চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Thursday, May 6, 2021

রচনা

  দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান

 

      #         ভূমিকা;
#         বিজ্ঞানের উৎস;
#         রোজকার জীবনে বিজ্ঞানের বিবর্তন;
#         বিজ্ঞানের দৈনন্দিন প্রভাব;
#         চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান;
#         বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তি;
#         অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞান;
#         বিজ্ঞান বনাম মানুষ;
#         প্রযুক্তি বিজ্ঞান ও দারিদ্র;
#         বিজ্ঞানের অপকারিতা;
#         উপসংহার।

ভূমিকা: পৃথিবীতে যেইদিন থেকে মানবজাতির পথ চলা শুরু হয়েছে সেই দিন থেকেই মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে বিজ্ঞান অনস্বীকার্য প্রভাব রেখে গিয়েছে। মানুষ তার উন্নত বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানকে প্রতিনিয়ত প্রয়োগ করেছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। সুকৌশলে বানানো প্রস্তর যুগের অস্ত্রাদি থেকে শুরু করে মানবসভ্যতায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া আগুন; সবকিছুই বিজ্ঞানের দান।

এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই মানুষ আবিষ্কার করেছে চাকা, অট্টালিকা তথা উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করেছে। উন্নত বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে প্রয়োগমূলক বিজ্ঞানের সিঁড়ির ওপর ভর করেই মানুষ আজ সভ্যতার শিখরচুড়ায় অধিষ্ঠান করছে। আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনাকাল হিসেবে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পরবর্তী পর্বকে মোটামুটি চিহ্নিত করা যায়।

আজকের দিনে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আশ্চর্যকর আবিষ্কার মানুষের জীবনধারাকে প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে, বদলে দিচ্ছে মানসিকতাকেও। অসুস্থ মানুষ আজ আর রোগ নিরাময়ের জন্যে ওঝার কাছে ছুটে যায়না। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মন্দিরে মাথা ঠোকেনা। বিজ্ঞানের দানে আজ ভগবানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন চিকিৎসক। রাত্রির কালো অন্ধকারে আর মানুষ পথ হারায় না, রাত্রি এখন আলোকজ্জ্বল। প্রতিদিনের জীবনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্ত কিছুর মধ্যেই রয়েছে বিজ্ঞানের অবদান।

বিজ্ঞানের উৎস: বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ হল বিশেষ জ্ঞান। অর্থাৎ নামের ব্যাখ্যা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে পৃথিবীতে বিজ্ঞান অলৌকিক ইন্দ্রজাল কিংবা ভোজবাজির খেলা নয়। এ হলো বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর মধ্যে স্থিত বিভিন্ন উপাদানকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা। বিজ্ঞানের দান হিসেবে যে সমস্ত আবিষ্কার আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের নিয়ত সরলীকরণ করে চলেছে তার পেছনে রয়েছে মানুষের প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং নানান প্রাকৃতিক উপাদানের মেলবন্ধন। এই দুইই বিজ্ঞানের প্রকৃত উৎস। মানব সভ্যতায় বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু পাথরে পাথর ঘষে সেই আগুন আবিষ্কার থেকে। তারপর থেকেই মানবজগৎ তথা সমগ্র পৃথিবীর জীবকুল বিজ্ঞানের খারাপ-ভালো উভয়প্রকার ফল ভোগ করে আসছে।

রোজকার জীবনে বিজ্ঞানের বিবর্তন: সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে বিজ্ঞান অনস্বীকার্য অবদান রেখে চলেছে। সেই সময় প্রতিদিনকার খাবার সংগ্রহ থেকে শুরু করে আত্মরক্ষা আশ্রয় সবকিছুর জন্যই মানুষ সাধারণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর নির্ভর করত। সময় যত এগিয়েছে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ততই পরিবর্তন ঘটেছে। খাদ্য সংগ্রহ কথা আশ্রয়ের মত প্রাথমিক প্রয়োজন মিটিয়ে মানুষ বিজ্ঞানকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে জীবনের আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে।

আজকের যুগে মানুষ সেই প্রচেষ্টারই বহুমুখী পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে মাত্র। আজ আধুনিক জীবনের চরম উৎকর্ষের এবং অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের অবদানে আমাদের জীবন আজ পরিপূর্ণ। প্রতিদিনকার জীবনে আধুনিক বিজ্ঞানের এই ব্যবহারিক প্রয়োগ আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস তথা মননকেও আমূল বদলে দিচ্ছে। কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হলে আমাদের জীবন অচল হয়ে পড়ে।

শহর অঞ্চলের মানুষেরা মুহূর্তের জন্য নিজেদের জীবনকে ইন্টারনেটবিহীন ভাবতে পারে না। স্মার্ট ফোন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া মানুষ আজকাল নিজেকে অসহায় বলে মনে করে। তার খুব স্বাভাবিক কারণ হলো মানুষের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তথা সভ্যতা এই আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপাদানগুলির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার আমাদের জীবনকে কোন ধারায় নিয়ে চলেছে তা বলে শেষ করার মতো নয়।

বিজ্ঞানের দৈনন্দিন প্রভাব: সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর অ্যালার্ম, বিছানা ছেড়ে টুথ পেস্ট,গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না , অফিস যাওয়ার গাড়ী, কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর, মোবাইল, টেলিভিশন, বাস, ট্রেন, এরোপ্লেন সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞান। আমাদের জীবনকে সহজ থেকে আরো সহজতর এবং দ্রুত থেকে আরো দ্রুততর করে তোলার পথে বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। বিজ্ঞানহীন হয়ে মানব সভ্যতার অগ্রগতি এমনকি অস্তিত্ব রক্ষা; কোনটাই সম্ভব নয়। 

প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে সহজ সরল আরামদায়ক করে তুলেছে। অসহ্য গরমে তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, মানুষের সুবিদার্থে বিজ্ঞানীরা ঘুরিয়ে দিয়েছেন নদীর গতিপথ, উষ্ণ মরুকে তা করেছে শস্য শ্যামল। হাড় ভাঙা পরিশ্রমকে বিজ্ঞান অনেক সহজ করে দিয়েছে। আজকের কর্মব্যস্ত মানুষ বিজ্ঞান ছাড়া একপাও এগোতে পারে না।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: সভ্যতার সেই শুরুর দিন থেকেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান তার অবদান রেখে চলেছে। আর আজ প্রযুক্তি বিজ্ঞানের দানে চিকিৎসা ব্যবস্থায় চূড়ান্ত উন্নতি সাধিত হয়েছে। স্বভাবতই মানুষের গড় আয়ু আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগের প্রতিকারের জন্য মানুষ আজ ওঝার কাছে না দৌড়িয়ে হাসপাতালমুখী হয়েছে।

প্রতিনিয়ত গভীর গবেষণালব্ধ বিভিন্ন জীবনদায়ী ওষুধ মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে কৃত্রিম অক্সিজেন, ভেন্টিলেটরের মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আপৎকালীন মুহূর্তে মানুষের জীবন বাঁচিয়ে চলেছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলস্বরুপ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভ্যাকসিন নানাবিধ রোগকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে সাহায্য করেছে। সর্বোপরি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যাপক ব্যবহার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনেক বেশি সহজ এবং যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তি: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব আলোচনায় তথ্যপ্রযুক্তির উল্লেখ থাকবে না, এমনটা হতেই পারে না। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের সম্ভবত সবচেয়ে যুগান্তকারী দানটি হল তথ্যপ্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের প্রতিদিনকার জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছে। মানুষের সামাজিক, পারিবারিক তথা প্রশাসনিক জীবন সহ সর্বক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

আর এই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে বিজ্ঞানের দুই উল্লেখযোগ্য ফসল: কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা। জীবনধারণে অভ্যাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তথা মননের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাছাড়া এই তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থা লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।

অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: মানুষের জীবনে বিজ্ঞানের অবদান বলে শেষ করার মত নয়। পূর্ব উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলি তার অতি সামান্য কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। ওই উদাহরণগুলি বাদ দিয়ে মানুষ আজও খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষিক্ষেত্রে যেমন বিজ্ঞানের প্রয়োগ করে থাকে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শিল্প ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ হয়ে থাকে।

অন্যদিকে শিক্ষাও আজ সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠেছে। তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার সম্ভব হয়েছে। অনেক জটিল প্রক্রিয়ার অত্যন্ত সহজ সমাধান মানুষ করে ফেলছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে। বিজ্ঞান আজ দূরকে করেছে নিকট, সমগ্র বিশ্বকে বন্দী করেছে হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের দানে আঙ্গুলের একটিমাত্র ছোঁয়ায় পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের তথ্যও এক নিমেষে ভেসে উঠছে মানুষের চোখের সামনে।

বিজ্ঞান বনাম মানুষ: তবে বিজ্ঞানের প্রভাবে মানুষ আজ যন্ত্রমানবে পরিণত হয়েছে, তাকে অনুসরণ করে যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয় না বরং যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সময়ের মানুষ চালিত হয়। জীবনকে সহজ ও সুখের করে তোলার জন্য মানুষের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা তাকে নতুন নতুন আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পনেরোই যন্ত্রভিত্তিক জীবন আজ যান্ত্রিক জীবনে পরিণত হয়েছে।

ইলেকট্রনিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধনে রোবট ও কম্পিউটারের আবিষ্কার মানুষের জীবনধারার পটচিত্রকে আমুল বদলে দিয়েছে। ফলস্বরূপ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পরিণত হয়েছে যন্ত্রের আজ্ঞাবহ দাসানুদাসে। এক মুহুর্ত আধুনিক প্রযুক্তির প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া মানুষ আজ অত্যন্ত অসহায়, নিরুপায় বোধ করে।

প্রযুক্তি বিজ্ঞান ও দারিদ্র: প্রযুক্তি বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে সহজ ও সুখের করে তুলেছে এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে এমন সমূহ অগ্রগতি সত্ত্বেও বিজ্ঞান আজও পৃথিবী থেকে অভিশাপরূপি দারিদ্র্যকে নির্মূল করতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সহায়তা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ধনী-দরিদ্র্যের আর্থিক বৈষম্যের ব্যবধানকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলেছে।

তাছাড়া প্রযুক্তি বিজ্ঞানের নানান অভিনব আবিষ্কার উপভোগ করতে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। যেখানে আমাদের দেশের বহু মানুষ দারিদ্র সমস্যায় জর্জরিত সেখানে প্রযুক্তিগত এইসব অভিনব উপাদানের ব্যবহার, বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের নানান সুবিধা গুলো যেদিন গরীব মানুষদের কাছেও পৌঁছে যাবে সেদিনই আধুনিক বিজ্ঞানের দানে সভ্যতা সার্থক হয়ে উঠবে।

বিজ্ঞানের অপকারিতা: পৃথিবীতে সকল জিনিসেরই খারাপ ভালো উভয় দিকই বর্তমান। যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে গিয়ে আজ মানুষ দিনদিন শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ছে, ক্রমশ কমে যাচ্ছে মানুষের স্বনির্ভরতা। ফলে শরীরে নানান রোগ এসে বাসা বাঁধছে।

বিজ্ঞান হল বর্তমান মানুষের হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে সৎ অসৎ যেকোনো কাজেই ব্যবহার করা সম্ভব। বিজ্ঞানের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে প্রয়োগ কর্তার উপর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরমাণু শক্তি যেমন ব্যাপক মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনই এক মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে পারে সম্পূর্ণ পৃথিবীর জীবজগৎকে।

বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বাঁচানো যেমন সম্ভব, তেমনি সেই বিজ্ঞানেরই দানে কেবলমাত্র একটি বোতাম টিপে এক সম্পূর্ণ জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াও সম্ভব। মানুষের লোভ, হিংসা তথা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দিনদিন বিজ্ঞান নানান খারাপ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 উপসংহার: বিজ্ঞানের প্রাথমিক অবদানগুলি আজও সর্বস্তরের মানুষের কাছে সমান ভাবে পৌঁছায়নি। দারিদ্রতার কারনে কোটি কোটি মানুষের জীবন আজও বিজ্ঞানের আশীর্বাদশুন্য রয়ে গিয়েছে। যদিও প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার, ভালো রাস্তা বানিয়ে গ্রাম গুলির যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটানোর, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নয়নের।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রয়োজনের তুলনায় এই প্রচেষ্টা নিতান্তই অপ্রতুল এবং তা সারা পৃথিবী জুড়েই সত্য। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে সার্বিক প্রচেষ্টা। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে অস্ত্র তৈরি কিংবা মহাকাশ গবেষণার হেতু অন্তরীক্ষে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণের প্রয়োজন যেমন রয়েছে তেমনই প্রয়োজন রয়েছে মানুষের জীবনকে তৃণমূল স্তর থেকে বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তোলার।

বুদ্ধিমত্তার ইন্দ্রজাল এই বিজ্ঞান যেদিন ধ্বংসযজ্ঞকে পাশ কাটিয়ে সমগ্র মানবজাতির সার্বিক মানোন্নয়নে নিয়োজিত হবে সেই দিনই মানুষ লাভ করবে তার সভ্যতার পরম সার্থকতা।

--- সমাপ্ত ---

রচনা

  বৃক্ষরোপণ বা সামাজিক বনায়ণ

              রচনার সংকেত-

     #        ভূমিকা;
#        অরণ্য উচ্ছেদ;
#        বৃক্ষরোপণ তথা বনমহোৎসব;
#        বৃক্ষরোপণ অভিযান;
#        বনসংরক্ষণ;
#        অরণ্য ধ্বংসের প্রভাব এবং প্রতিকার;
#        অরন্যের পুনরুদ্ধার: আমাদের অঙ্গীকার;
#        উপসংহার।

ভূমিকা:  আধুনিক নগরজীবনে ক্লান্ত বিধ্বস্ত কবি একদিন ব্যাকুল হয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর। এ বিশ্বে সৃষ্টির আদি হল উদ্ভিদ। এই ধরীত্রির সৃষ্টিলগ্নে বিশ্বসংসার পরিপূর্ণ ছিল বৃক্ষরাজি দ্বারা গঠিত সুবিশাল অরণ্যে। কিন্তু কালের বিবর্তনে যখন সমগ্র প্রাণীকূল তথা মানুষের উদ্ভব ঘটে, তখন মানুষ নিজের প্রয়োজন হেতু পৃথিবীর বুক চিরে নির্বিচারে অরণ্যচ্ছেদন করে আপন সভ্যতার জয়যাত্রা অব্যাহত রাখে। সময়ের লহমায় পৃথিবী তথা সমগ্র জীবকুলের নিয়ম বদলাতে থাকে, বিশ্বজুড়ে মানবসভ্যতা সর্বশ্রেষ্ঠ মাত্রা পায়।

তবুও মানুষ এবং উদ্ভিদকুলের মধ্যে একটা সমতা বরাবর বজায় ছিল। কিন্তু মানুষের ভোগের বাসনার কোন অন্ত ছিল না কোনদিন। আদিম সেই নির্মম বাসনাই নবজাগরণ পরবর্তী তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের পর চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পৃথিবী জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে অসংখ্য নতুন নতুন নগর, কলকারখানা বন্দর আরো কত কি। আপন জৈবিক লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে পরিবেশকে নিজের ইচ্ছে মতন ব্যবহার ও শোষণ অব্যাহত থাকে।

অরণ্য উচ্ছেদ: শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, সৃষ্টির আদি ছিল অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের প্রায় সমগ্র অংশই ছিল আরণ্যাবৃত। সময় নাটকের নিয়ম অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সেই জনবসতির বিস্তার ও কৃষি জমি প্রসারের উদ্দেশ্যে বনভূমির বুক থেকে বৃক্ষ ছেদনের নির্মম খেলায় কোমর বেঁধে কুঠার ধরলো মানুষ।

হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত বনভূমি এই ভাবেই শেষ হতে থাকলো। এইখানেই অরণ্য ধ্বংসের শুরু। তারপর সময় যত এগিয়েছে মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার প্রসারের আকাঙ্ক্ষায় গড়ে তুলতে শুরু করেছিল নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা বন্দর। এরপর এসেছে আধুনিক নগর সভ্যতার যুগ।

এই যুগে মানুষ হয়ে উঠেছে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, মূল্যবোধহীন ভোগসর্বস্ব জীব। পরিবেশের ভারসাম্য কে সামান্যতম রেয়াত না করেই চলেছে অরণ্যধ্বংস। যার আধুনিকতম উদাহরণ দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য সম্পর্কে চূড়ান্ত অবহেলা, সেখানকার বিধ্বংসী দাবানল এবং প্রায় মনুষ্যসৃষ্ট ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়।

মোট বনভূমি বা অরণ্যের প্রায় অর্ধেক অংশ এভাবেই নির্বিচারে শেষ করে ফেলেছে মানুষ।শেষ পর্যন্ত যে অরণ্য পরিত্রাণ পেয়ে নিজের অস্তিত্বকে এখনো অব্দি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তার পরিমাণ হল পৃথিবীর মোট স্থলভাগের শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ।

বৃক্ষরোপণ তথা বনমহোৎসব: গাছ আমাদের একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু। গাছপালা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে অন্য কোনো জীবের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায়না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রত্যেকটি জীব প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আর বাস্তুতন্ত্রের অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রানীই  উদ্ভিদের সাথে জৈবিক আদান প্রদানের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে থাকে।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধুটির প্রতি মানুষের চূড়ান্ত এক অবহেলার রূপ লক্ষ্য করা যায়। সেজন্যই হয়তো সমগ্র পরিবেশ আজ সংকটের সম্মুখীন। একথা সত্য যে মানব সভ্যতার অগ্রগতি হেতু পরিমিত বৃক্ষছেদনের প্রয়োজন আছে, তবে সেই স্থানে নতুন বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তাও সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে।

কিন্তু চারা গাছ লাগানো নয়, শুধুমাত্র গাছ কাটার প্রতিই মানুষের মনোযোগ বেশি লক্ষ্য করা যায়। তাই নতুন গাছ লাগানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।আমাদের এই আধুনিক যন্ত্র পরিচালিত জীবনে বৃক্ষরোপনের প্রয়োজন একান্ত আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে। স্বাভাবিকভাবে এইযে বৃক্ষরোপনের উদ্যোগে মানুষের এত অবহেলা, তারই বিশেষ কার্যক্রম বনমহোৎসব নামে পরিচিত।

আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আশ্রমবাসীদের সঙ্গে নিয়ে বর্ষার দিনে বনমহোৎসব পালন করতেন। যদিও বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে।

তাই উক্ত বনোমহোৎসব আজ বিশ্বায়িত হয়ে এক আন্তর্জাতিক উৎসবের আকার ধারণ করেছে। আজকাল সরকারি ও বহু বেসরকারি উদ্যোগে তথা বনমহোৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

বৃক্ষরোপণ অভিযান: বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর সম্প্রসারণের জন্য দেশে বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রত্যেক বছর বৃক্ষরোপণ অভিযান  দুএক সপ্তাহ জুড়ে বা মাসব্যাপী চলে। এসময় বিনামূল্যে সাধারণ মানুষকে চারা গাছ দেওয়া হয় রোপন করবার জন্যে।

এছাড়াও প্রচার করা হয় বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা, গাছ লাগানো ও সংরক্ষণের সঠিক উপায়। নিঃসন্দেহে বলা যায় বৃক্ষরোপণ অভিযান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোগ গুলির মধ্যে একটি।

অরণ্যের আচ্ছাদনকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। তাই বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করার জন্য শুধুমাত্র সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলির উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। এসমস্ত উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ হয় ঠিকই, কিন্তু তা প্রতিনিয়ত হয়ে চলা বিশ্বব্যাপী অরণ্যছেদনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য।

এই ধরনের সংগঠিত উদ্যোগ মানুষকে নিয়মের গণ্ডিতে নিশ্চয়ই বেঁধে দিতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে তা কতখানি স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাব ফেলে সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর পরিবেশের বিষয়ে একমাত্র সার্বিক স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগই সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে। সেজন্য বৃক্ষরোপণের বিষয়ে সার্বিক সচেতনতা এবং সাধারণ উদ্যোগ গড়ে তোলার বিকল্প কিছু হতে পারে না।

বনসংরক্ষণ: বনসংরক্ষণ ব্যতীত বৃক্ষরোপণ একবারেই অর্থহীন। গাছ লাগানোর সাথে সাথে বনভূমিতে যেসব গাছ রয়েছে তাদের বাঁচিয়ে রাখাটাও মানুষেরই দায়িত্বের অঙ্গ। পৃথিবীকে দূষণমুক্ত সবুজ ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয় ,এর জন্য প্রথমে অনিয়ন্ত্রিত অরণ্যধ্বংস বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়াও, নতুন যে সমস্ত বৃক্ষচারা রোপন করা হচ্ছে সেইগুলি যাতে নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে সেদিকেও সচেতন নজর দেওয়া দরকার।

ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছি, আজও মানুষের ভোগ ও লোভের বাসনায় লাগাম টানা যায়নি। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে বহু মূল্যবান গাছ কেটে ফেলছে। এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের যত শীঘ্র সম্ভব সুসংগঠিত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

তদুপরি কোনো বিশেষ প্রয়োজনে একটি গাছ উচ্ছেদ করলে তার বদলে অন্তত দশটি চারা গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রেও শুধুমাত্র সরকারি বা বেসরকারি সংগঠিত উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। স্বতঃস্ফূর্ত সার্বিক উদ্যোগ সচেতনতাই বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দেবে এবং বৃক্ষরোপণের প্রকৃত উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে।

অরণ্য ধ্বংসের প্রভাব এবং প্রতিকার: শোষণের হতাশায় পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাসে স্বাভাবিকভাবেই জল স্থল সমগ্র আবহাওয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দূষণের বীজাণু। জলবায়ু হয়ে ওঠে বিষাক্ত। দূষিত এই পরিবেশেই মানুষ প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে কাজের সন্ধানে,আশ্রয়ের আশায়, প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে _এ যেন অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা, কে কার আগে পৌঁছাবে তারই কলরব। আর অন্যদিকে এই ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে দূষিত পরিবেশে নিজের মধ্যেই নিজের মৃত্যুবীজ মানুষ বুনে দিয়ে যাচ্ছে অচিরেই।

এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ, সবুজ প্রান্তর, বনরাজির স্নিগ্ধ আচ্ছাদন। একথা আজ পৃথিবীর যেকোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই অনুধাবন করতে পারেন খুব সহজেই।

দূষণ প্রতিকার করতে ও সুন্দর শ্যামল পরিবেশ গড়ে তুলতে বনসংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেজন্যেই আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের এত গুরুত্ব, এত আলোচনা, এত সম্মান।

বন সংরক্ষণ তথা বনসৃজন এর উদ্দেশ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অবশ্যপালনীয় কিছু কর্তব্য:

  v  অরণ্যের অবাধ ও যথেচ্ছ উচ্ছেদ নিবারণ।
v  অপরিণত বৃক্ষ ছেদন বন্ধ করা।
v  দাবানলের হাত থেকে বন জঙ্গলকে রক্ষা হেতু উদ্যোগ গ্রহণ করা।
v  অরণ্য গবেষণার প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা করা।
v  যথেচ্ছ পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা।
v  তৃণমূল স্তর থেকে বৃক্ষরোপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। 
v  রোপন করা চারা গাছের সংরক্ষণ।
v  বনসৃজন ও বন সংরক্ষণের ব্যাপারে স্থানীয় মানুষের যোগদানে উৎসাহ দেওয়া।
v  প্রাথমিক মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবেশ শিক্ষার ব্যাপক প্রচার।
v 
বনসৃজন এবং বন সংরক্ষনের জন্য সার্বিক স্বতস্ফূর্ত সাধারণ উদ্যোগ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সমাজের সর্বস্তরে সংশ্লিষ্ট বিষয় ভিত্তিক সচেতনতার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার।

অরন্যের পুনরুদ্ধার: আমাদের অঙ্গীকার: বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের এই মহাযজ্ঞে যদি আমরা সফল হই তাহলে হয়তো আবার কোন দিন বীজাণু মুক্ত স্নিগ্ধ বাতাসে আমাদের কোন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্বাস নিতে পারবে। হয়তো আমরা সত্যিই এ পৃথিবীর জীবকুলকে এক অমোঘ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো।

আবারো এ পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদকূল প্রকৃতির নিয়মে পারস্পারিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরম শান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। তাই আজ পরিবেশের এই সংকট কালে দূর ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্নকে চোখে রেখে সমগ্র মানবজাতির অঙ্গীকার হোক পরিবেশ রক্ষা।কবির ভাষায়- 

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

উপসংহার: আধুনিক যন্ত্র পরিচালিত জীবনের কলুষিত পরিবেশ মানুষকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় আরণ্যক সভ্যতার উদার প্রশান্ত জীবনের কথা। কিন্তু এই আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক নগরজীবন ত্যাগ করে অরণ্যের যুগে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মানুষের পক্ষে নিতান্তই এক আকাশ কুসুম কল্পনা। পাশাপাশি একথাও সত্য যে পরিমিত অরণ্য ব্যতীত প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষাও কোনভাবে সম্ভব নয়। সভ্যতার অগ্রগতির বীজাণু যখন সেই সভ্যতারই গলা টিপে ধরতে চাইছে, তখন একমাত্র মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুই পারে বিশ্ব সংসারকে এই চূড়ান্ত সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে। সেজন্য নিজের স্বার্থেই, মানবকূলকে আজ শামিল হতে হবে পৃথিবীর ফুসফুস কে পুনরায় সুস্থ করে তোলবার উদ্যোগে।

--- সমাপ্ত ---

Wednesday, May 5, 2021

রচনা

 দেশ ও জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা                 

 রচনা সংকেত

      v  ভূমিকা;
v  ছাত্রসমাজ তারুণ্যের উজ্জ্বল দীপ্তি; 
v  অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়;
v  দেশ ও জাতির সমস্যা ও ছাত্রসমাজের ভূমিকা;
v  বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্র;
Ø  ক. দেশপ্রেম;
Ø  খ. ছাত্রসমাজ ও রাজনীতি;
Ø  গ. নিরক্ষরতা দূরীকরণ;
Ø  ঘ. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে; 
Ø  ঙ. নৈতিক অবয় রোধ ও রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা;
Ø  চ. সন্ত্রাস নিরসনে;
Ø  ছ. বেকারত্ব নিরসনে; 
Ø  জ. কৃষি ক্ষেত্রে;
Ø  ঝ. সাংস্কৃতিক অবদান;
v উপসংহার।

 ১। ভূমিকা: জ্ঞানশক্তি ও তারুণ্যশক্তি এই দুই শক্তির সমন্বয় করে ছাত্রসমাজ দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে । আজকের ছাত্ররাই জাতির সম্ভাবনাময় প্রজন্ম ।ছাত্রজীবন হলো মানবজীবন গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে "Student life is seedtime of life" অর্থাৎ জীবনের বীজ বপনের সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন। প্রকৃতপক্ষে, মানব চরিত্রের মহৎ গুণাবলীগুলো আয়ত্ত করার উপযুক্ত সময় এই ছাত্রজীবন। কেবলমাত্র অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের একমাত্র কর্তব্য হতে পারে না বরং একজন ছাত্রের অধ্যয়নের পাশাপাশি নিজেকে মহৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আরো অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়। দেশ ও জাতির উন্নতির লক্ষ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্রদের সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন অপরিহার্য।

আমরা রচি ভালবাসার / আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস / আকাশ ছায়াপথ।  -কাজী নজরুল ইসলাম।

২। ছাত্রসমাজ তারুণ্যের উজ্জ্বল দীপ্তি:  ছাত্রসমাজ চিরকালই নবশক্তির উদ্বোধক হিসেবে কাজ করেছে । তাদের চোখে থাকে জ্ঞানের আলো, বুকে থাকে স্বপ্নময় ভবিষ্যতের অগ্নিমন্ত্র । অর্জিত জ্ঞানের আলো নিয়ে তারা দেশ ও সমাজের দিকে তাকায় । তাদের দেশগঠনমূলক ভূমিকা ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত । ছাত্রসমাজ রচনা করেছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস । বায়ান্নর ভাষা - আন্দোলনে এ দেশের ছাত্রসমাজের রয়েছে অবিস্মরণীয় অবদান । ঊনসত্তরের গণ - অভ্যুত্থান , একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ , নব্বইয়ের গণ - আন্দোলনে ছাত্রসমাজই পালন করেছে মুখ্য ভূমিকা । রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে এ দেশের ছাত্রসমাজ জনগণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে । বুকের রক্ত দিয়ে রফিক , শফিক , সালাম , বরকত যে বাংলাভাষার নাম লিখেছিল , তা আজ স্বমহিমায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত । 

৩। অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়:  বলা হয়- ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ অর্থাৎ অধ্যয়নই হচ্ছে ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। দেশ ও জাতি গঠনে অংশ নিতে হলে ছাত্রদের উচিত কঠোর অধ্যবসায়ে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা। দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে গোটা ছাত্রসমাজকে উপযুক্ত এবং সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিরক্ষর, শ্রমবিমুখ, অলস জনগোষ্ঠী কখনোই জাতিগঠনে সহায়ক শক্তি হতে পারে না বরং জাতির জন্য তারা বোঝা স্বরূপ। একটি দেশের সাফল্যের প্রথম শর্ত, সেই জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং পরবর্তী শর্ত, কঠোর ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী করে গড়ে তোলা। আর তাই ছাত্রদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব নিজেকে পরবর্তী কর্মজীবনের জন্য যোগ্য করে তৈরি করা এবং নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে দেশগঠনে অংশ নেয়া।

৪। দেশ ও জাতির সমস্যা ও ছাত্রসমাজের ভূমিকা:  ছাত্ররা সাধারণত অর্থনৈতিক বা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকে না । বন্ধনহীন মুক্তজীবন আর খোলা চোখ নিয়ে তাকায় বলে , তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ত্রুটিগুলো সহজে দেখতে পায় । চিহ্নিত করতে পারে সমস্যার কারণ এবং সমাধানের উপায়ও তারা খুঁজে বের করতে পারে । লোভ বা স্বার্থপরতার কাছে পরাজিত না হয়ে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে তারা কাজ করতে পারে । ছাত্রসমাজ মানেই সংঘবদ্ধ একটা শক্তি । এই সংঘবদ্ধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশগঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব । প্রচলিত ধারার নষ্ট রাজনীতি কখনো কখনো ছাত্রসমাজকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করছে । কলুষিত করছে ছাত্রসমাজকে । ছাত্রসমাজের গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করার স্বার্থেই ওই নষ্ট রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে । ছাত্রসমাজকে কাজ করতে হবে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে , অপরিসীম দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে । মনে রাখতে হবে , এ দেশের প্রত্যেকটি ছাত্র এক - একজন সূর্যসন্তান । দেশমাতৃকার সেবা - শক্তির প্রতীক । 

৫। বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্র: সমাজ, দেশ ও জাতির সমস্যাসমূহ দূর করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশ গঠনের সুমহান কার্যক্রম। এসব সমস্যা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন দেশপ্রেম।

ক. দেশপ্রেম: একটি মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল তার দেশপ্রেম। জ্ঞানার্জনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ছাত্রের মাঝে উপ্ত হয় সেবার আদর্শ, দেশপ্রেমের ক্ষুদ্র বীজ যা তার পরবর্তী কর্মবহুল-জীবনে ধারণ করে বিশাল মহীরূহের আকার। বাস্তবজ্ঞানের আলোকে দেশের কর্তব্যের আহ্বানে ছাত্রদলই পারে দেশপ্রেমের আদর্শে সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে। দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে এবং স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বছরগুলোর ভাষা আন্দোলনে এ দেশের ছাত্রসমাজ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে মহান আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা আজও ইতিহাস হয়ে আছে। দেশের ছাত্রসমাজই পারে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হয়ে এবং সেই সাথে দেশের সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মহান ঐক্য ও সংহতির পক্ষপাতহীন মন্ত্রবাণী।

খ. ছাত্রসমাজ ও রাজনীতি: মহাত্মা গান্ধী বলেছেন- "The Students are the future leaders of the country who could fulfill country's hopes being capable." উপমহাদেশীয় রাজনীতির অঙ্গনের একটা বড় জায়গা দখল করে আছে ছাত্ররা। এ অঞ্চলের বড় বড় আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রামগুলোর পরিচালনা করেছে মূলত ছাত্ররাই। যখনই কোনো অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে তখনই দেশ ও জাতির স্বার্থে ছাত্ররাই প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ গঠনের পেছনে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে এ দেশের ছাত্ররাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, সর্বোপরি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রসমাজ। যদিও বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে তবু ইতিহাসে এর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

গ. নিরক্ষরতা দূরীকরণ: দেশের মূল সমস্যাগুলোর অন্যতম সমস্যা নিরক্ষরতা। এর অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার কাজে ছাত্রসমাজের ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। একজন শিক্ষিত ছাত্র তার পরিবারের ভেতরে যেমন শিক্ষার আলো ছড়াতে পারে, তেমনি তার প্রতিবেশী নিরক্ষরদের মধ্যেও জ্বালাতে পারে জ্ঞানের প্রদীপ। সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ যদি নিজ নিজ এলাকায় নিরক্ষরদের মধ্যেও জ্বালাতে পারে জ্ঞানের প্রদীপ। সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ যদি নিজ নিজ এলাকায় নিরক্ষরতা দূরীকরণে ব্রতী হয়, তা হলে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা অনেক সহজহর হতে পারে।

ঘ. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেশের অধিকাংশ মানুষ অসচেতন। ছাত্রসমাজ এ ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে সবচেয়ে বেশি। কেননা, ছাত্রদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত উঁচু ধারণা পোষণ করে। ফলে ছাত্রদের যেকোন পরামর্শই তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে। সুতরাং, এ বিবেচনায় ছাত্রসমাজ নিজ নিজ এলাকার জনসাধারণকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানদান ও জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ফলে জনসংখ্যার অভিশাপ থেকে দেশ হতে পারে সম্পূর্ণ মুক্ত।

ঙ. নৈতিক অবয় রোধ ও রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা: ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের বহু অন্যায় উচ্ছেদ করে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। অতীত ইতিহাসে এর একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। আর আজকের ছাত্রই আগামীদিনের রাষ্ট্র পরিচালনার এক একটি অংশ। সুতরাং, ছাত্ররা যদি ঘুষ-দুর্নীতিসহ সকল প্রকার নৈতিক অবয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেরাও সততার অনুশীলন করে, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হতে পারে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ।

চ. সন্ত্রাস নিরসনে:  শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস আজ দেশ গড়ার পথে এক মারাক্তক অন্তরায় হয়ে আছে। সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ আজ বিনষ্ট হতে চলেছে। শিাঙ্গনে সন্ত্রাস নিরসনে সরকারি উদ্যোগ যেমন প্রয়োজন, ততোধিক প্রয়োজন ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা।

ছ. বেকারত্ব নিরসনে: কর্মসংস্থানের অভাবে বা বেকারত্ব বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির হথে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে এক বড় সমস্যা। ছাত্রসমাজ যদি নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের পন্থা উদ্ভাবন করতে পারে, তা হলে বেকারত্বের অভিশাপ অনেকখানি দূর হবে।

জ. কৃষি ক্ষেত্রে: উচ্চশিতি হলে কৃষিকাজ করা যাবে না, এমন প্রাচীন ধারণা ত্যাগ করা গেলে ছাত্রসমাজ উৎপাদন কর্মকান্ডে রাখতে পারে বিপুল অবদান। যেমন- কৃষি, মৎস্য ছাত্র, পশু, হাঁসমুরগির খামার, বাগান করা, গাছপালা রোপণ ইত্যাদি আর্থিক উন্নয়নমূলক কাজে তথা আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে ছাত্রসমাজই দেশকে গড়ে তুলতে সক্ষম।

ঝ. সাংস্কৃতিক অবদান: একটি দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জাতীয় পরিচয় তুলে ধরতে ছাত্রসমাজ সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যথা: কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে তারা বিশ্বের বুকে দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পারে।

৬। উপসংহার:  ছাত্রসমাজ হচ্ছে সংঘবদ্ধ শক্তিতে বলীয়ান । সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম থাকলে তারা দেশের কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে । দেশের অগ্রগতি ও জাতির প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষা পূরণে ছাত্রসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে ।

                                                                   --- সমাপ্ত ---

রচনা

 দেশ গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

রচনা সংকেত

  Ø  ভূমিকা;
Ø  আমাদের ছাত্রসমাজ;
Ø  ছাত্রসমাজে সুপ্ত প্রতিভা;
Ø  দেশের ধারণা;
Ø  ছাত্র সমাজ ও দেশের সম্পর্ক;
Ø  অনন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও দেশের উন্নতি;
Ø  বর্তমানের ছাত্র, ভবিষ্যতের দেশনেতা;
Ø  বিশ্বে দেশগঠনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ছাত্রসমাজ;
Ø  উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশ ও ছাত্রসমাজ ও
Ø  উপসংহার।


ভূমিকা: মানব সভ্যতার সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে ভিত্তি করে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে আলাদা আলাদা সমাজ, যা ইতিহাসে পরিণতি পেয়েছে রাষ্ট্র বা দেশ হিসেবে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত প্রখর বুদ্ধিমত্তার দ্বারা প্রতিটি সমাজ তথা দেশের ব্যাপক ও বহুমুখী অগ্রগতির মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে সমগ্র মানব সভ্যতা অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে। এইসকল সমাজ তথা দেশের উন্নতির পেছনে কাজ করে অসংখ্য ছোট-বড় বিষয়। এই অসংখ্য ভিন্নধর্মী উপাদান একত্রিত হয়েই একটি উন্নত রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই কল দেশ গঠনকারী শক্তিগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সংশ্লিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রের ছাত্রসমাজের ভূমিকা। যেকোনো সমাজ তথা বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক বিষয়ের ছাত্র সমাজের সক্রিয়  অংশগ্রহণ। এই অংশগ্রহণ ছাড়া কোনদিনই একটি দেশ অগ্রগতির কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারে না। 

আমাদের ছাত্রসমাজ: কোন একটি দেশের গঠনে ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে বোঝা প্রয়োজন, ছাত্রসমাজের মূলগত চরিত্র আসলে কি! পৃথিবীতে সমাজ, সংস্কৃতি বা দেশ যতই ভিন্ন প্রকৃতির হোক প্রতিটি জায়গার ছাত্র সমাজের মধ্যে কিছু মৌলিক চরিত্র লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ছাত্র সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অফুরন্ত প্রাণশক্তির কথা।

বয়স এবং মানসিকতায় তরুণ হওয়ার কারণে ছাত্রসমাজ অদম্য প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ থাকে। এই প্রানশক্তির মাধ্যমে তাদের মনের অন্তঃস্থলে জাগরিত তরুণ দেশপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট সমাজ তথা দেশের গঠনমূলক কার্যক্রমে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে চায়। কখনো কখনো তরুণ বয়সের অনর্থক আবেগপ্রবণতা তাদেরকে সিদ্ধান্তগত দিক থেকে ভুল পথে চালিত করলেও দেশ গঠনের ক্ষেত্রে এই ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণের ভূমিকা কখনোই অস্বীকার করা যায় না।

ছাত্রসমাজে সুপ্ত প্রতিভা: দেশ গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা কেন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তরে অনিবার্যভাবে উঠে আসে ছাত্র সমাজের মধ্যে সুপ্ত ব্যাপক প্রতিভা সম্পর্কিত আলোচনা। কোন সমাজ বা দেশ গঠিত হয় অদম্য প্রতিভাময় সম্ভাবনা দ্বারা। সেই সকল গঠনমূলক প্রতিভা সুপ্ত থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের ছাত্র সমাজের মধ্যে। সমাজের এই অংশ হলো ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনার পরম আধার।

বর্তমানে যে সকল মানুষ দেশের উন্নতির পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে, অতীতে একদিন তারাও সাধারণ ছাত্র ছিল। তাই একইভাবে আজ যারা সাধারণ ছাত্র হিসেবে দিনযাপন করছে কাল তারাই দেশকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছাত্রাবস্থাতেই মানুষ নিজের অন্তরের সুপ্ত প্রতিভাকে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে শেখে। সেই সম্ভাবনা ভবিষ্যতে পরিণতি পায় দেশ গঠনে। 

দেশের ধারণা: সমাজতত্ত্বের একটি অতি জনপ্রিয় বিতর্ক হল দেশের প্রকৃত ধারণা আসলে কি! এই নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানান মুনির নানান মত। তবে এই প্রতিবেদনে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল ছাত্র সমাজের মধ্যে দেশের ধারণা কিভাবে পরিণতি পায়। সাধারণভাবে বলা যায় কোন একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতার গণ্ডিকেই আধুনিককালে দেশ বলে অভিহিত করা হয়।

আমাদের ছাত্রসমাজ স্বভাবতই আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। সে কারণে দেশের এই তাত্ত্বিক সংজ্ঞা তাদের কাছে নেহাতই তত্ত্বরূপে পরিণতি পায় না। বরং বড় হয়ে ওঠার পথে দেশের তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ছাত্র সমাজের কাছে ব্যক্তিগত আবেগের বিষয় হয়ে ওঠে। এই আবেগের বশবর্তি হয়ে অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছাত্রসমাজ যেকোনো মূল্যে দেশের সেবা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে।

ছাত্র সমাজ ও দেশের সম্পর্ক: দেশ এবং ছাত্র সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। মানব সভ্যতার এই দুই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। ছাত্রসমাজ একদিকে যেমন দেশীয় সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে শিক্ষার উপাদান সংগ্রহ করে জীবনে আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে যায়। তেমনি দেশও সমৃদ্ধি পরম আশা নিয়ে এই ছাত্র সমাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেশের মহান ছত্রছায়া ভিন্ন ছাত্রসমাজ যেমন অস্তিত্বশীল থাকতে পারেনা, তেমনি ছাত্রসমাজের কাঁধে ভর না করে কোন সমাজের অগ্রগতির চাকাও সচল থাকতে পারে না। সেকারণে সভ্যতার প্রয়োজনে ছাত্র সমাজ এবং দেশ একে অপরের ওপর পারস্পারিক নির্ভরতার দ্বারা অগ্রগতির চাকাকে সচল রাখে।

অনন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও দেশের উন্নতি: ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রতিভার ব্যাপক সংমিশ্রনের ফলে শারীরিকভাবে এই সমাজের মধ্যে নিহিত থাকে অনন্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনার ওপর ভর করেই সমগ্র সভ্যতা ভবিষ্যতে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষী আছে পৃথিবীতে যত উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তাতে সবথেকে বেশি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে ছাত্রসমাজের মধ্য থেকেই। এই ছাত্রসমাজই নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা দ্বারা বিভিন্ন উদ্ভাবনের সৃষ্টির মাধ্যমে নানা সময়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই ছাত্র সমাজের মধ্যে থেকেই উঠে আসে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী, সৈনিক, প্রশাসক কিংবা আদর্শ শিক্ষকরা। তারা ছাত্রাবস্থায় অর্জিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সার্বিকভাবে দেশকে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

বর্তমানের ছাত্র, ভবিষ্যতের দেশনেতা: দেশের সার্বিক অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞানী, সৈনিক, শিক্ষক, প্রশাসক প্রমুখদের প্রয়োজন থাকলেও যার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের সকল উদ্যোগ দেশের উন্নতিতে সার্থকভাবে বিকশিত হয় তিনি হলেন একজন রাষ্ট্রনেতা। রাষ্ট্রনেতা কোনদিন হঠাৎ করে তৈরি হতে পারে না। ছাত্রাবস্থায় থেকে নিজের অন্তঃস্থলে অপার দেশপ্রেম ও জাতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে ধীরে ধীরে দেশের জন্য কাজ করতে করতে একজন দেশ নেতা গড়ে ওঠে। যে ছাত্র বর্তমানে স্কুল কিংবা কলেজের কোন নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষক কিংবা কর্তৃপক্ষের সাথে বিতর্ক করে চলেছে, সেই ছাত্রই হয়তো কোন নিজের দেশের জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে একদিন বক্তব্য রাখবে কোনো এক আন্তর্জাতিক মঞ্চে। ছাত্র সমাজের মধ্যেকার দেশপ্রেমের চূড়ান্ত বিকশিত ও পরিণত হল একজন সার্থক রাষ্ট্রনেতা।

বিশ্বে দেশগঠনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ছাত্রসমাজ: আধুনিক যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজ দেশ গঠনের পথে নানান বাধা অতিক্রম করার জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর উদাহরণ আমরা বিংশ শতাব্দী থেকেই বারবার দেখতে পেয়েছি সমগ্র বিশ্বজুড়ে। কখনো দেখেছি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানিয়ে ছাত্র সমাজে ব্যাপক মিছিল; কখনো দেখা গেছে পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতায় শিহরিত হবা ছাত্রসমাজের শান্তি মিছিল। আবার কখনো এই দূষিত বিশ্বে বিজ্ঞানীদের বারংবার আবেদন সত্বেও সাধারণ মানুষ যখন প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে এগিয়ে আসছে না, তখন ছাত্রসমাজকে দেখা গিয়েছে পরিবেশের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে ছাত্র সমাজ বৃহত্তর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইউরোপের সুইডেনের পরিবেশ কর্মী স্কুলপড়ুয়া গ্রেটা থুনবার্গ এর কথা তো বর্তমানে বিশ্ব বিদিত।

উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশ ও ছাত্রসমাজ: ভারতীয় উপমহাদেশে ছাত্র সমাজ ও দেশের এক অত্যন্ত গূঢ় সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান রয়েছে। অতীতকালে যখন ভারতের প্রতিটি ঘর থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছাত্র জীবন কাটানোর উদ্দেশ্যে গুরুগৃহে গমন করত, তখন থেকেই দেশের সাথে তাদের নাড়ির টান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বারা এই প্রতিভাবান ছাত্র সমাজকে শিক্ষিত করে তুলে তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা হতো ঐতিহ্যগত আবেগ। ছাত্রাবস্থা থেকেই দেশের বিভিন্ন গঠনমূলক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের নিদর্শন এই উপমহাদেশে রয়েছে। ছাত্র সমাজের এই প্রবণতা একইভাবে বর্তমান রয়েছে আধুনিক যুগেও। এই প্রসঙ্গে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বহু ক্ষেত্রে উপমহাদেশের বৃহত্তর আন্দোলনগুলিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এদেশের ছাত্র সমাজ। তাছাড়া স্বাধীনতার পরেও বহু গঠনমূলক গণ আন্দোলন, জাতীয় স্বার্থমূলক নানা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য দরবার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজের ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে সুষ্ঠু যানজট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দাবিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

উপসংহার: সমাজ যদি একটি শরীর স্বরূপ হয়, ছাত্রসমাজ তাহলে সেই শরীরের ডান হাত। জাতীয় উন্নয়ন মূলক যে কোন প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ছাত্র সমাজকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। সে কারণে কোন দেশের ছাত্র সমাজকে যদি অক্ষম করে রাখা হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে সেই দেশের মূল চালিকাশক্তিই স্তব্ধ হয়ে পড়বে। তাই ছাত্রসমাজকে জাতীয় সংস্কৃতির সকল নির্যাস দিয়ে স্বাধীন মনে  প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দ্বারা মৌলিক গঠনমূলক কর্মসূচি রূপায়ণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

রচনা


 জনসেবা

     সংকেত

  v  ভূমিকা;
v  জনসেবার অর্থ;
v  জনসেবার বৈশিষ্ট্য;
v  জনসেবার ক্ষেত্র;
v  জনসেবার পদ্ধতি;
v  জনসেবার মানসিকতা অর্জনে সহায়তা;
v  জনসেবা যুগে যুগে;
v  জনসেবা ও ধর্মীয় চেতনা;
v  জনসেবার গুরুত্ব;
v  জনসেবার পদ্ধতি ও জনসেবার চেতনা;
v  সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল;
v  উপসংহার।

ভূমিকা:

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার চেয়ে সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

সকলের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনধারণ এবং সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ানোর মধ্যেই জীবনের যথার্থ সার্থকতা নিহিত। নিজের স্বার্থের জন্যেই কেবল জীবন নয়। এ প্রসঙ্গে ডা. লুৎফর রহমান বলেন: প্রকৃত সুখ কোথায়? পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সুখটুকু ভাগ করে নেওয়াতে কি সত্যিকারের সুখ আছে? আত্মার সাত্ত্বিক তৃপ্তির কাছে জড় দেহের ভোগ সুখের মূল্য কিছুই না। যতদিন না মানুষ পরকে সুখ দিতে আনন্দবোধ করবে ততদিন তার যথার্থ কল্যাণ নাই। মানুষ সমাজবদ্ধ, সহানুভূতিশীল জীব বলেই আত্মস্বার্থে মগ্ন থাকা তার স্বভাব-বিরুদ্ধ। মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ হয় না। চাই মনুষ্যত্ব অর্জনের দীক্ষা। জনসেবা সামাজিক মানুষের সেই দীক্ষার যথার্থ মন্ত্র। সমাজের সহায় সাহায্যহীন সর্বহারা হতাশাগ্রস্তকে প্রাণবন্ত করে তােলাই মানুষের ধর্ম। আর তাই নিজের স্বার্থত্যাগ করে অপরের সেবায় আত্মনিয়োগ করার নামই জনসেবা।

জনসেবার অর্থ: জনসেবা কথাটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। এর দ্বারা শুধু আর্ত-পীড়িত, দুঃখী-দরিদ্রকে সাহায্য করা বুঝায় না বরং সকল মানুষের কল্যাণ সাধনকেও বুঝিয়ে থাকে। মানুষমাত্রই সামাজিক জীব। একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভেতরে বাইরে এক অদৃশ্য যোগসূত্রে গ্রথিত। সমাজস্থ মানুষের কল্যাণে যেকোনো কাজই জনসেবা হিসেবে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে কবি কামিনী রায়ের কবিতার চরণ দুটি স্মরণযোগ্য - 

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

জনসেবার বৈশিষ্ট্য: বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপকার করার নামই জনসেবা। Ruskin বলেন, 'There are three kinds of duties- duties towards God, duties towards parents and duties towards mankind.' মানুষ স্বভাবতই স্বার্থ ত্যাগ করতে চায় না। এ কারণে নিজের মঙ্গলকে লক্ষ করে অপরের মঙ্গল করার নামই জনসেবা। মানুষ সামাজিক জীব, সে কখনোই একা বাস করতে পারে না। সকলকে নিয়েই তার জীবন। কেননা সে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে পরোপকারের মহান ব্রতে মানুষের মন উদ্দীপ্ত হয়। পরোপকারের মাধ্যমেই সে আনন্দ লাভ করে। আর তখন সমাজজীবন হয়ে ওঠে সুন্দর। স্বার্থমগ্নতা মনুষ্যত্বের পরিপন্থী। স্বার্থপর ব্যক্তি বৃহত্তর জীবনাঙ্গন থেকে স্বেচ্ছানির্বাসিত। 

পৃথিবীর ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল তার হৃদয়মন স্পর্শ করে না। সে নিজেকে নিয়েই বিব্রত থাকে। মানবধর্মের অবমাননাকারী ব্যক্তি পৃথিবীর জঞ্জাল। সে কখনোই সুখকর জীবনযাপনের স্বাদ পায় না। এ ধরনের স্বার্থপর মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সে সমাজের কোনো উপকারে আসে না। আর মানুষ যদি মানুষের উপকারেই না আসে তবে তাঁর জীবন ব্যর্থ। সেজন্যে সত্যিকারের ভালোমানুষ বলতে তাকেই বোঝায় যে নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে পরোপকারে নিয়োজিত থাকে। সেই মহৎ মানুষ যে নিজের জন্য নয়, সে বিশ্বমানবের জন্যে নিবেদিত তাই বলা হয়েছে -

আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা
জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।

জনসেবার ক্ষেত্র: জনসেবার কথাটি যেমন ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এর প্রয়োগ ক্ষেত্রও বিস্তৃত। সারাবিশ্বে এমন কোনো কাল ও সমাজ নেই বা ছিল না যে সমাজে বা কালে আর্ত-পীড়িত, দুঃখী-দরিদ্র অসহায়-সম্বলহীন, অনাথ-প্রতিবন্ধী মানুষ ছিল না। এসব মানুষদের সেবা করা জনসেবা বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। সমাজের কেউ না কেউ এসব অসহায় মানুষদের সেবা করে আসছে। তাছাড়া রাস্তা-ঘাট, পুল-সাঁকো নির্মাণ, পুকুর-দিঘি খনন ইত্যাদিও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং জনসেবার ক্ষেত্র কোনো বিশেষ কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। 

জনসেবার পদ্ধতি: বিশ্বের সব সমাজের প্রকৃতি যেমন এক নয় তেমনি সমস্যাও এক রকম নয়। সমাজের প্রকৃতি অনুসারে সমস্যার প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের হয় বলে জনসেবার পদ্ধতিও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন- একজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া যেমন জনসেবার পর্যায়ে পড়ে তেমনি সংশ্লিষ্ট ভিক্ষকে ভিক্ষা না দিয়ে তাকে কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়াও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত। তাছাড়া রুগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মৃতদেহ সৎকারের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠন, অনাথ-আতুরদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান ইত্যাদিও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত।

জনসেবার মানসিকতা অর্জনে সহায়তা: জনসেবা মূলত একটি মানবিক গুণ। এর জন্য কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া স্কুল-কলেজসমূহে অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে কীভাবে জনসেবা করা যায় তার একটি দিক-নিদের্শনা দেওয়া যায়। এতে ছাত্রজীবন থেকেই প্রত্যেকে জনসেবার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। 

জনসেবা যুগে যুগে: পূর্বে আমাদের দেশে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডসমূহ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়ে সামষ্টিকরূপে উন্নীত হয়েছে। আগেকার দিনে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল রাস্তা নির্মাণ, খাওয়ার পানির জন্য পুকুর বা দিঘি খনন, পথিকদের জন্য পান্থশালা নির্মাণ, অতিথিশালা নির্মাণ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে মানুষের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি লাভ করেছে। এখন নানাভাবে জনসেবা চলছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যাত্রী ছাউনি, সংবাদপত্র কেন্দ্র, পাঠাগার, পার্ক, চিত্তবিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বমানবতার কল্যাণে নানা আন্তর্জাতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন রেডক্রস, রেডক্রিসেন্ট ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে। কোনো আকস্মিক বিপদ এসে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করলে আর্ত-মানবতার সেবায় এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ সূচনা পালন করে। 

জনসেবা ও ধর্মীয় চেতনা: সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। মানুষের এই সেবাব্রত প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মাশ্রিত। ধর্মীয় চেতনাই মানুষকে সেবাধর্মে অনুপ্রাণিত করেছে। জগতের ধর্মগুরু ও ধর্মপ্রবক্তরা সেবাধর্মকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলেছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন: মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি মানুষের উপকার করেন। ধর্মীয় চেতনাই মানুষকে সেবাধর্মে অনুপ্রাণিত করেছে। ধর্মপ্রবণতাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের মানুষের জীবন-প্রত্যয়। বিভিন্ন ধর্মশাত্রে, কুরআনে, রামায়ণ-মহাভারতে, মহাকাব্যে, পুরাণে জনসেবাই শ্রেষ্ঠধর্মের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব। স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয়েছে -

জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

জনসেবার গুরুত্ব: বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন : পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও  পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে মানবজীবন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ফুলের মতোই মানুষের জীবন। ফুল ফুটে সুবাস ছড়ায়। তার সৌরভে চারদিক আমোদিত হয়। এভাবে সৌরভ ছড়ানোর মধ্যেই সে তার সার্থকতা খুঁজে পায়। তদ্রপ, অপরের কল্যাণে নিজকে নিয়োজিত করতে পারলেই জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে জাতিতে খাটি জনসেবকের সংখ্যা যত বেশি সে জাতির ঐক্য, জাতীয়তাবোধ এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে তত বেশি। সমাজের উন্নতির মূলে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর মধ্যে শিক্ষা, সময়োপযোগী চেতনা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ অন্যতম। কিন্তু সমাজের সচেতন এবং যোগ্য ব্যক্তিগণ এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন না করলে সাধারণ জনগণ তা যথাসময়ে যথাযোগ্যভাবে অর্জন করতে পারে না।

 এ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতির জন্যে কাউকে না কাউকে সমাজসেবার মহৎ ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের সাধ্যমত সাহায্য করতে হবে। দেশের চরম দুর্গতির সময় জনসেবার মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে । সর্বোপরি যে ব্যক্তি যেখানে, যে কর্মে নিয়োজিত আছে তার সে অবস্থান থেকেই মানুষের সেবা করতে হবে। তবেই মানবজীবন থেকে দুঃখ দূরীভূত হবে। 

জনসেবার পদ্ধতি ও জনসেবার চেতনা: জনসেবায় সকলেরই অধিকার আছে। মানুষের সবকটি মহৎ গুণাবলির মধ্যে সেবাব্রত অন্যতম। অন্নহীনে অন্নদান, বস্র বস্রহীনে, 

তৃষ্ণাতুরে জল দান, ধর্ম ধর্মহীনে, 
মূর্খজনে বিদ্যাদান, বিপন্নে আশ্রয়
রোগীরে ঔষধ দান, ভয়ার্তে অভয় 
গৃহহীনে গৃহ দান, অন্ধেরে নয়ন,
পীড়াতে আরোগ্যদান, শোকার্তে সান্ত্বনা,
স্বার্থশূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান,
স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান।

রজনীকান্ত সেনের এই দ্বাদশ দানের মধ্যেই প্রকৃত জনসেবার পরিচয় ও পদ্ধতি ফুটে উঠেছে। যারা বিত্তবান, তাঁরা দীনদুঃখীর ক্লেশ মোচনে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে পারেন। যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা তাদের সাধ্যমত শ্রম দিয়ে হোক, ভালোবাসা দিয়ে হোক, সান্ত্বনা দিয়ে হোক-অপরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে পারলে তবেই জীবনের সার্থকতা। জনসেবায় কায়িক শ্রমের মূল্য অপরিসীম। এই ব্রত উদ্‌যাপনে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে সম্মিলিত বা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার গুরুত্ব বেশি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দুস্থ মানুষের সেবাই এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রকৃতির রুদ্ররোষে, যুদ্ধে বা সাম্প্রদায়িক মত্ততায় মানুষ যেখানে অসহায় সেখানে এসব প্রতিষ্ঠান নিঃশর্ত সাহায্যের হাত প্রসারিত করে ছুটে যান। তারা বিপক্ষের জাতি ধর্মের বিচার করেন। না। আর্তের সেবার মধ্য দিয়েই এঁরা মানব জন্মের মহিমাকে প্রচার করেন। আমাদের দেশের সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে। বিভিন্ন এন. জি. ও, রেড ক্রিসেন্ট, রামকৃষ্ণ মিশন প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল: জনসেবায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক দলগুলো সংঘবদ্ধ শক্তি। এঁরাও, দুর্গতদের সাহায্যে প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। তবে এদের মধ্যে অনেকের ধারণা জনসেবার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ কোনো চিরস্থায়ী সমাধান নয়। সমাজের বুকে দীর্ঘদিনের যে হৃদয়হীন অন্যায়-অনাচারের পাহাড় সঞ্চিত হয়েছে, তার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সর্বাত্মক সমাধানের জন্যে তারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু যতদিন সমাজে দারিদ্র্য, শোষণ, বৈষম্য থাকবে ততদিন জনসেবার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল জনসেবাকেই জীবনের একমাত্র মহৎ ব্রত মনে করেন না। ক্ষমতা দখল এবং অধিকৃত ক্ষমতা বজায় রাখার দিকেই তাদের প্রাণান্ত প্রয়াস। ফলে দুর্গত, বিপন্নের সেবাতেও দেখা যায় সংকীর্ণ, দলীয় মনোভাব। জনসেবা অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার ছদ্মবেশ মাত্র।

উপসংহার: জনসেবা প্রত্যেক মানুষেরই এক সৎ ও মহৎ হৃদয়বৃত্তি। এই হৃদয়-বৃত্তির জাগরণই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। মানুষ কেবল স্বার্থ আর সম্পদের যন্ত্র নয়। মানুষ সুন্দরের আরাধনা করে। বিরাট মহিমার উপলব্ধিতে সে জীবনকে সার্থক ও অর্থময় করে তুলতে চায়। যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মাঝে আপনার আত্মাকে জানে, সে-ই জানে সত্যকে। নিঃস্বার্থ সমাজসেবা মানুষের এক দুর্লভ গুণ। মানুষের জীবনে যদি মহৎ সেবাব্রতের পূর্ণ দীক্ষা থাকে, যদি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই মহাপ্রাণতার অঙ্গীকার, তবেই এই ধূলার ধরণীতে একদিন প্রেমের দেবতার হবে অভিষেক। আজ দিকে দিকে যেখানে প্রমত্তের রণসাজ, যেখানে কপটতা-ভণ্ডামির ছদ্মবেশ, যেখানে আত্মসর্বস্ব ধ্যানধারণায় মানুষ নিয়ত কুণ্ঠিত, যেখানে হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, সেই হিংস্র প্রলাপের মধ্যে এই সহায়-সম্বলহীন আর্ত, দুর্গতদের সেবাই যেন হয় সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।

Tuesday, May 4, 2021

অনুচ্ছেদ

গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ

প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের মানুষ তার চারপাশের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে জীবনযাপন করে আসছে। পরিবেশ কথাটির অর্থ হলো আমরা যে যেখানে থাকি তার চারপাশের জগৎ, অর্থাৎ গাছপালা, মাটি, পানি, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, প্রাণী, উদ্ভিদ ইত্যাদি মিলেই পরিবেশ। মানুষ আর পরিবেশের মধ্যে যতদিন সমন্বয় বিদ্যমান ছিল ততদিন মানুষের কোনো দুর্ভাবনা ছিল না। কিন্তু সভ্যতার বিকাশ আর মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।

ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নগরায়ণ, অপরিকল্পিতভাবে মিল-কারখানা স্থাপন, যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোয়া, অধিকমাত্রায় বৃক্ষনিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা, বনভূমি ধ্বংস ইতাদি কারণে প্রতিদিন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বাস্পশক্তি ও বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের মূলে রয়েছে দহন। এই দহনের ফলে বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সূর্যের ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় রশ্মি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে পারে বায়ুমণ্ডলে এমন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আসা স্বল্প দৈর্ঘ্য বিকিরণের জন্যে স্বচ্ছ কিন্তু লম্বা দৈর্ঘ্য বিকিরণ ধরে রেখে ভূপৃষ্ঠ এবং বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত করে তোলে। বায়ুমণ্ডলে পরিবেশ দূষণের ফলে যেসব গ্যাস জমছে তার অবর্তমানে লম্বা দৈর্ঘ্যের বিকিরণ মহাশূন্যে হারিয়ে যেতো। এসব গ্যাস হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি। এসব গ্যাস যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে তবে ২০১৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাতে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ ১.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বৃদ্ধির এই পরিমাণ মানব ইতিহাসের এক অভাবনীয় ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। কেননা এক ডিগ্রি তাপের কয়েক দশমাংশ উত্তাপ বৃদ্ধি বিশ্বের আবহাওয়ায় এক বিরাট পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এই গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে সাগরের তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাবে, ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, উপকূলমণ্ডল ও নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং বাড়বে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। এতে বিশ্বের বহুভূমি বন্যাকবলিত হবে আর ছড়িয়ে পড়বে লবণাক্ততা। পরিণামে শিল্পকারখানা, জনবসতি, কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষ এবং বনাঞ্চলের ওপর ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেবে। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের জন্যে। একুশ শতকের মাঝামাঝি আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ বেড়ে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে অনুভূত হবে। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বলে বাংলাদেশে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাই এখন থেকেই পরিবেশ দূষণ রোধ করে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে।

অনুচ্ছেদ

 গ্রাম্যমেলা

মেলা হচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মেলা লোক সংস্কৃতিরই এক বিশেষ ধমনী। এই ধমনীতেই জীবনের স্পন্দন। এরই মধ্যে বাঙালী খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলার নামে সবার মন এক অভূতপূর্ব আনন্দের উচ্ছাসে ওঠে নেচে। মেলার আনন্দের স্মৃতি সকলের মনেই থাকে গভীরভাবে মুদ্রিত। মেলা পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও ভাব-সম্মিলনের সংযোগ সেতু। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রাম্য মেলার গুরুত্ব তাই অসীম। বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষে মেলার প্রচলন হলেও এখন গ্রামীণ-জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণত বছরের শেষে অথবা বছরের শুরুতে এই মেলা বসে অথবা বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষেও মেলার আায়োজন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই নানা ধরনের মেলার প্রচলন রয়েছে। স্থান বিশেষে রয়েছে কিছু বিখ্যাত মেলা। যা ঐ স্থানের নামেই সুপরিচিত

সাধারণত মেলা বসার জন্য হাট-বাজারের ন্যায় নির্দিষ্ট কোন স্থান নির্ধারিত থাকে না। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে খোলা মাঠে, মন্দির প্রাঙ্গনে, নদীর তীরে অথবা বড় বৃক্ষের নিচে গ্রাম্য মেলা বসতে দেখা যায়। পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব স্থানে মেলার আয়ােজন করা হয়। মেলার প্যানে সাময়িকভাবে দোকানপাট বসার মত চালা নির্মাণ করা হয়। মেলা শেষ হওয়ার পর এগুলো ভেঙে ফেলা হয়। বছরের শেষে মেলার আনন্দে আবারও মুখরিত হয়ে ওঠে মেলার সে স্থানে। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলাগুলোর কোনটি একদিন, কোনটি এক সপ্তাহ, কোনটি পনের দিন আবার কোন কোন মেলা এক মাসব্যাপী চলতে থাকে। আজকাল শুধু গ্রাম নয়, শহর বা আধা শহরেও মেলার আসর বসে। তবে গ্রামই মেলার উপযুক্ত পটভূমি। আমাদের দেশে গ্রামে সাধারণত ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পহেলা বৈশাখ, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বিজয়া দশমী, দশই মহরম, চৈত্র সংক্রান্তি এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মেলা বসে থাকে। তবে উপলক্ষ যাই হোক না কেন মেলা বাঙালি সমাজ ও মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের দিন। মেলায় সমাজের সর্ব শ্রেণীর মানুষ, ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকলেই এসে মিলিত হয়। বিভেদের পার্থক্য ভুলে গিয়ে সকলেই এক আনন্দের জোয়ারে গা ভাসায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম্য মেলা শুধু আনন্দ চিত্তের শান্তিই দেয় না, বিত্তের শক্তি যোগায়। মেলায় কৃষি ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের কামার-কুমার, তাঁতী, সুতারদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস বানানাের হিড়িক পড়ে যায়। তাই দেখা যাচ্ছে, মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উপার্জনের পথও প্রশস্ত হয়।

মেলাকে আশ্রয় করেই গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-উৎসের রুদ্ধ দুয়ার খোলে যায়। এর মধ্যেই সে খুঁজে পায় বেঁচে থাকার সার্থকতা। খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ। সত্যপীর, শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী, ওলাবিবি, সতী-মা এমনি কত লৌকিক দেবদেবী গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কত শত শতাব্দীর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ধর্মীয় আকুতির সঙ্গে এঁদের আত্মিক সম্পর্ক। এদের কেন্দ্র করে কত লোকগাথা, কত ব্রতকথা, পাঁচালী, ছড়া, গ্রাম্য সাহিত্য-সঙ্গীতের ধারা আজও চলে আসছে। মেলা গ্রামীণ জীবনের শুকনো খাতে নিয়ে আসে প্রবল আনন্দ-জোয়ার। সেই জোয়ারেই বাঙালীর চিত্তভূমি সিক্ত হয়েছে।

অনুচ্ছেদ

 শব্দদূষণ 

শব্দ বা আওয়াজ হলো ধ্বনি-তরঙ্গ। এটি মানুষের বাগ্যন্ত্র বা অন্য কোনো উৎস থেকে উৎপাদিত বা সৃষ্টি হয়ে আমাদের কর্ণকুহরে এসে পৌছায়। এসব শব্দ কখনো কখনো আমাদের জন্য ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, আর সেটিই হলো শব্দদূষণ।

পাখপাখালির ডাক, মৃদু শব্দ, সংগীতের সুর শ্রুতিমধুর, যানবাহনের হর্নের আওয়াজ, রেডিও-টেলিভিশনের উচ্চ শব্দ, কলকারখানার সাইরেন, মাইকের আওয়াজ, উডড়োজাহাজের শব্দ ইত্যাদি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ এ শব্দগুলো অতিমাত্রার ফলে শব্দদূষণ ঘটছে। শব্দদূষণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। শব্দদূষণের ফলে শিশু ও বড়দের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে মানুষ। মানসিক অবসাদগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগেরও সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চ শব্দযুক্ত শিল্পকারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তাদের প্রবণশক্তি ১০ বছরে অর্ধেক হ্রাস পায়। শব্দদূষণের ফলে নানা ধরনের মানসিক বিকার ও অসুখের সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশে আইন প্রণয়ন ও পালনের মাধ্যমে শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও তৃতীয় বিশ্বে এর প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমরা সচেতন হলে শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পেতে পারি। আজকের দিনে শব্দদূষণ প্রতিকারে উদ্যোগ ও সচেতনতা অতীব প্রয়োজনীয়। সেই সাথে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।