বৃক্ষরোপণ বা সামাজিক বনায়ণ
রচনার সংকেত-
#
ভূমিকা;
#
অরণ্য
উচ্ছেদ;
#
বৃক্ষরোপণ
তথা বনমহোৎসব;
#
বৃক্ষরোপণ
অভিযান;
#
বনসংরক্ষণ;
#
অরণ্য
ধ্বংসের প্রভাব এবং প্রতিকার;
#
অরন্যের
পুনরুদ্ধার: আমাদের অঙ্গীকার;
#
উপসংহার।
ভূমিকা: আধুনিক নগরজীবনে ক্লান্ত বিধ্বস্ত কবি একদিন ব্যাকুল হয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।” এ বিশ্বে সৃষ্টির আদি হল উদ্ভিদ। এই ধরীত্রির সৃষ্টিলগ্নে বিশ্বসংসার পরিপূর্ণ ছিল বৃক্ষরাজি দ্বারা গঠিত সুবিশাল অরণ্যে। কিন্তু কালের বিবর্তনে যখন সমগ্র প্রাণীকূল তথা মানুষের উদ্ভব ঘটে, তখন মানুষ নিজের প্রয়োজন হেতু পৃথিবীর বুক চিরে নির্বিচারে অরণ্যচ্ছেদন করে আপন সভ্যতার জয়যাত্রা অব্যাহত রাখে। সময়ের লহমায় পৃথিবী তথা সমগ্র জীবকুলের নিয়ম বদলাতে থাকে, বিশ্বজুড়ে মানবসভ্যতা সর্বশ্রেষ্ঠ মাত্রা পায়।
তবুও মানুষ এবং উদ্ভিদকুলের মধ্যে একটা সমতা বরাবর বজায় ছিল। কিন্তু মানুষের ভোগের বাসনার কোন অন্ত ছিল না কোনদিন। আদিম সেই নির্মম বাসনাই নবজাগরণ পরবর্তী তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের পর চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পৃথিবী জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে অসংখ্য নতুন নতুন নগর, কলকারখানা বন্দর আরো কত কি। আপন জৈবিক লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে পরিবেশকে নিজের ইচ্ছে মতন ব্যবহার ও শোষণ অব্যাহত থাকে।
অরণ্য উচ্ছেদ: শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, সৃষ্টির আদি ছিল অরণ্য দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের প্রায় সমগ্র অংশই ছিল আরণ্যাবৃত। সময় নাটকের নিয়ম অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সেই জনবসতির বিস্তার ও কৃষি জমি প্রসারের উদ্দেশ্যে বনভূমির বুক থেকে বৃক্ষ ছেদনের নির্মম খেলায় কোমর বেঁধে কুঠার ধরলো মানুষ।
হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত বনভূমি এই ভাবেই শেষ হতে থাকলো। এইখানেই অরণ্য ধ্বংসের শুরু। তারপর সময় যত এগিয়েছে মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার প্রসারের আকাঙ্ক্ষায় গড়ে তুলতে শুরু করেছিল নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা বন্দর। এরপর এসেছে আধুনিক নগর সভ্যতার যুগ।
এই যুগে মানুষ হয়ে উঠেছে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, মূল্যবোধহীন ভোগসর্বস্ব জীব। পরিবেশের ভারসাম্য কে সামান্যতম রেয়াত না করেই চলেছে অরণ্যধ্বংস। যার আধুনিকতম উদাহরণ দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য সম্পর্কে চূড়ান্ত অবহেলা, সেখানকার বিধ্বংসী দাবানল এবং প্রায় মনুষ্যসৃষ্ট ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়।
মোট বনভূমি বা অরণ্যের প্রায় অর্ধেক অংশ এভাবেই নির্বিচারে শেষ করে ফেলেছে মানুষ।শেষ পর্যন্ত যে অরণ্য পরিত্রাণ পেয়ে নিজের অস্তিত্বকে এখনো অব্দি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তার পরিমাণ হল পৃথিবীর মোট স্থলভাগের শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ।
বৃক্ষরোপণ তথা বনমহোৎসব: গাছ আমাদের একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু। গাছপালা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে অন্য কোনো জীবের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায়না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রত্যেকটি জীব প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আর বাস্তুতন্ত্রের অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রানীই উদ্ভিদের সাথে জৈবিক আদান প্রদানের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে থাকে।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধুটির প্রতি মানুষের চূড়ান্ত এক অবহেলার রূপ লক্ষ্য করা যায়। সেজন্যই হয়তো সমগ্র পরিবেশ আজ সংকটের সম্মুখীন। একথা সত্য যে মানব সভ্যতার অগ্রগতি হেতু পরিমিত বৃক্ষছেদনের প্রয়োজন আছে, তবে সেই স্থানে নতুন বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তাও সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
কিন্তু চারা গাছ লাগানো নয়, শুধুমাত্র গাছ কাটার প্রতিই মানুষের মনোযোগ বেশি লক্ষ্য করা যায়। তাই নতুন গাছ লাগানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।আমাদের এই আধুনিক যন্ত্র পরিচালিত জীবনে বৃক্ষরোপনের প্রয়োজন একান্ত আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে। স্বাভাবিকভাবে এইযে বৃক্ষরোপনের উদ্যোগে মানুষের এত অবহেলা, তারই বিশেষ কার্যক্রম বনমহোৎসব নামে পরিচিত।
আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আশ্রমবাসীদের সঙ্গে নিয়ে বর্ষার দিনে বনমহোৎসব পালন করতেন। যদিও বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে।
তাই উক্ত বনোমহোৎসব আজ বিশ্বায়িত হয়ে এক আন্তর্জাতিক উৎসবের আকার ধারণ করেছে। আজকাল সরকারি ও বহু বেসরকারি উদ্যোগে তথা বনমহোৎসব পালন করা হয়ে থাকে।
বৃক্ষরোপণ অভিযান: বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর সম্প্রসারণের জন্য দেশে বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রত্যেক বছর বৃক্ষরোপণ অভিযান দুএক সপ্তাহ জুড়ে বা মাসব্যাপী চলে। এসময় বিনামূল্যে সাধারণ মানুষকে চারা গাছ দেওয়া হয় রোপন করবার জন্যে।
এছাড়াও প্রচার করা হয় বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা, গাছ লাগানো ও সংরক্ষণের সঠিক উপায়। নিঃসন্দেহে বলা যায় বৃক্ষরোপণ অভিযান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোগ গুলির মধ্যে একটি।
অরণ্যের আচ্ছাদনকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। তাই বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করার জন্য শুধুমাত্র সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলির উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। এসমস্ত উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ হয় ঠিকই, কিন্তু তা প্রতিনিয়ত হয়ে চলা বিশ্বব্যাপী অরণ্যছেদনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য।
এই ধরনের সংগঠিত উদ্যোগ মানুষকে
নিয়মের গণ্ডিতে নিশ্চয়ই বেঁধে দিতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে তা কতখানি
স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাব ফেলে সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর পরিবেশের বিষয়ে একমাত্র
সার্বিক স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগই সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে। সেজন্য বৃক্ষরোপণের বিষয়ে
সার্বিক সচেতনতা এবং সাধারণ উদ্যোগ গড়ে তোলার বিকল্প কিছু হতে পারে না।
বনসংরক্ষণ: বনসংরক্ষণ ব্যতীত বৃক্ষরোপণ একবারেই অর্থহীন। গাছ লাগানোর সাথে সাথে বনভূমিতে যেসব গাছ রয়েছে তাদের বাঁচিয়ে রাখাটাও মানুষেরই দায়িত্বের অঙ্গ। পৃথিবীকে দূষণমুক্ত সবুজ ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয় ,এর জন্য প্রথমে অনিয়ন্ত্রিত অরণ্যধ্বংস বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়াও, নতুন যে সমস্ত বৃক্ষচারা রোপন করা হচ্ছে সেইগুলি যাতে নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে সেদিকেও সচেতন নজর দেওয়া দরকার।
ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছি, আজও মানুষের ভোগ ও লোভের বাসনায় লাগাম টানা যায়নি। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে বহু মূল্যবান গাছ কেটে ফেলছে। এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের যত শীঘ্র সম্ভব সুসংগঠিত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
তদুপরি কোনো বিশেষ প্রয়োজনে একটি
গাছ উচ্ছেদ করলে তার বদলে অন্তত দশটি চারা গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রেও
শুধুমাত্র সরকারি বা বেসরকারি সংগঠিত উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। স্বতঃস্ফূর্ত সার্বিক উদ্যোগ
সচেতনতাই বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দেবে এবং বৃক্ষরোপণের প্রকৃত উদ্দেশ্যও
সিদ্ধ হবে।
অরণ্য ধ্বংসের প্রভাব এবং প্রতিকার: শোষণের হতাশায় পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাসে স্বাভাবিকভাবেই জল স্থল সমগ্র আবহাওয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দূষণের বীজাণু। জলবায়ু হয়ে ওঠে বিষাক্ত। দূষিত এই পরিবেশেই মানুষ প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে কাজের সন্ধানে,আশ্রয়ের আশায়, প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে _এ যেন অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা, কে কার আগে পৌঁছাবে তারই কলরব। আর অন্যদিকে এই ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে দূষিত পরিবেশে নিজের মধ্যেই নিজের মৃত্যুবীজ মানুষ বুনে দিয়ে যাচ্ছে অচিরেই।
এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ, সবুজ প্রান্তর, বনরাজির স্নিগ্ধ আচ্ছাদন। একথা আজ পৃথিবীর যেকোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই অনুধাবন করতে পারেন খুব সহজেই।
দূষণ প্রতিকার করতে ও সুন্দর শ্যামল পরিবেশ গড়ে তুলতে বনসংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেজন্যেই আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের এত গুরুত্ব, এত আলোচনা, এত সম্মান।
বন সংরক্ষণ তথা বনসৃজন এর উদ্দেশ্যে
দায়িত্বপ্রাপ্ত উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অবশ্যপালনীয় কিছু কর্তব্য:
v অরণ্যের অবাধ ও যথেচ্ছ উচ্ছেদ নিবারণ।
v অপরিণত বৃক্ষ ছেদন বন্ধ করা।
v দাবানলের হাত থেকে বন জঙ্গলকে রক্ষা
হেতু উদ্যোগ গ্রহণ করা।
v অরণ্য গবেষণার প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা
করা।
v যথেচ্ছ পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা।
v তৃণমূল স্তর থেকে বৃক্ষরোপনের উদ্যোগ
গ্রহণ করা।
v রোপন করা চারা গাছের সংরক্ষণ।
v বনসৃজন ও বন সংরক্ষণের ব্যাপারে
স্থানীয় মানুষের যোগদানে উৎসাহ দেওয়া।
v প্রাথমিক মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার
ক্ষেত্রে পরিবেশ শিক্ষার ব্যাপক প্রচার।
v বনসৃজন এবং বন সংরক্ষনের জন্য সার্বিক
স্বতস্ফূর্ত সাধারণ উদ্যোগ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সমাজের সর্বস্তরে সংশ্লিষ্ট বিষয়
ভিত্তিক সচেতনতার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার।
অরন্যের পুনরুদ্ধার: আমাদের অঙ্গীকার: বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের এই মহাযজ্ঞে যদি আমরা সফল হই তাহলে হয়তো আবার কোন দিন বীজাণু মুক্ত স্নিগ্ধ বাতাসে আমাদের কোন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্বাস নিতে পারবে। হয়তো আমরা সত্যিই এ পৃথিবীর জীবকুলকে এক অমোঘ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো।
আবারো এ পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদকূল
প্রকৃতির নিয়মে পারস্পারিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরম শান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত
করতে পারবে। তাই আজ পরিবেশের এই সংকট কালে দূর ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্নকে চোখে রেখে
সমগ্র মানবজাতির অঙ্গীকার হোক পরিবেশ রক্ষা।কবির ভাষায়-
“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে
প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
উপসংহার: আধুনিক যন্ত্র পরিচালিত জীবনের কলুষিত পরিবেশ মানুষকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় আরণ্যক সভ্যতার উদার প্রশান্ত জীবনের কথা। কিন্তু এই আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক নগরজীবন ত্যাগ করে অরণ্যের যুগে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মানুষের পক্ষে নিতান্তই এক আকাশ কুসুম কল্পনা। পাশাপাশি একথাও সত্য যে পরিমিত অরণ্য ব্যতীত প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষাও কোনভাবে সম্ভব নয়। সভ্যতার অগ্রগতির বীজাণু যখন সেই সভ্যতারই গলা টিপে ধরতে চাইছে, তখন একমাত্র মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুই পারে বিশ্ব সংসারকে এই চূড়ান্ত সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে। সেজন্য নিজের স্বার্থেই, মানবকূলকে আজ শামিল হতে হবে পৃথিবীর ফুসফুস কে পুনরায় সুস্থ করে তোলবার উদ্যোগে।
--- সমাপ্ত ---
No comments:
Post a Comment