চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Sunday, July 5, 2020

শব্দালঙ্কার

# অলঙ্কার কাকে বলে? শব্দালঙ্কারের শ্রেণিবিভাগ উদাহরনসহ আলোচনা কর।

অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ আভরণ, ভূষণ অর্থাৎ যা দিয়ে শরীরকে সজ্জিত বা ভূষিত করা যায়। সুতরাং নিরাভরণ দেহকে যেমন হার, দুল, বলয়, কাঁকন ইত্যাদি আভরণে মনের মতো সাজানো যায়, তেমনি কাব্য শরীরকেও কবিগণ বিভিন্ন অলঙ্কার দিয়ে ভূষিত করেন।

হার, দুল, বলয় এসব অলঙ্কার নারীদেহে যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তেমনি কাব্যক্ষেত্রে অলঙ্কার মানে সৌন্দর্য।

খ্রীঃ সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে ভামহ, বামন প্রমুখ সাহিত্যাচার্য মনে করতেন, অলঙ্কারের গুনেই শুধু কাব্য গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। অবশ্য তারা পরে বলে গেছেন যে, সৌন্দর্যই অলঙ্কার।

আচার্য দন্ডী বলেছেন, কাব্যের শোভাকর তথা সৌন্দর্যবিধায়ক ধর্মকে বলা হয় অলঙ্কার।

সুধীরকুমার দাশগুপ্ত বলেছেন, “অলঙ্কারশাস্ত্র এর প্রকৃত অর্থ সৌন্দর্যশাস্ত্র বা কাব্য সৌন্দর্যবিজ্ঞান, ইংরেজিতে যাহাকে বলা যাইতে পারে Aesthetic of poetry”.

ইংরেজিতে Alexander bain বলেছেন, “A figure of speech is a deviation from the plain & ordinary mood of speaking, with a view to greater effect”
এখানেও শব্দের সাধারণ অর্থ-অতিক্রামক সেই বৈচিত্র এবং সৌন্দর্যের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

Beautifying Instrument.অর্থাৎ কাব্যের শোভাবর্ধন করা তথা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাই অলঙ্কারের ধর্ম।

যে কোন সুন্দর পরিমিতি মানতে বাধ্য এবং অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলা সবসময়ই সৌন্দর্য বিরোধী। অঙ্গদকে কেউ পায়ের মল হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি হবে না কারন তা অনিয়ম। তেমনি কাব্যেও যথেচ্ছ অলঙ্কার চাপিয়ে দিলেই হয় না, বিচার করতে হবে সেটা নিয়মমাফিক কিনা, প্রয়োগসিদ্ধ কিনা।

শব্দ ধ্বনিকে শ্রুতিমধুর এবং অর্থকে মনোহর আর হৃদয়গ্রাহী করার জন্যে অলঙ্কারকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে- অ) শব্দালঙ্কার আ) অর্থালঙ্কার।

শব্দালঙ্কার: অর্থবহ ধ্বনি সমষ্টিকে বলা হয় শব্দ। শব্দ বা ধ্বনিই শব্দালঙ্কারের নিয়ন্তা। অর্থাৎ যে অলঙ্কার ধ্বনির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং শ্রুতিসৌন্দর্য বিধায়ক তাকেই শব্দালঙ্কার বলা হয়।

শব্দালঙ্কারগুলো হচ্ছে:
১. অনুপ্রাস
২. যমক
৩. শ্লেষ
৪. বক্রোক্তি
৫. পুনরুক্তবদাভাস

০১. অনুপ্রাস: ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যদি যুক্ত বা বিযুক্তভাবে বাক্যমধ্যে একাধিকবার ধ্বনিত হয় তবে তাকে অনুপ্রাস বলে। যেমন:

   কান্তা ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন রিল।–বিদ্যাসাগর।
   --‘ক’ পাঁচবার আবৃত্ত।
  গুরু গুরু র্জন- গুগুন স্বর।--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 ‘গ’ পাঁচবার আবৃত্ত।

অনুপ্রাসের প্রকারের অনুপ্রাস দেখা যায়। যেমন:
ক. অন্ত্যানুপ্রাস;
খ. বৃত্তানুপ্রাস;
গ. ছেকানুপ্রাস;
ঘ. শ্রুত্যনুপ্রাস;
ঙ. আদ্যানুপ্রাস।

ক. অন্ত্যানুপ্রাস: কবিতার পাদান্তের সাথে এবং চরণের শেষের শব্দটির সাথে পরবর্তী চরনের শেষ শব্দটির ধ্বনিসাম্য থাকলে তাকে অন্ত্যানুপ্রাস বলে। যেমন:

১. সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের লেন-দেন
    থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বলনতা সেন। --জীবনানন্দ দাশ।

২. আমার অঙ্গন আঁধারে হল বন,
    নিয়েছি বুক পেতে জলের দংশন। --শামসুর রহমান।

৩. নাকি, তুমি অজানিতে ভ’রে দাও ডালি?
    নাকি, তুমি সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি।–বিষ্ণু দে।

খ. বৃত্তানুপ্রাস: একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্তভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে বৃত্তানুপ্রাস সৃষ্টি হয়। যেমন:
এটি চারধরনের হতে পারে
১. একটি মাত্র ব্যঞ্জনের দুবার ধ্বনিত হওয়া-
   ধ্বংশান্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না। --রফিক আজাদ।
এখানে ‘শ’ দ দুবার করে আবৃত্ত।

২. একটিমাত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বহুবার ধ্বনিত হলে
বাঙালি কৌমের কেলি ল্লোলিত লাবতী --আল মাহমুদ।
এখানে ক ধ্বনি পাঁচবার ধ্বনিত হয়েছে।

৩. ব্যঞ্জনগুচ্ছ স্বরূপানুসারে মাত্র দুবার ধ্বনিত হলে
ফুটেছে যৌবন বনে আনন্দের ফুল
জেগেছে যৌবন নব বসুধার দেহে --শ্যামাপদ চক্রবর্তী।
বর্ণগুলোর (যৌবন বনে এবং যৌবন নব) ক্রম অক্ষুন্ন এবং ধ্বনিসাদৃশ্য বর্তমান।

৪. যুক্ত বা বিযুক্তভাবে ব্যঞ্জনগুচ্ছ ক্রমানুসারে বহুবার ধ্বনিত হলে
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথ- প্রান্তে ফেলে যেতে হয়। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখানে যুক্ত ‘ন্ত’ ক্রমানুসারে তিনবার ধ্বনিত হয়েছে।

৫. কাক কালো কোকিকালো কালো ন্যার কেশ।
  ‘ক’ নয় বার ধ্বনিত হয়েছে।

গ. ছেকানুপ্রাস: দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত অবস্থায় ক্রমানুসারে যদি মাত্র দুবার ধ্বনিত হয় তবে তাকে ছেকানুপ্রাস বলে। যেমন:
১. অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? --সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
২. ভুরুর ভঙ্গিমা হেরি ভুজঙ্গ সকল।–আলাওল।
৩. লঙ্কার পঙ্কজ রবি যাবে অস্তাচলে।–মধুসূদন।
৪. কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে।–রবীন্দ্রনাথ।

ঘ. শ্রুত্যনুপ্রাস: বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে যে সকল ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলো একই ধ্বনি হলেও সদৃশ ধ্বনি; সেই সদৃশ ধ্বনির সাম্যে জাত অনুপ্রাসকে শ্রুত্যনুপ্রাস বলে। যেমন:
১.ক-খ:
বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে
ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে।--রবীন্দ্রনাথা ঠাকুর।
এখানে লক্ষ্য করুন প্রথম চরনের শেষে ‘ক’ ধ্বনি আছে আবার দ্বিতীয় চরনের শেষে ‘খ’ ধ্বনি আছে। এটাই শ্রুত্যনুপ্রাস।
২. গ-ঘ:
উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে
উন্মাদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে।--কাজী নজরুল ইসলাম।
এখানে লক্ষ্য করুন প্রথম চরনের শেষে ‘ঘ’ ধ্বনি আছে আবার দ্বিতীয় চরনের শেষে ‘গ’ ধ্বনি আছে। তাই গ-ঘ যেমন হতে পারে তেমনি ঘ-গ হতে পারে।
এরকম আরো হতে পারে যেমন, চ-ছ, ট-ঠ, ত-থ, দ-ধ, র-ড় ইত্যাদি।

আরো কিছু অনুপ্রাস আছে বলে মনে করা হয়। সেগুলো দেওয়া হল।

ঙ. আদ্যানুপ্রাস: কবিতার আদান্তের সাথে এবং চরণের প্রথম শব্দটির সাথে পরবর্তী চরনের প্রথম শব্দটির ধ্বনিসাম্য থাকলে তাকে আদ্যানুপ্রাস বলে। যেমন:

১. যতবার লেখা শুরু করি
   ততবার ধরা পড়ে, এ খবর সহজ তো নয়।--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখানে প্রথম চরণের প্রথম শব্দ যতবার এর সাথে পরবর্তী চরণের প্রথম শব্দ ততবার এর সাথে মিল আছে।
২. পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে
    শাখা আবার চায় কি তাহার পানে?--রবীন্দ্রনাথ।

চ. মধ্যানুপ্রাস: সাধারণত কবিতার চরণের মধ্যে ধ্বনিসাম্য থাকলে তাকে মধ্যানুপ্রাস বলা হয়।যেমন:

১. চুল তা কবেকা অন্ধকা বিদিশা নিশা।--জীবনানন্দ দাশ।
এখানে ‘র’ ধ্বনি কয়েকবার উচ্চারিত হয়েছে।

০২. যমক: একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনিসহ নির্দিষ্টক্রমে সার্থক কিংবা নিরর্থকভাবে যদি একাধিকবার উচ্চারিত হয় তাকে যমক অলঙ্কার বলে।যেমন:

১. ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে। --ভারতচন্দ্র।
এখানে ভারত শব্দটি দুইবার উচ্চারিত।
২. কীর্তিবাস কীর্তিবাস কবি
এ বঙ্গের আলঙ্কার। --মধুসূদন।
এখানে কীর্তিবাস শব্দটি দুইবার উচ্চারিত।

প্রচলিত অলঙ্কারসমূহে চার রমক যমক আছে। আদ্য, মধ্য, অন্ত্য, এবং সর্বযমক

# আদ্যযমক: চরণের আদিতে এ যমক ঘটে। যেমন:
১. ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে। --ভারতচন্দ্র।
   এখানে ভারত শব্দটি দুইবার উচ্চারিত।

২. মৌ-লোভী যত মৌলভী আর মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে। --কাজী নজরুল ইসলাম।

# মধ্যযমক: চরণের মধ্যভাগে এ যমক ঘটে। যেমন:

১. তোমার এ বিধি, বিধি, কে পারে বুঝিতে। --মধুসূদন।
২. দুরুহ বিরহকাল কাল যেন দেখি সমুখে! --মধুসূদন।

# অন্ত্যযমক: চরণের শেষে এ যমক ঘটে। যেমন:

১. তখন একটি কবিতা তো নয়,
যখন রক্তে আকুল বিনয়। --সৈয়দ আলী আহসান।

২. কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ
    বসি একাকিনী বাতায়ন পাশ।--রবীন্দ্রনাথ।

# সর্বযমক: অনেক সময় বহুর্থক শব্দযোগে বহুবিধ অর্থেও যমক অলঙ্কারে প্রয়োগ দেখা যায়।যেমন:

কুসুমের বাস ছাড়ে কুসুমের বাস,
বায়ু ভরে করে এসে নাসিকায় বাস।
(বাস-আশ্রয়, গন্ধ, বসতি)

০৩. শ্লেষ: একটি শব্দ বাক্যে একবার ব্যবহৃত হলেও যদি তার একাধিক অর্থ বর্তমান থাকে এবং শ্রোতা বা পাঠক উভয় অর্থই গ্রহণ করেন তখন শ্লেষ অলঙ্কার হয়। যেমন:

শ্লেষ দু প্রকার: সভঙ্গ ও অভঙ্গ শ্লেষ।

# সভঙ্গ শ্লেষ: শব্দটি অটুট থাকলে এক অর্থ এবং শব্দটি ভাঙ্গলে যদি ভিন্ন অর্থ দ্যোতিত হয় তবে তাকে সভঙ্গ শ্লেষ বলে।
যেমন:
অর্ধেক বয়স রাজা, এক পাটারাণী।
পাঁচপুত্র নৃপতির, সবে যুব জানি।।

যুবজানি- এক অর্থে, সকলকেই যুবক বলে জানি। অপর অর্থে- সকলেরই যুবতী স্ত্রী। যুবজানি শব্দের বিশ্লেষণে-যুবতী জায়া যার।

# অভঙ্গ শ্লেষ: এখানে শব্দকে না ভেঙ্গেই একাধিক অর্থ পরিস্ফুট হয়। যেমন:

মধুহীন কর না গো তব মন কোকনদে

এক অর্থে মনরূপ পদ্মকে মধুহীন করো না, অপর অর্থে মধুসূদন দত্তকে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না।

০৪. বক্রোক্তি: বক্তা বা প্রশ্নকারী যদি কোনো কথাকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন অথচ শ্রোতা বা উত্তরদাতা সে অর্থ গ্রহন না করে কথাটিকে ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করেন কিংবা সে অনু্সারে উত্তর দেন, তবে সেখানে বক্রোক্তি অলঙ্কার হয়। যেমন:

বক্রোক্তি দুপ্রকার- শ্লেষ ও কাকু বক্রোক্তি।

# শ্লেষ বক্রোক্তি: একটি শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় বলে একে বলা হয় শ্লেষ বক্রোক্তি। যেমন:

আপনার ভাগ্যে রাজানুগ্রহ আছে
-তিন মাস জেল খেটেছি; আর কতদিন খাটব?
-রাজানুগ্রহ যে অর্থে বক্তা প্রয়োগ করেছেন-উত্তরদাতা সে অর্থে না ধরে জেলখাটা অর্থ ধরে উত্তর দিলেন।

# কাকু বক্রোক্তি: এখানে বক্তার কণ্ঠস্বরের ভঙ্গিতে অর্থের পরিবর্তন ঘটে যায়; সাধারণতঃ বিধি নিষেধে এবং নিষেধ বিধিরূপে গৃহীত হয়। যেমন:

কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ?
-অর্থাৎ কেউ পদ্মের পর্ণ ছেঁড়ে না।

০৫. পুনরুক্তবদাভাস: আপাতদৃষ্টিতে কোনো বাক্যে যদি মনে হয় একই অর্থে একাধিক শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে অথচ একটু মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, তারা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত তাহলে পুনরুক্তবদাভাস হয়। যেমন:

তনু দেহে রক্তাম্বর নীবীবন্ধে বাঁধা
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।
তনু ও দেহ দুয়ের অর্থই এক, কিন্তু এখানে তনু ছিপছিপে অর্থে ব্যবহৃত।



তথ্যসূত্র: অলঙ্কার-অন্বেষা: নরেন বিশ্বাস।

No comments: