চলমান কথা

গত ১১ মে, ২০২০ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষার শুভ উদ্বোধন করেন প্রকৌশলী এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপিএসসিএল।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু; স্বপ্ন হলো সত্যি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

Wednesday, July 29, 2020

 মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার

ভূমিকা: মানব সত্যতা যখন বিস্ময়কর সম্ভাবনা দিয়ে নতুন সহস্রাব্দে এসে দাঁড়িয়েছে তখন আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের বিশাল উল্লেখযোগ্য অংশ আক্রান্ত এক সর্বনাশা মরণ নেশায়- সে নেশা মাদকের। এক গভীর ষড়যন্ত্রের শীকার আমাদের তরুণেরা। যে তরুণের ঐতিহ্য রয়েছে সংগ্রামের, প্রতিবাদের, যুদ্ধজয়ের, তাদের সেই ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র। তাদের ভবিষ্যৎকে অসাড়, পঙ্গু ও ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে চলেছে ভয়ঙ্কর এক চক্রান্ত। জাতির মেরুদণ্ডকে অথর্ব করে দেওয়ার জন্যে তাদের ছলে-বলে-কৌশলে টেনে নেওয়া হচ্ছে নেশার করাল বলয়ে। আর তার ফলে মাদক নেশার যন্ত্রণায় ধুঁকছে শত সহস্র প্রাণ। ড্রাগের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার দুঃসাহস হারিয়ে ফেলছে দুর্মর তরুণ্য।

সর্বনাশা নেশার উৎস: নেশার ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও তা ছিল অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে। মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, চরস, তামাকের নেশার কথা শুনে এসেছে মানুষ। উনিশ শতকের মধ্যেভাগে বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে যে মাদকের ব্যবহার শুরু হয় তার ইংরেজি নাম ড্রাগ। ফরাসি বিপ্লবের সময় পরাজিত সৈনিকদের অনেকে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে মাদকের আসক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার কালেও নানা কারণে ব্যথা উপশম ছাড়াও নেশার উপকরণ হিসেবে ড্রাগের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ইত্যাদি এলাকায় মাদক ড্রাগ তৈরির বিশাল বিশাল চক্র গড়ে ওঠে। এভাবেই বেদনানাশক ‘ড্রাগ’ ক্রমে পাশ্চাত্যের ধনাঢ্য সমাজে এক ব্যাপক নেশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে জানা যায়, ধনাঢ্য দুনিয়ার শতকরা আশিভাগ লোক একসময় কমবেশি ‘ড্রাগ’-এর নেশার কবলে ছিল। আর এখন আমাদের মতো দরিদ্র দেশেও তা মারাত্মক সংক্রামক অভিশাপের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। দু’বেলা যেখানে সবার ভাত জোটে না সেখানেও যত্রতত্র এমনকি দ্ররিদ্র্য-পীড়িত বস্তি এলাকায় ড্রাগের সহজ প্রাপ্তি দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ ও তাদের ব্যবহারের ধরন: সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মদতপুষ্ট ড্রাগ ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের মাদক ড্রাগের ব্যবসা ফেঁদেছে। এই ধরনের মাদক ড্রাগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইয়াবা, আফিম, হাসিস, হেরোইন, কোকেন, হেম্প, মারিজুয়ানা, ব্রাউন শুগার, এল.এস.ডি. স্মাক ইত্যাদি। এসবের ব্যবহারের পদ্ধতিও নানা রকম। ধূমপানের পদ্ধতি, ‘ইনহেল’ বা নাকে শোকার পদ্ধতি, ‘স্কিন পপিং’ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ত্বকের নিচে গ্রহণের পদ্ধতি এবং ‘মেইন লাইনিং’ বা সরাসরি রক্ত প্রবাহে অনুপ্রবেশকরণ পদ্ধতি। বিভিন্ন রকম ড্রাগের মধ্যে ইয়াবা আজ সব নেশাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই মাদক শক্তিও অত্যন্ত তীব্র। আরেক মরণ নেশার নাম হেরোইন। এক গ্রাম হেরোইনের ষোল ভাগের এক ভাগ দু-তিনবার ব্যবহার করলে এমন আসক্তি সৃষ্টি হবে যে আসক্ত ব্যক্তি সহজে আর এই নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। নিছক কৌতূহলবশত যদি কেউ হেরোইন সেবন করে তবে এই নেশা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে। তখন প্রচন্ড মানসিক শক্তি এবং চিকিৎসকের অনুপুঙ্খ পরিচর্যা ছাড়া আসক্ত ব্যক্তি এ নেশার কবল থেকে সহজে মুক্তি পায় না।

মাদকাসক্তির পরিণাম: ড্রাগ চোরাচালানি সিন্ডিকেটের ভাড়াটিয়া লোকের পাল্লায় কিংবা অসৎ লোকের প্ররোচনায় পড়ে অথাব নিতান্ত কৌতূহলবশত কেউ ড্রাগের নেশায় পড়লে সর্বনাশা নেশা তাকে পেয়ে বসে। নেশার কারাগারে বন্দি হয়ে দিনের পর দিন তাকে ড্রাগ ব্যবহার করতে হয়। মাদকাসক্তির ফলে তার আচার-আচরণে দেখা যায় অস্বাভাবিকত্ব। তার চেহারার লাবণ্য হারিয়ে যায়। আসক্ত ব্যক্তি ছাত্র হলে তার বইপত্র হারিয়ে ফেলা, পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়া, হেরোইনের খরচ জোগাতে চুরি করা ইত্যাদি নতুন নতুন উপসর্গ ধরা পড়ে। হেরোইনের প্রভাবে রোগীর শারীরিক প্রতিক্রিয়াও হয় নেতিবাচক। ড্রাগ নেওয়া শুরু করলে তার শরীরে অতিরিক্ত সুখের অনুভূতি হয়। শরীর মনে হয় পালকের মতো হালকা। তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মননশক্তি ভোঁতা ও অসাড় হয়ে পড়তে থাকে। ক্ষুধামান্দ্যের ফলে শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তার শরীর ভেঙে পড়ে এবং ক্রমে স্নায়ু শিথিল ও অসাড় হয়ে শেষ পর্যন্ত সে মারাক্তক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।

মাদক-নেশা দ্রুত প্রসারের কারণ: বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, মূলত কাজে-কর্মে, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছেয়ে পড়ার কারণে প্রায় ক্ষেত্রে হতাশ তরুণরা সাময়িক ভালো লাগার আকর্ষণে নেশা-কবলিত হয়। বিশেষ করে নৈরাশ্য, হতাশা, সামাজিক অস্থিরতা এবং জীবনের অর্থশূন্যতা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক স্বস্তি লাভের আশা থেকেই এই উৎকট নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, সর্বাধুনিক সভ্যতাগর্বী অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ এবং বহুজাতিক সংস্থা উৎকট অর্থলালসায় বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসার পথ। নেশার ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসায়িক ও আরোও কিছু হীন স্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত, সমাজজীবনে সুস্থ বিনোদনের অভাব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠেছে বলে সহজেই মানুষ নেশার কবলে পড়েছে।

মাদক চোরাচালান: সীমান্তপথে কিংবা আকাশপথে চোরাচালানের মাধ্যমে ড্রাগ পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু চোরাচালানি সিন্ডিকেট। কিছুকাল আগেও মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের স্বর্গভূমি- ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ বা ‘স্বর্গ ত্রিভুজ’। ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ’স্বর্ণ ত্রিভুজে’র রমরমা অবস্থান যায় ভেঙে। কিন্তু চোরাচালানি চক্র কিছুদিনের মধ্যেই ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে গড়ে তোলে ড্রাগ পাচারের নতুন স্বর্গভূমি ‘গেল্ডেন ক্রিসেন্ট’।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধ: ড্রাগ-ড্রাগন বিশ্বজুড়ে যে মাদক বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে তার কালো থাবা থেকে নিজেদের বাঁচাবার উপায় কী? এ সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা হিমশিম খাচ্ছেন। সমাজসেবীরা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ১৯৮৬ সালে মাদকাসক্তি বিষয়ক এক দলিলে এই অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী হেরোইনের প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তাহলে কি মানুষ পৃথিবীতে মাদক নেশার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না? সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কি এই সর্বনাশা নেশার কবলে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাবে? এই প্রশ্ন সামনে রেখেই বিশ্বব্যাপী বিবেকবান মানুষ মাদকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। দেশে দেশে মাদকবিরোধী সংস্থা ও সংগঠন গড়ে উঠছে। তারা মাদক বিরোধী গণসচেতনতা গড়ে তোলার কাজে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। এসব তৎপরতার লক্ষ্য হচ্ছে:

১। ড্রাগ আসক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টি নিয়ে ভেষজ চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা;
২। ব্যাপক সাংস্কৃতিক উদ্দীপনা ও সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে, তরুণদের সম্পৃক্ত করে নেশার হাতছানি থেকে তাদের দূরে রাখা;
৩। মাদকাসক্তির কুফল ও মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সকলকে সচেতন করা;
৪। মাদক ব্যবসা, চোরাচালানের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা; এবং
৫। বেকার যুবকদের জন্যে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

উপসংহার: মাদকাসক্তির মতো সর্বনাশা নেশার করাল গ্রাসে পড়ে আমাদের তরুণ প্রজন্ম অথর্ব ও অসাড় হতে চলেছে- এ দেখে সর্বস্তরের মানুষ আজ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এটি সমস্যা মোকাবেলায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক। এ মারাত্মক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থেকে আগামী দিনের সুস্থ, সুন্দর, আনন্দ-উজ্জ্বল সমাজ জীবন গড়ে তোলার লক্ষে আমাদের মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধ করার বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদকাসক্তি নিরোধকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, মাদকজাত ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করা একান্ত দরকার। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের মাদক বিষ বর্জনকেও তারা অপরিহার্য বলে বিবেচনা করেছে। মাদক নেশার বিরুদ্ধে একসময় রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই কলম ধরেছিলেন। আজ মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে উদ্বুদ্ধ করায় আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, ড্রাগ-ড্রাগনের রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সবার।

No comments: