বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ও তার সমাধান
ভূমিকা: বেকার সমস্যা
বেকার ব্যক্তির উপর যেমন অভিশাপস্বরূপ তেমনি কোনো দেশ বা জাতি কিংবা দেশের
অর্থনীতির উপরও অভিশাপস্বরূপ। বাংলাদেশের যাবতীয় জটিল সমস্যাবলির মধ্যে বেকার
সমস্যা অন্যতম প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে যেখানে শতকরা মাত্র
২৫ জন লোক শিক্ষিত সেখানে যদি অসংখ্য কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন বা বেকার হয়ে পড়ে,
তাহলে দেশের সংকট যেকোনো স্তরে গিয়ে পৌঁছায় তা বলাই বাহুল্য।
বেকার: ‘বেকার’
শব্দটি ‘কার’ শব্দের পূর্বে ফরাসি ‘বে’ উপসর্গ যোগে সৃষ্টি। যার আভিধানিক অর্থ
হচ্ছে কর্মহীন। সাধারণ অর্থে যার কোনো কাজ নেই বা যেকোনো কাজ করে না সে-ই বেকার।
সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায়- বেকার হচ্ছে তারা যারা সামাজিক অবস্থায় যথেষ্ট কর্মক্ষম
হওয়ার বিপরীতে কাজ পায় না। অর্থনীতির দৃষ্টিতে- কাজ করার যোগ্যতা বা ইচ্ছে থাকা
সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ না থাকার নাম বেকারত্ব। আর যে বা যারা কাজের
সামর্থ্য ও ইচ্ছা থাকার পরও কাজের সুযোগ পায় না তারাই বেকার। তবে বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে সাধারণভাবে বেকার বলতে আমরা দুই শ্রেণিকে বুঝি।
(ক) ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকার পরও যারা
কাজের সুযোগ বঞ্চিত
(খ) সামর্থ্য ও সুযোগ থাকার পরও যারা
কাজ করে না।
সাধারণত কর্মহীনতাকে
বেকারত্ব বলে। সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে বেকারত্ব বলতে এমন একটি পরিস্থিতিতে
বোঝায়, যাতে কর্মক্ষম ব্যক্তি বর্তমান মজুরিতে কর্মে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও কর্মে
নিয়োগ লাভ করতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ কর্মক্ষম ব্যক্তির অনিচ্ছাকৃত বেকারত্বকে সামাজিক
বেকারত্ব বলে।
অধ্যাপক পিগু বেকারত্ব
সম্পর্কে বলেন,
“এখন কর্মক্ষম লোকেরা যোগ্যতা অনুসারে
প্রচলিত মজুরীর ভিত্তিতে কাজ করতে চায় অথচ কাজ পায় না সে অবস্থাকে বেকারত্ব বলা হয়।”
বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব: বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যার
দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে সপ্তম। মাত্র ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কি.
মি. এর এদেশে প্রায় ১৬ কোটি লোকের বসবাস। হিসেব মতে, কর্মক্ষম লোকের ২৭.৯৫ শতাংশ
বেকার সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশের বেকারত্বের অন্যতম প্রধান কারণ কৃষিনির্ভরতা। মোট
শ্রমশক্তির ৫১.৬৯ ভাগ কৃষির উপর নির্ভরশীল। চাষ ও ফসল কর্তনের সময় ব্যতিত তারা
কোনো কাজ করে না। ফলে বছরের প্রায় অর্ধেক সময় তারা বেকার থাকে। তাছাড়া কর্মমুখী
শিক্ষার অভাব দিন দিন শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত লোকের শতকরা ৫০ ভাগ তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ পায় না। ফলে
অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন লোক যথার্থ কাজ পায় না। অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার কাজ করতে
বাধ্য হয়। এটিও বেকারত্বের আর একটি বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশে বেকারত্বের
কারণ:
(১) জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বাংলাদেশে যে
হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে কর্মসংস্থান না হওয়ায় ক্রমান্বয়ে বেকারত্ব বৃদ্ধি
পাচ্ছে। এখনও শতকরা ১.৪৮ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান
সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ক্রমান্বয়ে
কৃষিজ জমিতে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে ফলে কৃষক তার ফসলী জমি হারাচ্ছে।
(২) ক্রটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা: ব্রিটিশ
শাসিত ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা আজও পরিবর্তিত হয় নি। তারা মূলত কেরানি তৈরির শিক্ষা
ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও প্রচলিত আছে। শিক্ষিত লোক বাড়ছে
অথচ কর্মমুখী শিক্ষিত লোক বাড়ছে না। ফলে শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে
বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
(৩) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতার জন্য এদেশে বিদেশি বিনিয়োগ কম হওয়ায় পর্যাপ্ত কলকারখানা গড়ে ওঠে না,
ফলে দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
(৪) মূলধনের অভাব: এদেশের জনগণের মাথাপিছু
আয় অত্যন্ত কম বলে সঞ্চয়ের হারও কম। সঞ্চয় কম বলে বিনিয়োগ কম। এটিও বেকারত্বের একটি
উল্লেখযোগ্য কারণ।
(৫) কারিগরি জ্ঞানের অভাব: বাংলাদেশে
বিদেশি প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও কারিগরি
জ্ঞানের অভাবে সে অনুপাতে দক্ষ শ্রমিক যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে, অদক্ষ শ্রমিক বেকার
হয়ে পড়ে থাকে।
(৬) চাকরি নিয়োগ অধ্যাদেশ: মাঝে মাঝে
সরকার চাকরি নিয়োগ অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করায়
এদেশে সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ে।
(৭) অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা: বাংলাদেশের
অধিকাংশ লোকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুন্নত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু আমাদের
দেশের কৃষি মৌসুমি বায়ুর ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু বৃষ্টিপাত কম বেশি হলে চাষাবাদ ব্যাহত
হয়। ফলে বেকারত্বও বৃদ্ধি পায়।
(৮) কুটির শিল্পের অভাব: দেশীয় কাঁচামাল
ও প্রযুক্তিনির্ভর কুটির শিল্পের প্রসার হয় নি এদেশে। যেগুলো আছে সেগুলোও পুঁজির অভাবে
বিলুপ্তির পথে। তাই এদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো শিল্পের প্রায় বিলুপ্তি।
(৯) ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনা: দীর্ঘকালীন
ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার কারণেও বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দুইশত বছরের শোষণ এবং
পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের শোষণে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং এদেশ পরিণত হয় বিদেশি
বাজারে। এর ফলেও বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
(১০) মানসিক হীনম্মন্যতা: বাংলাদেশের
শিক্ষিত বেকাররা হীনম্মন্যতায় ভোগে। শারীরিক শ্রম বা ছোট চাকরিকে তারা অসম্মানের চোখে
দেখে। তাছাড়া, পারিবারিক মানসম্মানের কথা চিন্তা করে অনেকেই অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার
কাজ করতে চায় না। ফলে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়।
(১১) প্রাকৃতিক দুর্যোগ: নানা প্রকার
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ আক্রান্ত। বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদী ভাঙ্গন ইত্যাদি
কারণে বাংলাদেশে বেকারত্ব সৃষ্টি হয়। কৃষিপ্রধান এদেশে বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিতে
ফসলের ক্ষতি হয় এবং কৃষক বেকার হয়ে যায়। তাছাড়া, নদী ভাঙ্গনে প্রতি বছর প্রচুর লোক
গৃহহীন ও বেকার হচ্ছে।
(১২) নদীর নাব্যতা কমে যাওযা: নদীর
নাব্যতা কমে যাওয়ায় নদীতে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে, জেলেরা এবং মাছ বিক্রেতারা
বেকার হয়ে যাচ্ছে।
বেকারত্বের প্রভাব
আর্থসামাজিক অবস্থা: পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
পর্যন্ত বেকারত্ব একটি মারাত্বক সমস্যা। বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বেকারত্ব
একটি বড় সমস্যা। আর্থ-সামাজিক অবস্থার বেকারত্বের প্রভাব-
(ক) বেকারত্বের কারণে ব্যক্তিগত জীবনে
নেমে আসে হতাশা এবং ক্ষোভ। এ হতাশা অনেক সময় তরুণ সমাজকে মাদকাসক্ত করে ফেলে।
(খ) অভাবে পড়ে মানুষ অন্যায়ভাবে অর্থ
উপার্জনে সচেষ্ট হয়। যেমন- চোরাচালানী, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি-ডাকাতিসহ নানাবিধ অবৈধ
উপায়ে মানুষ অর্থ উপার্জন করতে চেষ্টা করে ফলে সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
(গ) বেকারত্বে ভুগতে ভুগতে মানুষ হতাশ
হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত নানা ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
(ঘ) পারিবারিক জীবনে বেকারত্ব এক মর্মান্তিক
অভিশাপ। সংসার জীবনে অভাবের ফলে দাম্পত্য কলহ থেকে শুরু করে নানা ধরনের অশান্তি সৃষ্টি
হয়।
(ঙ) বেকারত্ব যেহেতু মানুষকে হতাশ
করে এবং মানুষ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় তাই তারা দেশের উন্নয়নমূলক কাজ থেকে দূরে সরে যায়।
বিশাল একটি জনগোষ্ঠী যদি দেশের উন্নয়ন ও উৎপাদন থেকে দূরে সরে যায় এবং তার উপরে সমাজ
ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তবে তা জাতীয় জীবনের জন্য হয় ভয়াবহ এবং জাতীয়
ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব পড়ে।
বেকার সমস্যার
প্রতিকার / সমাধান : বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে সীমিত সম্পদ নিয়ে বেকারত্ব
মোকাবিলা করা খুবই কঠিন কাজ। দীর্ঘ ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা ব্যতিত এ সমস্যার
সমাধান আশা করা যায় না। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত
পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন-
(১) কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগবৃদ্ধি: ভূমির
মালিকানার কাঠামো পরিবর্তন করে, খাস জমির সুষ্ঠু বণ্টন করে, কৃষিতে প্রযুক্তি বিদ্যার
প্রয়োগ করে এবং বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধি
করা সম্ভব।
(২) শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগ: কুটির শিল্প
এবং বৃহদায়তন শিল্প কারখানা স্থাপন করে এদেশে বেকার সমস্যার সমাধান করা যায়।
(৩) শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন: শিক্ষা
ব্যবস্থার পরিবর্তন করে উৎপাদন ও বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বেকারত্ব
দূর করা যায়।
(৪) নারী শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থানের
সুযোগ সৃষ্টি: নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ ও উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব
দূর করা যায়।
(৫) বিদেশে নিয়োগ বৃদ্ধি: আমাদের বেকার
জনশক্তির একটা অংশকে প্রশিক্ষণ দান করে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
(৬) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: বেকার সমস্যা
সমাধানের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির
সাথে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
(৭) কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণ: আমাদের
হারানো ঐহিহ্য কুটির শিল্পের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে এবং মুমূর্ষু প্রায় কুটির শিল্পগুলোর
জাগরণ ঘটাতে হবে। তাছাড়া দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এবং কদর বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য
এক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সাহায্য দরকার।
(৮) কারিগরি শিক্ষার প্রসার: আমাদের
শিক্ষা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানের করার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে
হবে। দেশে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনসমষ্টি সৃষ্টি
করতে হবে।
(৯) সরকারি নিয়োগের গতি বৃদ্ধি: সরকারি
নিয়োগের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে থাকায় অনেক ক্ষেত্রে পদ শূন্য
থাকে অথচ নিয়োগ দেওয়া হয় না।
(১০) বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থান
সৃষ্টি: বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি প্রক্রিয়ায়
বিদেশি দাতা গোষ্ঠীদের আকৃষ্ট করে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
উপসংহার: জাতি হিসেবে
আমাদের বাঁচতে হলে চাই এ বিরাট জাতীয় সমস্যার (বেকার সমস্যার) আশু সমাধান। নচেৎ
আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য চাই সরকারি
উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতা।
No comments:
Post a Comment