দুর্গতদের সাহায্যে প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। তবে এদের মধ্যে অনেকের ধারণা জনসেবার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ কোনো চিরস্থায়ী সমাধান নয়। সমাজের বুকে দীর্ঘদিনের যে হৃদয়হীন অন্যায়-অনাচারের পাহাড় সঞ্চিত হয়েছে, তার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সর্বাত্মক সমাধানের জন্যে তারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু যতদিন সমাজে দারিদ্র্য, শোষণ, বৈষম্য থাকবে ততদিন জনসেবার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল জনসেবাকেই জীবনের একমাত্র মহৎ ব্রত মনে করেন না। ক্ষমতা দখল এবং অধিকৃত ক্ষমতা বজায় রাখার দিকেই তাদের প্রাণান্ত প্রয়াস। ফলে দুর্গত, বিপন্নের সেবাতেও দেখা যায় সংকীর্ণ, দলীয় মনোভাব। জনসেবা অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার ছদ্মবেশ মাত্র।

উপসংহার: জনসেবা প্রত্যেক মানুষেরই এক সৎ ও মহৎ হৃদয়বৃত্তি। এই হৃদয়-বৃত্তির জাগরণই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। মানুষ কেবল স্বার্থ আর সম্পদের যন্ত্র নয়। মানুষ সুন্দরের আরাধনা করে। বিরাট মহিমার উপলব্ধিতে সে জীবনকে সার্থক ও অর্থময় করে তুলতে চায়। যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মাঝে আপনার আত্মাকে জানে, সে-ই জানে সত্যকে। নিঃস্বার্থ সমাজসেবা মানুষের এক দুর্লভ গুণ। মানুষের জীবনে যদি মহৎ সেবাব্রতের পূর্ণ দীক্ষা থাকে, যদি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই মহাপ্রাণতার অঙ্গীকার, তবেই এই ধূলার ধরণীতে একদিন প্রেমের দেবতার হবে অভিষেক। আজ দিকে দিকে যেখানে প্রমত্তের রণসাজ, যেখানে কপটতা-ভণ্ডামির ছদ্মবেশ, যেখানে আত্মসর্বস্ব ধ্যানধারণায় মানুষ নিয়ত কুণ্ঠিত, যেখানে হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, সেই হিংস্র প্রলাপের মধ্যে এই সহায়-সম্বলহীন আর্ত, দুর্গতদের সেবাই যেন হয় সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।

Tuesday, May 4, 2021

অনুচ্ছেদ

গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ

প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের মানুষ তার চারপাশের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে জীবনযাপন করে আসছে। পরিবেশ কথাটির অর্থ হলো আমরা যে যেখানে থাকি তার চারপাশের জগৎ, অর্থাৎ গাছপালা, মাটি, পানি, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, প্রাণী, উদ্ভিদ ইত্যাদি মিলেই পরিবেশ। মানুষ আর পরিবেশের মধ্যে যতদিন সমন্বয় বিদ্যমান ছিল ততদিন মানুষের কোনো দুর্ভাবনা ছিল না। কিন্তু সভ্যতার বিকাশ আর মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।

ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নগরায়ণ, অপরিকল্পিতভাবে মিল-কারখানা স্থাপন, যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোয়া, অধিকমাত্রায় বৃক্ষনিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা, বনভূমি ধ্বংস ইতাদি কারণে প্রতিদিন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বাস্পশক্তি ও বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের মূলে রয়েছে দহন। এই দহনের ফলে বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সূর্যের ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় রশ্মি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে পারে বায়ুমণ্ডলে এমন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা স্বল্প দৈর্ঘ্য বিকিরণের জন্যে স্বচ্ছ কিন্তু লম্বা দৈর্ঘ্য বিকিরণ ধরে রেখে ভূপৃষ্ঠ এবং বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত করে তোলে। বায়ুমণ্ডলে পরিবেশ দূষণের ফলে যেসব গ্যাস জমছে তার অবর্তমানে লম্বা দৈর্ঘ্যের বিকিরণ মহাশূন্যে হারিয়ে যেতো। এসব গ্যাস হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি। এসব গ্যাস যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে তবে ২০১৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাতে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ ১.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বৃদ্ধির এই পরিমাণ মানব ইতিহাসের এক অভাবনীয় ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। কেননা এক ডিগ্রি তাপের কয়েক দশমাংশ উত্তাপ বৃদ্ধি বিশ্বের আবহাওয়ায় এক বিরাট পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এই গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে সাগরের তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাবে, ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, উপকূলমণ্ডল ও নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং বাড়বে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। এতে বিশ্বের বহুভূমি বন্যাকবলিত হবে আর ছড়িয়ে পড়বে লবণাক্ততা। পরিণামে শিল্পকারখানা, জনবসতি, কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষ এবং বনাঞ্চলের ওপর ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেবে। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের জন্যে। একুশ শতকের মাঝামাঝি আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বেড়ে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে অনুভূত হবে। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বলে বাংলাদেশে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাই এখন থেকেই পরিবেশ দূষণ রোধ করে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে।

অনুচ্ছেদ

 গ্রাম্যমেলা

মেলা হচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মেলা লোক সংস্কৃতিরই এক বিশেষ ধমনী। এই ধমনীতেই জীবনের স্পন্দন। এরই মধ্যে বাঙালী খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলার নামে সবার মন এক অভূতপূর্ব আনন্দের উচ্ছাসে ওঠে নেচে। মেলার আনন্দের স্মৃতি সকলের মনেই থাকে গভীরভাবে মুদ্রিত। মেলা পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও ভাব-সম্মিলনের সংযোগ সেতু। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রাম্য মেলার গুরুত্ব তাই অসীম। বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষে মেলার প্রচলন হলেও এখন গ্রামীণ-জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণত বছরের শেষে অথবা বছরের শুরুতে এই মেলা বসে অথবা বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষেও মেলার আায়োজন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই নানা ধরনের মেলার প্রচলন রয়েছে। স্থান বিশেষে রয়েছে কিছু বিখ্যাত মেলা। যা ঐ স্থানের নামেই সুপরিচিত

সাধারণত মেলা বসার জন্য হাট-বাজারের ন্যায় নির্দিষ্ট কোন স্থান নির্ধারিত থাকে না। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে খোলা মাঠে, মন্দির প্রাঙ্গনে, নদীর তীরে অথবা বড় বৃক্ষের নিচে গ্রাম্য মেলা বসতে দেখা যায়। পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব স্থানে মেলার আয়ােজন করা হয়। মেলার প্যানে সাময়িকভাবে দোকানপাট বসার মত চালা নির্মাণ করা হয়। মেলা শেষ হওয়ার পর এগুলো ভেঙে ফেলা হয়। বছরের শেষে মেলার আনন্দে আবারও মুখরিত হয়ে ওঠে মেলার সে স্থানে। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলাগুলোর কোনটি একদিন, কোনটি এক সপ্তাহ, কোনটি পনের দিন আবার কোন কোন মেলা এক মাসব্যাপী চলতে থাকে। আজকাল শুধু গ্রাম নয়, শহর বা আধা শহরেও মেলার আসর বসে। তবে গ্রামই মেলার উপযুক্ত পটভূমি। আমাদের দেশে গ্রামে সাধারণত ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পহেলা বৈশাখ, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বিজয়া দশমী, দশই মহরম, চৈত্র সংক্রান্তি এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মেলা বসে থাকে। তবে উপলক্ষ যাই হোক না কেন মেলা বাঙালি সমাজ ও মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের দিন। মেলায় সমাজের সর্ব শ্রেণীর মানুষ, ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকলেই এসে মিলিত হয়। বিভেদের পার্থক্য ভুলে গিয়ে সকলেই এক আনন্দের জোয়ারে গা ভাসায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম্য মেলা শুধু আনন্দ চিত্তের শান্তিই দেয় না, বিত্তের শক্তি যোগায়। মেলায় কৃষি ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের কামার-কুমার, তাঁতী, সুতারদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস বানানাের হিড়িক পড়ে যায়। তাই দেখা যাচ্ছে, মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উপার্জনের পথও প্রশস্ত হয়।

মেলাকে আশ্রয় করেই গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-উৎসের রুদ্ধ দুয়ার খোলে যায়। এর মধ্যেই সে খুঁজে পায় বেঁচে থাকার সার্থকতা। খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ। সত্যপীর, শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী, ওলাবিবি, সতী-মা এমনি কত লৌকিক দেবদেবী গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কত শত শতাব্দীর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ধর্মীয় আকুতির সঙ্গে এঁদের আত্মিক সম্পর্ক। এদের কেন্দ্র করে কত লোকগাথা, কত ব্রতকথা, পাঁচালী, ছড়া, গ্রাম্য সাহিত্য-সঙ্গীতের ধারা আজও চলে আসছে। মেলা গ্রামীণ জীবনের শুকনো খাতে নিয়ে আসে প্রবল আনন্দ-জোয়ার। সেই জোয়ারেই বাঙালীর চিত্তভূমি সিক্ত হয়েছে।

অনুচ্ছেদ

 শব্দদূষণ 

শব্দ বা আওয়াজ হলো ধ্বনি-তরঙ্গ। এটি মানুষের বাগ্যন্ত্র বা অন্য কোনো উৎস থেকে উৎপাদিত বা সৃষ্টি হয়ে আমাদের কর্ণকুহরে এসে পৌছায়। এসব শব্দ কখনো কখনো আমাদের জন্য ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, আর সেটিই হলো শব্দদূষণ।

পাখপাখালির ডাক, মৃদু শব্দ, সংগীতের সুর শ্রুতিমধুর, যানবাহনের হর্নের আওয়াজ, রেডিও-টেলিভিশনের উচ্চ শব্দ, কলকারখানার সাইরেন, মাইকের আওয়াজ, উডড়োজাহাজের শব্দ ইত্যাদি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ এ শব্দগুলো অতিমাত্রার ফলে শব্দদূষণ ঘটছে। শব্দদূষণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। শব্দদূষণের ফলে শিশু ও বড়দের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে মানুষ। মানসিক অবসাদগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগেরও সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চ শব্দযুক্ত শিল্পকারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তাদের প্রবণশক্তি ১০ বছরে অর্ধেক হ্রাস পায়। শব্দদূষণের ফলে নানা ধরনের মানসিক বিকার ও অসুখের সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশে আইন প্রণয়ন ও পালনের মাধ্যমে শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও তৃতীয় বিশ্বে এর প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমরা সচেতন হলে শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারি। আজকের দিনে শব্দদূষণ প্রতিকারে উদ্যোগ ও সচেতনতা অতীব প্রয়োজনীয়। সেই সাথে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।


অনুচ্ছেদ

 35.  শিক্ষা সফর

বৈচিত্র্যের সন্ধানী মানুষ কখনো স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না। নতুন আকর্ষণে মানুষ প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। দেশ সফর মানুষের জ্ঞান সঞ্চয়ের ও অবকাশ যাপনের একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। এতে অভিজ্ঞতা বাড়ে এবং হৃদয়ের প্রসার ঘটে। এই উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষাসফরের আয়োজন করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা বই-পুস্তক পাঠ করে দেশ-বিদেশের ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান ও বস্তুসমূহের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারে। কিন্তু নিজের চোখে দেখলে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ হয় অনেক বেশি।

বই পড়ে কোনো একটি স্থান ও বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ হয় না বলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ছাত্রদের শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা করেন। এর অন্যতম উদ্দেশ্য একাডেমিক প্রয়োজন মেটানো। কিন্তু শিক্ষা সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে, এটি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ভাবের আদান-প্রদান ঘটায়। ছাত্ররা জাতির মেরুদণ্ড, ছাত্রদের সুশিক্ষা দানের মধ্যে রয়েছে দেশ গড়ার কার্যকারিতা। আর হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণই সুশিক্ষার অন্যতম পন্থা যা শিক্ষা। সফরের মাধ্যমে সম্ভব। শিক্ষা শুধু বইয়ের কয়েকটা পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষার আলো সর্বত্রই বিচরণ করে। আর শিক্ষা সফর সেই আলোকে ছড়িয়ে দেয় উন্মুক্ত আকাশে। শিক্ষা সফরের মূল আনন্দ হলো প্রকৃতির আবার সৌন্দর্য্যকে প্রাণ খুলে অবলোকন করা। কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা এবং প্রকৃতির মাঝেই নিজেকে আবিষ্কার করা এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। ভ্রমণের আনন্দ একে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করার মাধ্যমে সেই অনুভূতি হয়ে উঠে আনন্দের মহাসমুদ্র। 

শুধু যে আনন্দই শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্য তা কিন্তু নয়। শিক্ষা সফরের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। শিক্ষা সফরের মাধ্যমে শিক্ষার্থী অনেক স্থান এবং ওই স্থানের জীবন যাপনের ধরণ এবং বিভিন্ন ধরণের সংস্কৃতির সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি পায়। শরীর এবং মননের বিকাশ ঘটে। পড়াশুনার একঘেমেয়ি দূর হয়। মন প্রফুল্ল থাকে যা পরবর্তীতে শিক্ষার্থীকে পূনরায় পড়াশুনায় উজ্জীবিত করে। সুতরাং শিক্ষা সফরের গুরুত্ব অত্যধিক ও অপরিসীম।

অনুচ্ছেদ

 মাদকাসক্তি

বিশ্বমাঝারে নানান আসক্তির মধ্যে মাদকাসক্তি অন্যতম। যেসব খাদ্য, পানীয় বস্তু সুস্থ মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়, জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে এবং নেশা সৃষ্টি করে সেগুলোকে আমরা মাদকদ্রব্য বলে থাকি। মাদক জাতীয় উপাদান ও ওষুধের ব্যবহারের প্রবণতাই মাদকাসক্তি।


মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বের মারাত্মক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণ গ্রহণ করা ও তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। বিভিন্ন কারণে মানুষ মাদকাসক্ত হয়। এর মধ্যে সঙ্গদোষ, কৌতূহল, পারিবারিক কলহ, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে যুবসমাজই মাদকাসক্তিতে সবচেয়ে বেশি আচ্ছন্ন। বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য চালু আছে। মদ, ভাং, গাঁজা, আফিম ইত্যাদি নেশা বহু প্রাচীনকালের। বর্তমানে মাদকদ্রব্য হিসাবে হেরোইন, মারিজুয়ানা, এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, হাসিস, মরফিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মাদকাসক্তির কারণে মানসিক ও শারীরিক শক্তি লোপ পেলে ব্যক্তির সামাজিক আচরণে কিছু বিকার দেখা যায়। মানুষের কর্মশক্তি লোপ পায়, আয়ু কমে যায়। মাদকাসক্তির প্রভাবে যুবক শ্রেণির নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। নেশাগ্রস্তদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। তারা স্বাভাবিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনকে বিসর্জন দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। মাদকাসক্তির ব্যক্তিগত দিক ছাড়াও এর আরও একটি ব্যবসায়িক দিক রয়েছে, যা বিশাল অপরাধ জগতের সাথে সম্পর্কিত। মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ মাদকদ্রব্যের চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের ১৭ ভাগ মানুষ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে। এর বিরুদ্ধে সচেতনতার পাশাপাশি এখনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগে আগামী প্রজন্মকে উপহার দিতে হবে একটি মাদকমুক্ত সমাজ।

অনুচ্ছেদ

 দেশপ্রেম

নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। নিজের দেশকে ভালোবাসে না এমন কে আছে? দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। সামাজিক মানুষের দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধই হলো দেশপ্রেম। মা, মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই দেশপ্রেমের মূল সত্য নিহিত। প্রত্যেক মানুষের দেহ মন বিশ্বাস আদর্শ সবকিছুই স্বদেশের বিভিন্ন উপাদান দ্বারা পুষ্ট।তাই সে দেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশকে ভালােবাসতে শুরু করে। এই ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম।


শুধু মুখে মুখে এই ভালোবাসার কথা বললেই দেশপ্রেম হয় না। চিন্তায়, কথায় ও কাজে দেশের জন্য যে ভালোবাসা প্রকাশ পায় সেটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। ফলে স্বদেশের জন্যে তার যে প্রেম তা কৃতজ্ঞতার, কর্তব্যের এবং দায়িত্বের। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মধ্যে কোনো সংকীর্ণ চিন্তা থাকে না। দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিই দেশপ্রেমিকের সর্বক্ষণের চিন্তা ও কর্মের বিষয়। দেশের স্বার্থকে তিনি সবকিছুর উর্ধে স্থান দিয়ে থাকেন। নিজের অহংকার, মেধা, প্রজ্ঞা ও গৌরব স্বদেশের জন্য নিবেদন করেন। দেশের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে দেশের মর্যাদা রক্ষা করেন। যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছেন তীতুমীর (Titumir), প্রীতিলতা (Pritilata Waddedar)। ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেছেন ক্ষুদিরাম (Khudiram Bose, সূর্য সেন (Surya Sen)। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শহীদ, রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার এবং বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-সংগ্রামে আত্ম-বিসর্জিত অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, লক্ষ লক্ষ মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অকুতোভয় সৈনিকদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি। দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল।


মানুষ জীবনে যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে পারে। নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মধ্যে দেশপ্রেম নিহিত। যদিও আমরা জন্মের পরেই দেশকে ভালোবাসতে শুরু করি, তদুপরি ছাত্রজীবন দেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট সময়। দেশপ্রেম হৃদয়ে থাকলে দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুই অতি আপন বলে মনে হয়। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ছাত্ররাও নানাভাবে দেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারে। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করতে হবে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। একটি মহৎ গুণ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দেশপ্রেম থাকা উচিত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কিছু না কিছু অবদান রাখা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য

অনুচ্ছেদ

   বিশ্বায়ন

বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। এটি সম্ভব হয়েছে বিশ্বায়নের কারণে। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রভাবকে বলা হয় বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন একটি বিশ্বব্যাপী ক্রিয়া। যুগে যুগে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দর্শন মানবসমাজ এবং রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট জীবনধারাকে প্রভাবিত করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের ফলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইউরোপে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে উৎপাদিত সেবা ও পণ্য এবং পুঁজির শুল্কবিহীন অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির জগতে প্রবেশ করে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগের যুগ বলা হলেও বাস্তবে তা খুবই কম পূরণ হয়েছে। বাজার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক হারে বিদেশি পণ্যে দেশের ব্যাপক বাজার ভরে যাচ্ছে। ফলে মার খায় দেশীয় পণ্য ও দেশীয় শিল্প। আমাদের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস তৈরি পােশাক খাতও আজ হুমকির সম্মুখীন। ২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর Multi Fiber Agreement বা MFA এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য রাষ্ট্রে এখন কোঠা সুবিধা রহিত হয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে, আমাদের কৃষিখাতও হুমকির মুখে। দেশীয় বীজের পরিবর্তে স্থান কাল করেছে বহুজাতিক কর্পোরেশন কর্তৃক সরবরাহকৃত বীজ। অপরদিকে, বিশ্বায়নের ফলে দেশীয় সংস্কৃতিতেও চলছে ব্যবস্থা। দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিবর্তে স্থান দখল করে নিচ্ছে আকাশ সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে দেশকে নিতে হলে শ্রম ব্যবস্থাপনার সহযােগিতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি এবং সুনির্দিষ্ট কল্যাণমুখী উদ্দেশ্যে শিল্প পরিচালনা করে আমাদের দেশীয় শিল্পে দক্ষতা সৃষ্টি করতে হবে। আর তা করতে পারলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটা হবে সাফল্যমণ্ডিত।

অনুচ্ছেদ

   শব্দদূষণ 

শব্দ বা আওয়াজ হলো ধ্বনি-তরঙ্গ। এটি মানুষের বাগ্যন্ত্র বা অন্য কোনো উৎস থেকে উৎপাদিত বা সৃষ্টি হয়ে আমাদের কর্ণকুহরে এসে পৌছায়। এসব শব্দ কখনো কখনো আমাদের জন্য ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, আর সেটিই হলো শব্দদূষণ।

পাখপাখালির ডাক, মৃদু শব্দ, সংগীতের সুর শ্রুতিমধুর, যানবাহনের হর্নের আওয়াজ, রেডিও-টেলিভিশনের উচ্চ শব্দ, কলকারখানার সাইরেন, মাইকের আওয়াজ, উড়োজাহাজের শব্দ ইত্যাদি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ এ শব্দগুলো অতিমাত্রার ফলে শব্দদূষণ ঘটছে। শব্দদূষণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। শব্দদূষণের ফলে শিশু ও বড়দের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে মানুষ। মানসিক অবসাদগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগেরও সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চ শব্দযুক্ত শিল্পকারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তাদের প্রবণশক্তি ১০ বছরে অর্ধেক হ্রাস পায়। শব্দদূষণের ফলে নানা ধরনের মানসিক বিকার ও অসুখের সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশে আইন প্রণয়ন ও পালনের মাধ্যমে শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও তৃতীয় বিশ্বে এর প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমরা সচেতন হলে শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারি। আজকের দিনে শব্দদূষণ প্রতিকারে উদ্যোগ ও সচেতনতা অতীব প্রয়োজনীয়। সেই সাথে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।